Thursday, March 21, 2024

নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ -উর্বশী প্রসঙ্গে

রবীন্দ্রনাথ নারীর বিমূর্ত রূপের নামকরণ করেছেন উর্বশী তার কবিতার মাধ্যমে। যারা চিত্রা কাব্যগ্রন্থের উর্বশী কবিতাটা পড়েননি তারা এই লেখার ভুল অর্থ করতে পারেন তাই তাদের উর্বশী কবিতা ও এ সংক্রান্ত আলোচনাটা পড়ে তার পর লেখাটা পড়ার আনুরোধ রইলো। নিচের লিংক দুটাতে কবিতাটি ও ইউটিউবে এর আলোচনা রয়েছে। 

ইউ টিউব এর আলোচনাঃ https://www.youtube.com/watch?v=dt9v97gnB3o
 
চিত্রা কাব্যগ্রন্থে উর্বশী কবিতাটি  https://banglasahitya.net/উর্বশী-urvashi-by-rabindranath-tagore

আমি নারী নিয়ে লিখছি না বরং বিমূর্ত নারী নিয়ে লিখেছি তাই কেউ দয়া করে ভুল বুঝবেন না। এই বিমূর্ত নারী যা সকল পুরুষ প্রাণের আরাধ্য তাকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করে তার স্বরূপ প্রকাশ করার মত উচ্চতর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাতে কোন সন্দেহ নাই। এই নারী ও নারীর পোশাক হিসেবে সারিকে নিয়ে লিখা লিখে আবদুল্লা আবু সাঈদের মত বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বও নানা মহলের তিরস্কার পেয়েছেন বলে শুনেছি। তিনি স্রেফ বলেছিলেন সারিতে নারীকে অধিক রমণীয় লাগে, ব্যাস হয়ে গেল কেন তিনি নারীকে রমণী বললেন? রমণ থেকে রমণী শব্দের উৎপত্তি তাই তার কথায় অশ্লীলতার ছোঁয়া লেগে গিয়েছিল মনে হয়। বিমূর্ত নারী কিংবা বিমূর্ত পুরুষ কিন্তু ব্যক্তি নারী কিংবা ব্যক্তি পুরুষ থেকে পৃথক, বিষয়টা আগে স্পষ্ট করে বুঝে নিয়ে পাঠককে লেখাটা পড়তে অনুরোধ করবো। আমি মা, বোনকে উদ্দেশ্য করে এ লেখায় কিছু লিখি নাই, নারীর যে বিমূর্ত রূপ যাকে রবীন্দ্রনাথ উর্বশী বলেছেন সে সম্পর্কে লিখেছি। পাঠককে তাই লিখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে সতর্ক করছি যাতে সে ভুল না বুঝে।

নারী নামের গবেষণা ধর্মী বই লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ। এই হুমায়ুন আজাদ হুমায়ূন আহমেদের সব লেখাকেই হালকা লেখা বলতেন। বাস্তবে দেখা গেল হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস নারীদের কাছে অধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে হুমায়ূন আজাদের গবেষণা গ্রন্থ নারীর চেয়ে। পাক সাফ জমিন সাদ বাদ বইটি হুমায়ূন আজাদের লেখা, আমি পড়েছি। বইটি নিয়ে তৎকালীন জামাত এর সংসদ সদস্য প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সংসদে। তার পরবর্তীতে বই মেলার কাছে এক অন্ধ গলিতে তাকে বেদম প্রহার করে ফেলে রেখে যায় সম্ভবত জামাত শিবিরের ছোকরারা। তার পর তার চিকিৎসা হয় জার্মানিতে ও সে ফিরে এসে দু একটা সভায় বক্তব্য দেয়ার পর মারা যান। আমি সেই সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির কমার্স ফ্যাকাল্টিতে অর্থনীতির ক্লাসে উৎপাদন খাতে ইনভারটেড ইউ এর মতবাদ শুনছিলাম। স্যার বললেন হুমায়ূন আজাদ এসেছেন নিচে, এই ক্লাসের চেয়ে বরং নিচে নেমে উনার দু একটা কথা শুনাও মহা মূল্যবান হবে। বলে উনি ক্লাস সংক্ষিপ্ত করে চলে গিয়েছিলেন। নারীকে নিয়ে কথা বলতে গেলে এত বিপত্তি হবে কেন? নারীরা তো তেমন কোন ভুত প্রেত নয় যে তাদের নিয়ে কথা বললেই সমাজে তুল কালাম কান্ড বেধে যাবে। বর্তমানের নারী একদল উন্মুক্ত আর এক দল বোরখা আর নেকাবের অন্তরালে সমাজের এক অদৃশ্য রূপ ধারণ করতে চাইছে। একটা সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন? টম এন্ড জেরি ছাড়া এমন কোন নাটক, মুভি, গল্প, উপন্যাস কি আছে যেখানে নারী চরিত্র নেই। কিংবা নারীকে বাদ দিয়ে এমনকি কোন যুদ্ধের ছবিও নির্মিত হয়েছে? বরং নারীর জন্যই যেন নির্মিত হয়েছে মুভিগুলো। যারা নারীবাদী তারা বলবে পুরুষরাই নির্মাণ করেছে সব ছায়াছবি আর তারা তাদের মত করে নির্মাণ করেছে নারী চরিত্র তাই সেটা নারীর আসল রূপ নয় বরং পুরুষ রচিত নারী রূপ।

এবার তবে আমার এক বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি, ১৯৯৯ সালে আমি তখন আমার ছোট মামার ডেক্সটপ পাবলিশিং হাউজ কালার রুটসে কর্মরত। তো একদিন মামা ডেকে বললো একজন ক্লায়েন্ট এসেছে যে ইমেইল করবে। তখন সবার বাসায় কম্পিউটার ছিল না আর ইমেইল করা মানে তো বিশাল ব্যাপার। তখন পাড়ায় পাড়ায় সাইবার ক্যাফের যুগ চলছে। ইন্টারনেট কি জিনিস মানুষ শিখছে। ফেইসবুক, টুইটার, হোয়াটসএপ, ভাইবার এগুলোর জন্মই হয়নি তখন। তো আমি সেই ক্লায়েন্টকে ইমেইলের ইউডোরা ওপেন করে দিলাম। সে তাতে কাজ করলো। বালক সদৃশ সার্ট পেন্ট পড়া দেখতে মেয়ে মেয়ে ভাব আছে চেহারায়, সেটাই ছিল আমার প্রথম দেখার বিশ্বাস। এই ক্লায়েন্ট পরেও বেশ কয়েক বার আসে আর আমি দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারে নিশ্চিত হই যে, সে আসলে মেয়েলী চেহারার ছেলে নয় বরং সে একজন নারী। তার বাবা তাকে শার্ট পেন্ট পড়ায়েই মানুষ করেছে। তার মনেও নারী পুরুষ ভেদাভেদ নেই। বিষয়টি আমার তরুণ মনে দারুণ ধাক্কা দিয়েছিল। নারী সম্পর্কে আমার ধারণায় একটা উৎপটাং ধাক্কা খেয়েছিলাম। 

 

বাঙ্গালী নারীর মন ও চারিত্রিক রূপরেখা রবীন্দ্রনাথ অংকন করেছেন তার কব্য রচনায় কোন আজগুবি কল্পনা থেকে নয় বরং যা ছিল তখনকার সমাজে ভালো তাকেই তিনি উঠায়ে এনে সবার মাঝে ছাড়ায়ে দিয়েছেন। নব্য আধুনিক বাংগালীআনার জন্ম শুনিল গঙ্গোপাধ্যায়ের “সেই সময়” উপন্যাস পড়লেই পরিষ্কার ছায়া ছবির মত দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময় বইটা নিয়ে সিনেমা হওয়া উচিত। এত সুন্দর করে তিনি বাঙ্গালীদের জাগরণ ও নব্য আধুনিক বাঙ্গালীর উদ্ভব তুলে ধরেছেন যা অন্য কোন লেখক করেছেন বলে আমার জানা নাই। হুমায়ুন আজাদের নারী বইটা পড়লাম তা কেনার বহু বছর পর, প্রথম যখন কিনি তখন কয়েক পাতা পড়ার পর আগ্রহ হারেয়ে ফেলি।  এত বছর পর পড়া হচ্ছে তা’ও ধীরে ধীরে।  যত পড়ছি তত কয়েকটা শব্দ বার বার আসছে, নরীর পরাজয় আর পুরষতন্ত্র দ্বারা নারীকে অবদমিত করা। যখন কন্ট্রাসেভটিভ আবিষ্কার হলো তখন একটা নরী মুক্তি ঘটেছে বলে আমার বিশ্বাস আর এদেশে নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী সংসদের স্পীকার, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার, নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ দান এ সব দেখার পর হুমায়ুন আজাদের নারীর পরাজয় আর পুরুষ কর্তৃক নারীর প্রতি বা নারীত্বের প্রতি অত্যাচার এর কথা ঠিক মানা যায় না। তবে ঐতিহাসিক ভাবে নারীর পরাজয়টা হয়েছিল যখন থেকে পুরুষ বুঝতে পেরেছিল যে নারীর পেটে যে বাচ্চাটা আসে সেটার আসল বীজ থাকে তার অণ্ডকোষে। হিন্দু ধর্মে শিবের লিঙ্গ পূজা কেন করে তা আমার বোধগম্য নয়। কলশি কলশি দুধ কেন শিবলিঙ্গে ঢালতে হবে তার কাণ্ডকারখানাও আমার কাছে আজগুবি লাগে। তাদের কাছে শিব সত্য, শিব সুন্দর আর যা সুন্দর তাই সত্য, তাই তারা বলে সত্যম-শিবম-সুন্দরম। হুমায়ূন আজাদের নারী গ্রন্থটি একটা গবেষণা ধর্মী বই আর তার ধরণ ধারণও ভিন্ন। লিটারেচারের বদলে তাতে থিসিস রূপটা বেশি। ওই বই থেকে নারীর প্রকৃত চিত্রটি ফুটে উঠে বলে মনে হয় না বরং নারী (রমণী) শব্দটা যে পুরুষ রচিত ও পুরুষ কর্তৃক নির্মিত তা বুঝা যায়। ইসলাম ধর্মে নারীকে পাজরের হাড়ের সাথে তুলনা করেছে, যাকে বেশি বাঁকালে ভেঙ্গে যাবে আর ছেড়ে দিলে পুরাই সোজা হয়ে যাবে। যে হাদিসে এটা বলা হয়েছে সেটাও আমি পড়েছি তাই নারী গ্রন্থে এর উল্লেখ যথার্থ হয়েছে। হুমায়ুন আজাদ সব ধর্মে নারীকে কিভাবে নিম্নস্তরে নামানো হয়েছে তার তথ্য উপাত্ত দলিল আকারে উপস্থাপন করেছেন তার বইয়ে। তিনি বলেছেন ইসলাম ধর্মে নারীকে পূর্নাঙ্গ মানুষই মনে করা হয় না বরং তাকে আদমের পাজরের হারের থেকে বানান একটি অপূর্ণাঙ্গ মানবী বলে মনে করে থাকে। তার এ কথার যুক্তি কিন্তু মুসলিমরা খন্ডাতে পারবে না। ওরা পারবে জোর খাটায়ে, যেমন সালমান রুশদির মাথার দাম ধরেছিল কয়েক লক্ষ দিনার, সেরকম প্রতিবাদ তারা করতে পারবে কিন্তু যুক্তি খন্ডান অত সহজ না। কারণ এর লিখিত দলিল আছে সবার কাছেই। পুরুষের পৌরুষ আর নারীর নারীত্বকে নানা লেখক নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। নারীর ক্ষমতাকে কেউ বলেছেন ছদ্ম ক্ষমতা বা পর্দার পিছনের ক্ষমতা। দাউদ আঃ কে নিয়ে একটা মুভি দেখেছিলাম অনেক আগে সেখানে দেখানো হয় সম্রাট সুলেমান বা কিং সলোমন কে মসনদে বসায়ে পেছন থেকে তার মা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। কিংবদন্তী ক্লিওপেট্রার কথা কে না জানে, জুলিয়াস সিজার আর রোমান সম্রাজ্য সম্পর্কে ইতিহাসের ছাত্ররা তো জানবে অবশ্যই। এই ক্লিওপেট্রাকে কারপেটে মুড়ে এক নফর লুকায়ে নিয়ে গিয়েছিল জুলিয়াস সিজারের ঘরে। তার পরের ঘটনা গুলোই বলে দেয় ক্লিওপেট্রার আর জুলিয়াস সিজারের কাহিনীগুলো। এমনও অনেক ভাস্কর ছিল যারা জীবনে ক্লিওপেট্রাকে দেখেনি কিন্তু তার মূর্তি নির্মাণ করেছেন। ট্রয় এর যুদ্ধের হেলেন এর কথা কে না জানে। বলা হয় হেলেন ছিলেন একটা উপলক্ষ মাত্র কিন্তু যুদ্ধটা ছিল বহু দিনের রেষা রেষির ফল। সেমেটিক ধর্মত্রয় যথা ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম (মিল্লাতে ইব্রাহিম) এর আদি ঘটনাগুলো দেখলেও দেখা যাবে দুই নারীর বিষয়। ইব্রাহিম আঃ এর বিবি হাজেরার গর্ভে ইসমাইল আঃ আর সারাহ্’র গর্ভে ইসহাক আঃ এই দুই ধারার বিষয় স্পষ্ট। সারাহ্ আঃ এর প্রতি বিধাতার এতই কৃপা ছিল যে তার গর্ভে আসা ইসহাক আঃ ও তার অনুসারীদের মানে ইহুদিদের মাঝে বহু পয়গম্বর আসলো ও তারা তাদের অবহেলা করলো এমনকি হত্যা পর্যন্ত করলো। অথচ বিবি হাজেরার গর্ভে আসা ইসমাইল আঃ এর বংশে শেষে ইসলামের মহানবীর আগমন হলো। বিধাতার এই একচোখা নিতি কেন হলো তা কিন্তু কোন মুসল্লি প্রশ্ন তোলেন না, তুললে তো হুজুরদের কোপানলে পড়তে হবে। অপরদিকে ইহুদি রাবাইরা ইসমাইল আঃ কে অবাধ্য ও দুষ্ট চরিত্রের সন্তান বলে প্রচার করে থাকে। এখানেও ওই নারীর ছদ্ম ক্ষমতা আর তা ঈশ্বর পর্যন্ত সুতা টানা। খ্রিষ্টানদের ইস্টার সানডে নিয়ে একটা মুভি দেখেছিলাম সেখানেও সেই নারীর ছদ্মক্ষমতায়ন দেখান হয়। ধর্মের যুগ শেষ হয়ে গেছে বহু আগেই সেই ফরাসী বিপ্লবের সময়কালে তাই ধর্মগ্রন্থের নারীদের টেনে আনতে চাইনা। ইসলাম নারী নেতৃত্বকে স্বীকারই করে না আর চীন দেশে নারী নেতৃত্ব হাস্যকর রকম একটি ধারণা। জগদ্বিখ্যাত সাহিত্যিকরাই নারীর সঠিক রূপটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি সেক্সপিয়ারের হেমলেট আর ওথেল ছাড়া বেশি কিছু পড়ি নাই তাই সেক্সপিয়ার কি ভাবে নারীকে চিত্রায়ন করেছেন তা জানি না তবে রবীন্দ্রনাথের নারী প্রকৃত অর্থেই বাঙ্গালী নারী। নজরুলও কম যায় না। নিচে নজরুলের কুহেলিকা থেকে তুলে নেয়া কিছু কথা উল্লেখ করছি।

”নারী শুধুই  ইঙ্গিত, সে প্রকাশ নয়, নারীকে দেখি আমরা বেলা ভূমে দাড়িয়ে! মহা সিন্ধু দেখার মত!  তীরে দাড়িয়ে সমুদ্রের যতটুকু দেখা যায়, আমরা নারীকে দেখি ঠিক ততটুকুই! সমুদ্রের জলে, আমরা যতটুকু নামতে পারি নারীর মাঝে ডুবি ততটুকুই! সে সর্বদা রহস্যের পর রহস্য জাল দিয়ে নিজেকে গোপন করে রাখে! এই তার স্বভাব! কি রহস্য ওদের চোখে -মুখে,  ওরা চাঁদের মত মায়াবী, তারার মত সুদূর!  ছাঁয়া পথের মত রহস্য! শুধু আবছাঁয়া শুধু গোপন! ওদের হয়ত শুধু দেখা যায়, ধরা যায় না! রাখা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায়না! ওরা যেন চাঁদের শোভা দু,দন্ডের তরে! তার পর মিলিয়ে যায়! ওরা যেন জলের ঢেউ, ফুলের গন্ধ, পাতার শ্যামলিমা, ওদের অনুভব কর, দেখ, সাবধান কিন্তু ধরতে যেয়ো না! যেমন- ঢেউ ধরতে গেলেই জলে ডুববে, ফুলের গন্ধ শুঁকতে গেলেই কাঁটা বিঁধবে! তাই নারী সারা জীবনেই অধরা।” কুহেলিকা --✍️কাজী নজরুল  ইসলাম

রবীন্দ্রনাথ নাম দিলেন উর্বশী আর নজরুল বললেন কুহেলিকা, মোট কথা তারা নারীকে নির্দিষ্ট করে ব্যাখ্যা করবেন না যেন পণ করে বসে আছেন। মানুষ যেমন তার নিজের মনকে সব সময় তন্ময় তমসাচ্ছন্ন করে ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করে তেমনি নারীকেও তারা নির্দিষ্ট করে রূপ দান করতে চান না। নারীরাই কি তবে নারীদের নির্দিষ্ট রূপটা নিরূপণ করবেন? নারীকে নারীর রূপ নিরূপণ করতে দিলে তা নারীর রূপ হবে না হবে মানুষীর রূপ আর একমাত্র পুরুষই পারে নারীর রূপকে নিরূপণ করতে। হ্যাঁ পুরুষের চোখেই নারীরা সুন্দর নারীর চোখে নয়। নারীর চোখে নারী আরেকটি সাধারণ মানসী, মানুষের আরেকটি রূপ মাত্র কিন্তু পুরুষের চোখেই সে উর্বশী কিংবা কুহেলিকা কিংবা আলেয়া যা ধরা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়।


উপরের ছবিটি শাশ্বত বাঙ্গালী নারীর চিরন্তন বৈশিষ্ট্যের চমৎকার উদাহরণ। বাঙ্গালী নারীদের আমারা এমনই প্রাণবন্ত ও উৎফুল্ল দেখে অভ্যস্ত, কিন্তু ইদানীং একদল সালোয়ার কামিজ (পাকিস্তানি স্টাইল থ্রি পিস) আর আরেক দল হিজাবের দৌরাত্বে বাঙ্গালী নারী তার হাজার বছরের ঐতিহ্য হারায়ে ফেলছে। হিজাবীদের মধ্যেও আবার কেউ কেউ চেহারাটা অন্তত দেখায় বাকিরা তাও দেখাবে না ধর্মীয় বিধি নিষেধের কারণে। আমার এমন এক সহকর্মী নারী আছেন তার চেহারা আমি আজ পর্যন্ত দেখি নাই, শুধু কণ্ঠ শুনে কি মানুষকে আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায়? এর মধ্যে আবার কিছু কিছু বাঙ্গালী নারীরা তাদের ভোল একেবারে পাল্টে ফেলছে। তারা ওয়েস্টার্ন টি সার্ট আর পেন্ট পড়ে পশ্চিমা রূপ ধারণ করতে চাইছে। তিনটা নরী রূপ পাশাপাশি দেখলে কেমন উদ্ভট লাগে দেখুন।
 

 
উপরের কোনটাই বাঙ্গালী নারীর প্রকৃত রূপ বলে মনে হয় না আমার কাছে। এগুলো যেন বাঙ্গালী নারীত্বের কিম্ভুত কিমাকার বিকৃতি। নারীকে তার রূপ নিরূপণ করতে দিলে তারা যে এরকম উদ্ভট কান্ড কারখানা করবে তা বলাই বাহুল্য। বাঙ্গালী নারীদের উর্বশী এসপেক্টটা বুঝতে হবে। উর্বশী ফ্যাক্টরটা সব নারীতে বিদ্যমান আছে তারা যদি তাকে অস্বীকার করে তবে সেই নারী হবে হয় ধার্মীক নারী, না হয় ওয়েস্টার্ন নারী না হয় পাকিস্তানী নারী। বাঙ্গালী নারীর চিরন্তন বৈশিষ্ট্য সে হারায়ে ফেলবে। ফেলবে বলাটা ভুল হবে, তারা তা হারায়ে ফেলেছে এবং সে সম্পর্কে তারা অসচেতন। উর্বশী কবিতার শেষ স্তবকে কবির হতাশা আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। কবিতাটা থেকেই  উল্লেখ করছি।
 
”ফিরিবে না, ফিরিবে না - অস্ত গেছে সে গৌরবশশী
অস্তাচলবাসিনী উর্বশী
তাই আজি ধরাতলে বসন্তের আনন্দ-উচ্ছাসে
কার চিরবিরহের দীর্ঘশ্বাস মিশে বহে আসে” 
 
সত্যিকারের নারীর রূপটা কিন্তু আরো কঠিন, তার একটা ছবি নিচে দেখাচ্ছি। শহুরে নারীরা অফিসের কাজের পর বাসায় গিয়ে রান্না বান্না করে ও বাচ্চাদের দেখাশুনা করে তাই বলে গ্রাম্য নারীরা যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে আছে তাও নয়। নিচের ছবিটাই বলে দেয় বাচ্চা সামলানোর পাশাপাশি তাদের রান্নাবান্নাও করতে হয় আর স্বামীকে খুশি করার অমোঘ দায়িত্ব তারা জন্মগত ভাবেই পেয়ে বসে আছে। গ্রাম্য নারীরা স্বামীর অযথা মানুষিক ও শারীরিক নির্যাতনেও টু শব্দ করার সাহস করে না বলে শুনেছি। 

 
উপরের এই ছবিটা নারী দিবসের আইকন হতে পারে। নারীর পুর রূপটা ব্যাখ্যা করেছে এই মহিলা। এ উর্বশী না, কুহেলিকাও না। এ ধার্মীক নারীও না ওয়েস্টার্ন নারীও না। এ হচ্ছে প্রকৃত নারী যার কোলে বাচ্চা, মাথায় রান্নার লাকড়ি। এ বাঙ্গালী নারীও না, এ হচ্ছে প্রকৃত নারীর সত্যিকারের রূপ। বাঙ্গালী নারী রবীন্দ্রনাথের লাবন্য, কেতকী কিংবা জীবনানন্দ দাশের নাটোরের বনলতা সেন। নারীবাদীদের তাই বলতে চাই সিদ্ধান্ত আপনাদেরই নিতে হবে, হয় আপনারা নারীকে শতধা বিভক্ত করে কিম্ভুত কিমাকার করে ছাড়বেন না হয় পুরুষের চোখে নারীর সৌন্দর্য রূপায়নকে মেনে নিবেন। পুরুষই নারীর সৌন্দর্যের একমাত্র আয়না, নারী তার রূপ বিচারে অপারগ, পুরুষের চোখেই নারী চিরন্তন সুন্দর।

বাঙ্গালী নারীর প্রকৃত রূপটি তবে কিরকম হওয়া উচিত সে বিষয়ে না বললে লেখাটা সম্পূর্ণ হবে না। আমার মতে প্রকৃত নারী সে বালিকা হোক বা সাবালিকা হোক তাকে যদি বাঙ্গালী হতে হয় তবে তার রূপটা নিচের ছবি দুটার যে কোন একটার মত হতে হবে। 



আমরা পারসিয়ানও না আমরা আরব বেদুইন কিংবা পশ্চিমাও না, আমরা বাঙ্গালী। পশ্চিমারা এশিয়ান বলতে চায়নিজদের বুঝায় আর সাব কন্টিনেন্টকে বুঝাতে হলে বলে ইন্ডিয়ান। আমাদের বাঙ্গালীয়ানা সম্পর্কে পশ্চিমারা জানে না কারণ আমাদের নারীরা তাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারে নাই। আমার মা ও খালাকে চিরকাল সরি পড়তে দেখেছি কিন্তু এখনকার মহিলারা সারি পরে বিশেষ অনুষ্ঠানে যেন সারি একটা পার্টি ড্রেস। বিয়ের অনুষ্ঠান, পহেলা ফাল্গুন, নববর্ষে পড়ার জন্য সারি আর বাকি সময় ম্যাক্সি না হয় সালোয়ার কামিজ। এটা কোন কথা হলো? বাংলা ভাষার ও বাঙ্গালীয়ানার উত্থান আর তার পতন এত দ্রুত হয়ে যাবে? বিদেশী সংস্কৃতির এতই প্রভাব যে তা আমাদের ঐতিহ্যবাহী ধারাকে অতিক্রম করে যাবে? আমার মনে হয় বাঙ্গালী মেয়েদের মনে করিয়ে দেওয়া লাগবে যে তারা পাকিস্তানী নয়, আরবের বেদুইনও নয় তারা বাঙ্গালী। বাংলা কালচার ধরে রাখার মত বিদগ্ধ জন কমে যাওয়াতেই কি এই বিপর্যয় তা গবেষণার বিষয়। কিন্তু বাঙ্গালী নারীদের এই ভিন্ন কালচারে মাইগ্রেট করাটা একটা প্রশ্নবোধক বিষয়।

আর পুরুষের চোখে নারীর কল্পনা সর্বদাই আবেদনময়ী তাকে সে ধরতে চায়না কেবল বরং তাকে সে ভোগ করতেও চায়। তাই তার চোখে নারীর কল্পনা নিচের ছবিটার মত। তাকে সে দেবী রূপে কল্পনা করে তার পর তাকে ভোগ করতে চায়। পুরুষের চোখে তাই নারী নিম্নরূপ কল্পনার। এখানে বিচার্য বিষয় নারী কি তাকে ভোগ করতে দিতে চায় কিংবা সেও কি পুরুষকে ভোগ করতে চায়। প্রকৃত পক্ষে উভয় উভয়কেই ভোগ করে ও করতে চায়। নারী প্রকৃতিগত ভাবেই পুরুষের কাছে ধরা দিতে চায় না। এটা উট পাখির একটা ঝাঁককে দুর থেকে কিছুক্ষণ দেখলেই টের পাবেন। ছেলে উটপাখি যখন কোন মেয়ে উট পাখির দিকে আগায় তখন মেয়েটা দেয় দৌর, এই দৌর প্রতিযোগিতায় সে পরাজিত হয় পুরুষটার কাছে, কেন হয় তা কে জানে, হয়তো ইচ্ছা করেই পরাজিত হয়। তার পর যা হয় তা নেট জিও (ন্যাশনাল জিওগ্রাফি) চ্যানেলের ওয়াইল্ড সেক্স ডকুমেন্টারিতে দেখে নিয়েন। প্রকৃতির মধ্যেই খোদিত আছে যে নারী পুরুষের কাছে সহজে ধরা দিবে না, ভাবটা তাদের ওই রকমই দেখাবে, পুরুষের কাছে সে ধরা ঠিকই দেয় তবে পুরুষটাকে নাকে দরি দিয়ে ঘোলা জল খাইয়ে তার পর তার কাছে ধরা দেয়। 

 
”সুরসভাতলে যবে নৃত্য কর পুলকে উল্লাসি
হে বিলোলহিল্লোল উর্বশী”
 
এ কথা চিরন্তন সত্য যে, এ বিশ্বে যা কিছু সুন্দর ও ভালো অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক করেছে নর। এই দুই ভাগের মিলে একভাগ হওয়াটা প্রাকৃতিক সত্য। এই দুয়ে মিলেই তো নতুন এর জন্ম হয় তা হলে বিষয়টাকে এতটা দুর্বোধ্য করে রাখতে হবে কেন? নারী পুরুষ একে অপরের পরিচ্ছদ স্বরূপ ইসলামের ধর্মগ্রন্থেই তো বলা আছে কথাটা। তা হলে এই বিষয়টাকে নিয়ে এত বিদগ্ধ জনের এত বিশাল বিশাল গ্রন্থ রচনার কি এমন আছে? হ্যাঁ আছে বৈকি, বুঝার আছে। নারীদের বুঝতে হবে তারা নরের কাছে ঋণী আর নরকে বুঝতে হবে তারা নারীর কাছে ঋণী, উভয়েরই সমান অধিকার আছে পৃথিবীর সম্পদে। এটুকু বুঝতে ধর্মগ্রন্থ বা আসমানি কিতাবের ঐশী বাণী লাগে না, মানব সভ্যতার সাধারণ জ্ঞানই যথেষ্ট মনে হয় আমার কাছে। সভ্যতাই আমাদের শিখিয়েছে নারী পুরুষের সম্পর্ক কি রকম হওয়া উচিত। হয়তো সভ্যতার কোন পর্যায়ে নারী পুরুষের কাছে নতি স্বীকার করে পরাজয় বরন করে থাকতে পারে কিন্তু আজকের বাস্তবতায় তারা সমান সম্মান ও সম্পদের অধিকারী। আজকের শহুরে কালচারে মা খালাদের পরিবারে সন্তানেরা যতটা আপন তার চাচাদের পরিবারে ততটা নয় প্রমাণ করে সেই আদি মাতৃ তান্ত্রিক পরিবারের ছায়া যেন ফিরে আসছে আবার। মানব সভ্যতাই নারী পুরুষের সম্পর্ক নির্ধারণ করে দেয় আর সময় ভেদে তা উত্তর উত্তর উন্নতই হবে। নারী পুরুষের সম অধিকারেই আজকের পৃথিবীর বিচারে সর্বত ভাবে যুক্তি যুক্ত এবং অধিকাংশেরও তাই মত বলে আমার ধারণা। বাঙ্গালী নারী তার প্রকৃত রূপে ফেরত আসুক এই প্রত্যাশা রইলো। নারীকে নিয়ে এত অল্পে লেখা শেষ করা সহজ নয়, তাই আরেকটি লেখায় আরো কিছু কথা যোগ করছি।
 
সম্পাদনা ও উন্নয়ন ইতিহাসঃ ২আগষ্ট২০২৩> ৩০আগস্ট২০২৩> ২৩জানুয়ারী২০২৪> ১০ফেব্রুয়ারী২০২৪> ২৮ফেব্রুয়ারী২০২৪> ১৮মার্চ২০২৪> ২১মার্চ২০২৪> 
 
 
 
 
 

No comments:

Post a Comment