Thursday, December 6, 2018

সতেজ বাস্তবতায় প্রশান্ত মন


বাস্তবতা সব সময় সতেজ ও কখনই পিছন ফিরে তাকায় না। বাস্তবতার এই অন্তর্নিহিত  বৈশিষ্ট্যই তাকে প্রশান্ত রাখে বলে মনে হয় কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা অত্যন্ত অশান্ত ও গতিময় যা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে। আমরা যত যান্ত্রিকতার মাধ্যম জীবনকে সহজ কারার চেষ্টা করছি ততই মানব সমাজ থেকে মানবিক গুণাবলী, মনন, সহানুভূতি, শান্তি ইত্যাদি চলে যাচ্ছে বলে মনে হয়। কোয়ান্টাম মেথড, মেডিটেশন এগুলোকে প্রশান্তি পাওয়ার উপায় মনে করে অনেকে, আমি মনে করি না। মনে না করার পিছনে অনেক যুক্তি রয়েছে যা এই আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক। সতেজ বাস্তবতায় সতেজ প্রাণের উৎস প্রসঙ্গে অনেক জায়গায় খুঁজাখুঁজি করেও গ্রহনযোগ্য কোন সমাধান পাই নাই। সম্পদের অসম বণ্টন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনে যে অসুস্থ অস্থির প্রতিযোগীতা, তার সাথে সম্পৃক্ত যে মানসিক অশান্তি তাকে অর্থের প্রাচুর্য দিয়ে সময়ীক সমাধান করা যায় বটে কিন্তু সম্পদের চাহিদা ক্রমাগত বারতেই থাকে। চাহিদা ও প্রাপ্তির ব্যবধান থেকে যে অশান্তি তা চিরন্তন। মানব মনের প্রশান্তির নিয়ামক তাই অর্থ, সম্পদ নয় বরং অন্যকিছু। কেউ এ বিষয়ে কথা বলে না, অনেকটা যার যা ইচ্ছা বুঝে নাও নীতি অনুসরণ করে। স্বাধীন বিশ্বের স্বাধীন দেশের নাগরিক, সবার গ্রহণযোগ্য ধারণার প্রয়োজনটা কোথায়। নিজে যা বুঝেছো তাই যথেষ্ট, বলে বেড়াবার দরকার নাই। বলতে গেলেই যত সমস্যা, নানা প্রশ্ন, নানা ঝগড়া, আমি এই মনোভাবের ঘোর বিরোধী। মনে যা আছে প্রকাশ করে দাও যাচাই বাছাই হয়ে তা সঠিক হয়ে যাবে। আমার চিন্তায় ভুল থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে, এর যাচাইয়ের জন্যও তো তা প্রকাশ করা প্রয়োজন। তাছাড়া বাদ-প্রতিবাদ না হলে নতুন সংবাদ উৎপন্ন হবে কোথা থেকে? 
 
সে যাই হোক, প্রসঙ্গে আসা যাক, সতেজ বাস্তবতায় সতেজ প্রাণ বলতে আসলে আমরা কি বোঝাতে চাচ্ছি। সতেজতার ধারণা কি সেই আগের মতই আছে নাকি এই ধারণারও রূপান্তর ঘটে গেছে। যারা প্রকৃতিবাদী তারা নিঃসন্দেহে রূপান্তরের পক্ষে রায় দিবে, তাঁরা বলবে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। যারা তা নয় তাদের কাছে যা কিছু নতুন তাতেই সন্দেহ বিরোধিতা। অনেকে বলবেন জীবন এখন এতই দ্রুত গতির যে এসব ফালতু বিষয়ে চিন্তা করার সময় নাই। ঠিক এই উত্তরের মধ্য দিয়ে সে তার মতামত দিয়ে দিয়েছে, প্রকৃত সত্য বলে দিয়েছে যা সে নিজেও হয়তবা অতোটা চিন্তা করে দেখে নাই। ঠিক সেই সময়ই সতেজ বা প্রশান্ত মনের মৃত্যু হয়েছে যে সময় যন্ত্র বিপ্লব বা বিজ্ঞান মানুষকে প্রকৃতির আন্তরনিহীত গতি সম্পর্কে সচেতন করেছে। সে বুঝেছে গতিময়তাই জীবন তাই শান্ত-প্রশান্ত জীবনের প্রয়োজন থাকলেও উন্নতির প্রয়োজনে আর প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকার প্রয়োজনে থেমে দাঁড়াবার সুযোগ নাই। তাই এই প্রজন্মের মানুষ প্রচণ্ড গতিময়তার মাঝখানে শান্ত জীবন খুঁজে ফিরছে। প্রকৃতির এই যে ধাঁধা, যা দেখে মেনে হয় তা শান্ত কিন্তু এর পিছনে প্রচণ্ড গতি। এই ধাঁধার উন্মোচনই মানুষের জীবনকে অশান্ত করে দিয়েছে। সৈয়দ সফিউল্লাহর বই অস্তিত্বের অতলান্তের নন্দিত কোলাহল অধ্যায়িট এই প্রসঙ্গে শুন্দর ব্যাখ্যা দেয়। কোলাহল বা অতিমাত্রার গতিময়তাকে মেনে নিয়েই তার মাঝে প্রশান্তি খুঁজতে হবে। এই নতুন বাস্তবতায় মূল্যবোধের রূপান্তর হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই কোলাহলেরও যে একটি মূলনীতি রয়েছে নন্দিত কোলাহলে সৈয়দ সফিউল্লাহ তা উল্লেখ করেছেন। কোলাহলের প্রকৃতি বুঝতে পারলেই এর মাঝে প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। কোন এক টিভি এ্যাডে বক্তব্য ছিল, থমকে যাওয়া সময় গুলোতেই জীবন খুঁজে পাওয়া যায়। এই গতিশীল বাস্তবতায় থমকে দাঁড়াবার কোন সুযোগই নাই, বাস্তবতা ক্ষণিকেই নতুন সতেজ, থামাবার উপায় নাই। বাস্তবতার প্রকৃত অস্তিত্ব তাই ক্ষণিকেই, বাকী সব অবাস্তব, ক্ষণিকবাদ তাই বলে। তাই যখন কেউ বলে গ্রামে চলে গেলে ভাল হয় ওখানে সবই সতেজ, আবার অনেকে বলে গতি কমাও তাহলে শান্তি পাবে, তারা কি সতেজতার সঞ্জার রূপান্তরটি দেখে না
 
 
খড়ম ছেড়ে রাবার চপ্পলে উত্তরণে, হাতে গণনা হতে ক্যালকুলেটরের গণনায় বিশ্বাস স্থাপন করতেও অনেকের অনেক সময় লেগেছিল বলে শুনেছি। সময়ে সাপেক্ষে সঞ্জার রূপান্তর ঘটে, যাকে অনেক আগে প্রশান্তি বলা হোত তা এখন প্রশান্তির সঞ্জা নয়। আগে প্রশান্তির জন্য মুনি-ঋষি সুউচ্চ পাহাড়ের উপরে ধ্যানে বসতো, আজকালকার প্রফেসররা (মুনি-ঋষি) শ্রান্তি-বিনোদনে পাহাড়ে যায় বটে কিন্তু তাদের ধ্যান তাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই, পাহাড়ে নয়। আজকের এই কোলাহলময় বাস্তবতার নীতিমালা আবিষ্কার করে তাতে প্রশান্তি পাওয়া যাবে হয়তবা কিন্তু প্রকৃত শান্তি আসবে যখন কতগুলো মৌলিক অমীমাংসিত বিষয়কে সমাধান করা যাবে। যেমন, সময় একটি ধাঁধা, কেন থামানো যাচ্ছে না?, কোন দিকে যাচ্ছে? স্থান কাল যদি একই হয় তা হলে তা কোথায় আছে? জীবনের অবসান হয় কেন? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কি একই প্রাণ প্রবাহিত হয়? মানুষের বৃত্তি-প্রবৃত্তিগুলো কি পশু প্রবৃত্তিরই উচ্চতর সংস্করণ নয়? এত বিস্তর আলোচনা এখানে করা সম্ভব নয়, তবে এটা বলা সম্ভব যে, এই সব অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধান না করলে মানব মন শান্ত হবে না। যে কোন ধর্ম এ সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে বটে, তবে সেই উত্তর গুলো নিয়ে আপনি সন্দেহ কিংবা প্রতিপ্রশ্ন করতে পারবেন না। উত্তরগুলো অতি পুরাতন বলে এখনকার বাস্তবতার সাথে মিলে না। উত্তরগুলো আপেক্ষিক প্রশ্নাতীত বিশ্বাস স্থাপনের দবী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। অলৌকীকতা আধ্যাত্মবাদে বিশ্বাস স্থাপন করলে উত্তরগুলো গ্রহনযোগ্য হয়। কেউ যদি একটু মাত্রায় আধ্যাত্মবাদ থেকে বের হয়ে প্রতিপ্রশ্ন করার সাহস করে তবে দেখতে পাবে উত্তর গুলো এখনকার সময়উপযোগীতা হারায়ে ফেলেছে। আজকালের ধর্মগুরুরা চেষ্টা করে সময়উপযোগীতা প্রমাণ করার কিন্তু তাদের অদক্ষতার কারণে তা জোড়া-তালী দেয়া সংস্কার কাজ বলে মনে হয়।
 
এতক্ষণ যা বলা হলো তাতে মনে হবে আমি ধর্মর বা আধ্যাত্মবাদের বিপক্ষে কথা বলতে চাচ্ছি, প্রকৃতপক্ষে আমি তা করছি না। ধর্মকে মানব জীবনের ব্যাখ্যা প্রদান করার কথা, বর্তমানে সে কাজটি করছে বিজ্ঞান, আর সমাজের সাধারণ জনতা উত্তরাধীকার সূত্রে হোক, প্রবৃত্তির কারণে হোক, ধর্মগুরুদের প্রভাবে হোক, নিজের অসহায়ত্বের সমাধানে হোক, বৃদ্ধ জীবনে পূর্ণতার খোজে ধর্মের কাছে যাচ্ছে। বেশীরভাগ আধুনিক মানুষ বাস্তববাদী, তারা জীবনের সকল সময়োপযুগী ব্যাখ্যা বিজ্ঞান থেকে নিচ্ছে আর সামাজিকতার জন্য সকল প্রশ্নের তৈরি উত্তর পাওয়ার জন্য কোন একটা ধর্মকে বেছে নিচ্ছে। ঠিক যেখানটায় সে উত্তর দিতে অপারগ সেখানে সে ধর্মকে টেনে আনে। আবেগতারিত হয়ে ধর্মর স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলে সে প্রচুর তৃপ্তি পায়। সবখানে সে ধর্মর প্রচার করে পুলক অনুভব করে। আমি আধ্যাত্মবাদের বা ধর্মের বিপক্ষে বলছি না, বরং বলতে চাচ্ছি সবার অগোচরে ধর্মর সঞ্জায়নে রূপান্তর হয়ে গেছে বর্তমান বাস্তবতায় জীবনের ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম ধর্ম, আর তাই সমাজে এত অশান্তি বিশ্রঙ্খলা, নেশা দ্রব্যের নেশাগ্রস্থর বিস্তার। বিজ্ঞানও জীবনের পূণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে ব্যার্থ তাই মানুষ তা থেকেও পূণাঙ্গ জীবন বিধান পাচ্ছে না। মূলত মানব জ্ঞান এর প্রান্তিক জিজ্ঞাসাগুলো অমীমাংসিতই রয়ে যাচ্ছে, যা থেকে সকল অশান্তির উৎপিত্ত হচ্ছে। নেতৃত্বের অভাবে কোন একটি মত একক ভাবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যও হচ্ছে না। সকল ধর্মে একক ব্যক্তির প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। একনায়ক ছাড়া এক গোষ্ঠি জনতাতে কোন একক মতাদর্শে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আজকের তথ্য প্রযুক্তির যুগে কেউ কাউকে নেতা মানতে চায় না। নানা মুনির নানা মতের ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার আনন্দই আলাদা। আর কেউ কোন ভিন্ন মত প্রকাশ করলে তাকে যুক্তি তর্কে ঘায়েল কারার মধ্য দিয়ে আত্মতৃপ্তি। আদতে ব্যক্তি বিশেষের সুচিন্তার প্রবণতাই যেন নষ্ট হয়ে গেছে বলে মনে হয়।

No comments:

Post a Comment