আমার মেঝ মেয়ে সহজেই আনন্দে থাকে কিন্তু বড়টা ছোট বেলা থেকেই গম্ভীর, সবার ছোট ছেলেটাও হয়েছে বড়টার মত গম্ভীর প্রকৃতির, ও’রা যুক্তি খুব ভাল বুঝে তাই খামখা আনন্দ হলে তার অর্থ তারা বুঝতে পারেনা। ইউভাল নোয়া হারারী তার বই এর কোন এক জায়গায় লিখেছিলেন যে কিছু কিছু মানুষ খুব সহজেই আনন্দ পায় আবার কেউ কেউ আছেন যে অল্প দুখেই কাতর হয়ে পরেন। এই কয়েক মাস আগেও মনটা কাজে ব্যস্ত থাকত, কিন্তু হঠাত করে ইদানীং মাথাটা পুরা ফাঁকা হয়ে গেছে, কোন কাজেই মন সায় দেয় না। সারাক্ষণ কর্ম উদ্দিপনাহীন অলস সময় কাটাতে ইচ্ছা করে। এরকম ভয়ঙ্কর শূন্যতা আর অনিশ্চয়তা আগে আমাকে পেয়ে বসে নাই। এরকম মনের অবস্থা ব্যাখ্যা করাও কঠিন। নিজের মানসিক অবস্থা খারাপ বা অসুস্থ মনে হয়, পাশাপাশি শারীরিক অবস্থাও মনে হয় খারাপের দিকে, নানা রকম আশঙ্কা, হতাশা, কর্মউদ্দমহীনতা সব এক সাথে পেয়ে বসেছে। কিচ্ছুই ভাল লাগে না, আমার অবশ্য সেই ছোটবেলা থেকেই এই ভাল না লাগার রোগ আছে। অবস্থা বুঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে এই ভালো না লাগা রোগ। করনার বছর ২০২০ সালে মনের এই অবস্থা হয়েছিল আমার। সকল কর্মকান্ডের মূল্য শূন্য মানে নেমে গিয়েছিল। বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার নিরন্তর চেষ্টা ছিল তখন। ২০২০ সাল পার হয়ে এখন ২০২৪ চলছে কিন্তু মনের অবস্থার খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে যদিও অগ্র যাত্রা আবার শুরু হয়েছে । খোজ নিয়ে জেনেছি যাদের করনা হয়েছিল কিংবা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তারাও ওই সময় একই রকম বিষণ্ণ একটা সময় কাটিয়েছেন। আমার বিষয়টা অন্যরকম, বাবা আর মা কে হারানর পর থেকেই বিষণ্ণতা রোগ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে সময় পেলেই। বাবা আর মার মৃত্যু আমি সহজ ভাবে মেনে নিতে পারি নাই আর সহজ ভাবে মানতে চাচ্ছিও না। যখন অন্যরা সান্ত্বনা দেয়ার মত করে বলে বাবা-মা চিরকাল কার বেচে থাকে না, তখন আমার খুব রাগ হয়। মৃত্যুই যদি জীবনের একমাত্র পরিণতি হয় তবে এখনই মরে যাওয়াই তো ভাল, বেচে থেকে এত সব করে কি লাভ। বাবা-মা সারাজীবন স্বপ্ন দেখল এটা করবে ওটা করবে, সবেই করল কিন্তু সেগুলো ভোগ করার আগেই তাদের জীবনাবসান হয়ে গেল। এত কিছু করে তবে কি এমন হলো? বুঝলাম আমার জীবনটা সহজ করে দিয়ে গেছে। আমি তো ভবঘুরে হই নাই, চাকরি করছি, আমার সন্তানরাও ভাল ভাবে বড় হয়ে উঠছে। ওদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য তৈরি হচ্ছে। আমার স্ত্রী যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও আমার ও বাচ্চাদের বিষয়ে যন্তশীল। কোথাও কোন সমস্যা দেখছি না এখন পর্যন্ত। সব সমস্যা আমার মনের মধ্যে। মা-বাবা কে হারানোর পর জীবনের মূল্য আমার কাছে অতি নগণ্য হয়ে গেছে। মরে গিয়ে বাবা-মা’র কাছে চলে যেতে ইচ্ছা করে কিন্তু মৃত্যুর পরে যে অনন্ত জীবনের কথা ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে তাতে আমার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। বাবা-মা যখন ছিল তখন কতই না নিশ্চিন্ত থাকতাম। যা করার উনারাই করবে, আমি শুধু তাদের সাথে থাকব। হঠাত করে তারা নাই হয়ে গেল, এখন আমি কোথায় সেই নিশ্চয়তার ছাতা পাই? সন্তানকে তাই এতটা নির্ভরশীল করে বড় করা ঠিক না যাতে বাবা মার অবর্তমানে তারা এতটা অসহায় বোধ করে, আমার এখন তাই মত। আমি একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবা মার অতিরিক্ত যত্ন ও আদর পেয়েছি। আর ওটাই আমার মনের মধ্যে নিরন্তর অসহায়ত্বর জন্ম দিয়েছে।
কম বয়স্কদের মধ্যে যে উদ্যম আর উদ্দীপনা দেখি, মনে হয় তারাও এক সময় না এক সময় নিভু নিভু প্রদীপ হয়ে যাবে। কেউকারাডং পাহাড়ে উঠেছিলাম সোনালী ব্যাংকের ১৮ জন সহকর্মীর এক ট্র্যাকিং টিমের সঙ্গে। যখন নামছিলাম তখন উঠার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল। চিংড়ি ঝরনার কাছে বিশ্রাম নেয়ার সময় যারা নতুন উপরের দিকে উঠছে তাদের দেখা গেল অতি জল জল চোখ সামনে না জানি কি আছে তা দেখার উদ্দীপনা। জীবনের এই পড়ন্ত বয়সে তাই মনে হয় যৌবন এর উঠতি বয়সের উদ্দীপনা এই উপরে চড়ার মত না জানি কত কি আছে সামনে। সব জানা হয়ে গেলে যখন পড়ন্ত সময় আসে তখন আর কিছুই ভাল লাগে না। মনে হয় সবই তো দেখা হল এর পর আর কি-ই বা আছে। তার চেয়ে যত তাড়াতাড়ি এই জীবন থেকে বিদায় নেয়াই শ্রেয়। অস্তিত্বের সংকট এবং লোগো থেরাপি প্রসঙ্গে ভিক্টর এমিল ফ্র্যাঙ্কেল এর বই “জীবনের তাৎপর্যের সন্ধানে [ম্যানস সার্চ ফর মিনিং]” বইটা পড়ার পর বুঝলাম মানুষের সব মানসিক সমস্যার মূলে এই অস্তিত্বের সংকট সম্পর্কে মনের অত্যন্ত গভীরে প্রথিত একটি চিরন্তন অনিশ্চয়তা রয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে এই লেখাটি লিখবো বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও লেখাটা শেষ করতে না পারায় লেখার আগ্রহও হারায়ে বসেছি। তবে এটা ঠিক যে, ভিক্টর এমিল ফ্র্যাঙ্কেল যে কঠিন কষ্টকর জীবন পার করেছেন তার পর তার যে গবেষণা ও বক্তব্য তা অত্যন্ত গভীর চিন্তার ফল। আমি এখন বুঝতে পারি আমার ছোট বেলা থেকে যে ভালো না লাগা রোগ, তা মূলত এই অস্তিত্বের সংকট থেকে উদ্ভূত। এই সংকটটি মনের এত গভীরে কাজ করে যে তা হয়তো অনেকেই বুঝতে পারেন বলে আমার মনে হয় না। আমাদের তথা মানব সম্প্রদায় সমূহের বৃত্তি প্রবৃত্তিগুলো বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাদের প্রথমটাই হলো সারভাইভাল বা বেচে থাকার বাসনা, দ্বিতীয়টা হলো বংশ বৃদ্ধি আর তার পরই আসে সেল্ফ একচুয়ালাইজেশন বা পূর্ণাঙ্গতার বাসনা। ধার্মীকদের জন্য এই বাসনা চরিতার্থ করা সহজ, কারণ তাদের ধর্মেই এর সমাধান দেয়া আছে কিন্তু যারা ধর্মের দেয়া ব্যবস্থাপত্রে আস্থা রাখতে পারেন না তাদের জন্য এই জীবনকে সার্থক করার প্রয়াস অত্যন্ত দুরূহ। বংশ পরম্পরায় টিকে থাকাই হলো তাদের জন্য জীবনের সার্বিকীকিকরন বলে মনে হয়। আমি থাকবো না কিন্তু আমার সন্তানেরা টিকে থাকবে এটাই যেন তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বা পরিণতি। বহু প্রজাতি এই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে, ডাইনোসররাও তো আর এই পৃথিবীর মধ্যে টিকে নাই। ডাইনোসররা তো চিন্তা করতে অপারগ ছিল, তারা তাই তা নিয়ে মাথাও ঘামায় নাই। কেবল মানব মাত্রই চিন্তাশীল প্রাণী আর তাই তাদের মধ্যে এত ধর্ম ও অধর্ম নিয়ে বাক বিতন্ডা। বেচে থাকা ও টিকে থাকার জন্য লড়াই করার ক্ষেত্রেও তাদের এত ভাবের আদান প্রদান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। মানব সাহিত্যের কয়েকটা উদাহরণ নিচে উল্লেখ করছি যাতে দেখা যাবে এই বাসনাই বার বার প্রতিফলিত হয়েছে স্বনামধন্য লেখকদের লেখনীর মধ্য দিয়ে।
আমাদের দেশের জনপ্রিয় লেখক মাসরুর আরেফিনের “আগস্ট আবছায়া” বই এর পৃষ্ঠা ১৪: “আইয়ার বললেন,‘স্যার জীবন অনেক কষ্টের, অনেক। বেঁচে থাকা একটা ভার, একটা বোঝা। ষাটের পরে শরীরে যে কী সব শুরু হয়, তা কাউকে বোঝানো যাবে না যদি না তার বয়সও ষাট হয়ে থাকে। কিন্তু শুধু শরীরের অনেক ব্যথা-অসুখ-কষ্টই না, ব্যাপারটা সে করম না মোটেই। মনের বিমর্ষতা, সার্বিক উদ্যমহীনতা ও মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা, মৃত্যুর ইচ্ছা, প্রতিদিন চাওয়া যে সব শেষ হয়ে গেলে কত ভালো হতো – ষাটের পরের এই পৃথিবী ভয়ানক, স্যার।’” পৃষ্ঠা ১৬: “আমরা এর নাম দিয়েছি জীবনসংগ্রাম, বলছি এই সংগ্রামে তোমাকে জিততে হবে, জেতার ওই চেষ্টাটাই তোমার জীবনের মানে। কমিউনিস্টরা তখন এসে বলছে, না জীবনের মানে ওটা না, জীবনের মানে হচ্ছে তাদের উৎখাত করা যারা তোমাকে এই ভয়ংকর সংগ্রামের মধ্যে পুরে নিঃশেষ হতে বাধ্য করছে। তখন ধর্ম এসে বলছে, না মারামারি কোর না, খোদার প্রতি ভরসা রাখো এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাও, কষ্ট তাহলে অনেক কম হবে, দেখো। আমার মনে পড়ল নবোকভের কথাটা: ‘শিশু বয়সের দোলনাটা দুলছে এক অতল গহ্বরের ওপরে। জীবনের দীর্ঘ দাগটার দুপাশে দুই অন্ধকার—জন্মের আগে অন্ধকার, এবং মৃত্যুর পরে আবার অন্ধকার। আমাদের বেঁচে থাকাটা দুই প্রান্তের এই দুই অনন্ত অন্ধকারের মাঝখানে এক আলোর সামান্য ঝলকানি মাত্র।’ আইয়ারের দৈনন্দিন জীবনের এই গল্প শুনে মনে হলো, নবোকভ ভুল। দুই প্রান্তের দুই অন্ধকারের মাঝখানে যে জীবন সেটার আলোটুকুও আমাদের চোখের ওপরে এত নিষ্ঠুরভাবে ধরা যে সেই আলো, চোখ ধাঁধানো এক বর্বর আলো, আদতে অন্ধকারই।” পৃষ্ঠা ৬২: আমার ধর্মবিশ্বাস কতটা গাঢ় তা নিয়ে আমি, এই পৃথিবীর অন্য অনেক বিশ্বাসী মানুষের মতোই, সংশয়ে থাকি। মনে হলো, আহা, সামান্য এক মানুষ হিসেবে আমি যদি শুধু নিশ্চিত করে জানতাম অসামান্য ও বিশাল খোদা সব সময়েই আমাদের পাশে আছেন সবকিছুর ওপরে তাঁর বদান্যতা ও সুবিচারের বিশাল হাতটা মেলে, তার উর্ধ্বারোহী গান ও উড্ডয়নশীল সুরের গূঢ় অর্থদ্যোতক প্রসাদগুণ আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে, সব মানুষ ও পশুপাখি, পতঙ্গ ও বৃক্ষের জন্য তার ন্যায়নিষ্ঠত্বের স্পষ্ট অঙ্গীকারের তরঙ্গ তুলে, আহা, তাহলে কীভাবে আমি অর্থ খুঁজে পেতাম এই অন্ধকার ঘরের আলোকশূন্যতার মাঝেও। কীভাবে উতরে যেতাম আমার মনের অসুখ ও শরীরের গতিশূন্যতার এই জেলহাজতটাকে। -------- কারণ আর পারিছিলাম না আমি –আল্লাহ, খোদা, ইয়ওয়েহ, কৃষ্ণ, পরব্রহ্ম, জিউস, আহুরা মাজদার সঙ্গে। কিন্তু আকাশে-বাতাসে আমার সেই নিঃশব্দ অন্বেষা অন্বেষাই থেকে গেল আপাতত “
আমেরিকার একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞান কল্প কাহিনীর লেখক এর বই এর পরিচিত মূলক পোস্ট থেকে পরের কথা গুলো নেয়া। তাতেও দেখা যাবে আমার উপরোক্ত আলোচনাটির প্রতিফলন, “জন্মের মুহূর্ত থেকে আমরা অস্তিত্বের চেতনার অগাধ গভীরতায় নিমজ্জিত ও বাস্তবতার অমোঘ পরিস্থিতি দ্বারা বেষ্টিত। আমাদের নিজস্ব চেতনার সীমাবদ্ধতা থেকে যেন কোন রেহাই নেই। আমাদের পার্থিব অস্তিত্বের চেতনার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার কোন উপায়ও নেই। এমনকি মৃত্যুও এই তমসাচ্ছন্ন অস্তিত্বের খপ্পর থেকে আমাদের রেহাই দেয় না। আমরা চলতে থাকি এবং কবরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কিছু গঠন করতে থাকি বা কেবল এই সত্যটির সাথে সমঝতা করতে থাকি যে বাস্তবতার বুননে আমরা নিতান্তই অসহায়। অনেকের জন্যই অস্তিত্বের এই সংকট একটি প্রাথমিক এবং গভীরভাবে প্রথিত অস্থির অভিজ্ঞতা। এটা এমন একটা ভয় এই উপলব্ধি থেকে জন্মায় যে আমরা বিশাল মহাবিশ্বের মধ্যে অতি নগণ্য এবং অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলার মহাসমুদ্রে প্রবাহমান। জন্মের মুহূর্ত থেকেই আমরা জীবনের জটিলতাগুলির সম্মুখীন হয়ে দুঃসাধ্য কাজের মুখোমুখি হই। আমাদের সামনে থাকা অগণিত চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তার সাথে মোকাবিলা করা এবং উপলব্ধি করার জন্য আমাদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অস্তিত্বের সমস্ত মৌলিক রহস্যগুলি আমাদেরকে এমন এক মহাবিশ্বে একাকীত্বের অনুভূতি প্রদান করে চলে যা একধারে সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বৈজ্ঞানিক এবং গাণিতিক বোধগম্যতা প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে অস্তিত্বের বোধগম্য প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের সচেতনতাও বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি নতুন আবিষ্কারের সাথে আমরা অনির্ধারিত উপলব্ধির মুখোমুখি হই যে বাস্তবতা আমাদের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি অপরিচিত এবং আরও জটিল। তবুও এটি অন্তত সচেতনতা যা আমাদেরকে অনিশ্চয়তার মুখে অর্থ এবং বোঝার সন্ধান দেয়, আমাদের অস্তিত্বের মৌলিক রহস্যের মুখোমুখি হতে ঠেলে দেয়। আমরা ধর্ম, দর্শন এবং মতাদর্শের সান্ত্বনাদায়ক বিভ্রমকে দাবি করি এমন একটি অনিশ্চিত বিশ্বে অর্থ এবং উদ্দেশ্যের কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়ার আশায় যা প্রায়শই আমাদের সংগ্রামের প্রতি সম্পূরক বলে প্রতীয়মান হয়। তবুও এই সান্ত্বনাদায়ক বিভ্রমগুলি মানুষের অবস্থার কেন্দ্রস্থলে থাকা অস্তিত্বের সংকটের মুখে সামান্য সান্ত্বনা স্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্ব সম্পর্কে বলা যায় এটি কারণ এবং এর প্রভাবক সমূহের পরিবর্তনশীল আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি নির্ধারক ঘটনা। সময়ের সূচনা থেকে বর্তমান মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা কার্যকারণের একটি বিশাল এবং আন্তঃ সংযুক্ত জালের অংশ যা আমরা আজ যে বাস্তবতায় বাস করি তার মধ্যে দিয়ে অনির্দিষ্টভাবে টেনে নিয়ে চলেছে। আমাদের জন্মের মুহূর্ত থেকে আমরা অস্তিত্বের চাকায় নিবন্ধিত সময় এবং স্থানের স্রোত দ্বারা পরিত্রাণের কোন আশা ছাড়াই চলমান থাকি। তার পরও এই অপ্রতিরোধ্য অনিবার্যতার মুখে আশার ঝিলিক রয়েছে। একটি স্বীকৃতি যে এই মহাজাগতিক ট্যাপেস্ট্রির একটি অংশ হিসাবে বিদ্যমান থাকার কাজটি অজানাকে আলিঙ্গন করার এবং জীবনের অনিশ্চয়তাকে আলিঙ্গন করার একটি সুযোগ। যদিও অস্তিত্বের ভয় জীবনের অনিশ্চয়তায় স্বাভাবিক এবং সহজাত প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এটি আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে থাকা গভীর সম্ভাবনারও স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের ভয়ের মোকাবিলা করার মাধ্যমে আমরা আমাদের অচেতনতার সীমাবদ্ধতা গুলো অতিক্রম করার চেষ্টা করতে পারি এবং মহাবিশ্বের সীমাহীন সম্ভাবনাকে আলিঙ্গন করতে পারি, শেষ পর্যন্ত অজানাকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের অস্তিত্বের অনিশ্চয়তাকে আলিঙ্গন করার ইচ্ছা যা আমাদেরকে সংজ্ঞায়িত করে অনুসন্ধানী সত্তা হিসেবে এবং আমাদের জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে দেয় পরিবর্তনশীল ট্যাপেস্ট্রিতে । “
আমাদের বাস্তবতার চিন্তায় অস্তিত্বের সংকটটি কতটা গভীর তা উপরের লেখকবৃন্দের লেখা থেকে কিন্তু স্পষ্ট বুঝা যায়। মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা কিন্তু এই অস্পষ্ট অস্তিত্বর ধারণা নিয়েই আগায়ে চলেছে। ফ্র্যাঙ্ক ক্লোজ লিখিত আ্যান্টিম্যাটার, ভাষান্তর উচ্ছ্বাস তৌসিফ বই থেকে নিচের উদ্ধৃতি গুলো তুলে ধরছি, যাতে বুঝা যাবে এই সংকট উত্তরণে মানব সভ্যতা আজ কতটা জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
পৃষ্ঠা ৪৭ “নিখাদ শক্তি কিংবা বলা যায়, নিখাদ শক্তির সবচেয়ে নিখাদ রূপ ‘আলো’থেকে বস্তুর জন্ম নেয়াকে এক কথায় বলতে হবে ঐশ্বরিক। প্রতিপদার্থের সঙ্গে পদার্থের যোগকে বলা যায় সবকিছুর শুরু। সৃষ্টির শুরু। কেমন করে বিগ ব্যাং থেকে এই মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল তা আমরা এখান থেকেই বুঝতে শুরু করতে পারি। প্রচন্ড উত্তাপ ও অনেক উচ্চশক্তির আলো মিলে জমাট বেঁধে জন্ম নিয়েছিল পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ। ”
পৃষ্ঠা ১৬৬ ”সব সংস্কৃতির মানুষেরই মহাবিশ্ব সৃষ্টি নিয়ে ভেবেছে। কীভাবে শূন্য থেকে এত কিছু এল, সে হেঁয়ালি আমাদের বিহ্বল করে রেখেছে আজও। বিগ ব্যাং কেন হয়েছে, তা এখনো কেউ জানে না। কিন্তু এর শক্তি থেকেই জন্ম নিয়েছে আমাদের আজকের এ মহাবিশ্ব ও এর মধ্যকার সবকিছু। আর প্রতিপদার্থের রশ্মিই – প্রথমে প্রতি-প্রোটন ও পরে পজিট্রন – আমাদের গবেষণাগারে সেই শিশু মহাবিশ্বের সিমুলেশন তৈরি করে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা এক সেকেন্ডের এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বয়সী শিশু মহাবিশ্বে ফিরে যেতে পারি, তাকে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। মানুষের মেধার এক অবিস্মরণীয় অর্জন এটি। একতাল পরমাণু এক হয়েছে, চিন্তা করতে পারছে এবং প্রবল বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছে মহাবিশ্বের দিকে। বানাতে পারছে এমন যন্ত্র, যা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে বিগ ব্যাংয়ের অসম্ভব কাছের মুহূর্তে। এই সব কিছুই সম্ভব হয়েছে প্রতিপদার্থ গবেষণার মাধ্যমে। বাস্তবতাই যদি এত চমৎকার হয়, তাহলে কল্প গল্পের কী দরকার?”
উপরের তিনটি উদ্ধৃতি থেকে বুঝা যায় মানব সভ্যতার অস্তিত্বের সংকট নিয়ে একটি সর্বজনীন অতি গভীর বিশ্লেষণ সকল সাহিত্য ও মানব কর্মের অন্তরালে কাজ করে আসছে। বিভিন্ন ধর্মে মানব সভ্যতার বিশ্বাস মূলত এই সংকটের একটা সমাধান দেয় কিন্তু তা বিশ্বাস নির্ভর, চিন্তাশীল মানুষ কেউ কেউ তাতে আস্থা রেখে শান্তি খুঁজে কিন্তু আরো মানুষ আছে যারা ধর্মের প্রদত্ত সমাধানে আস্থা রাখতে পারে না। ৪৭ বছর বয়সে এসে সকল সংশয় থেকে মুক্ত হয়ে আমি ধর্মের প্রদত্ত ব্যাখ্যার উপর থেকে আস্থা উঠায়ে নিতে বাধ্য হয়েছি। যারা আস্থা রাখছে তাদের প্রতি আমার কিছু বলার নেই। যে যার যার মত করে তার অস্তিত্বের সংকটের সমাধান করবে, তাতে কার কিই বা বলার আছে। তবে এই প্রসঙ্গে ভিক্টর এমিল ফ্র্যাঙ্কেল এর জীবনের তাৎপর্যের সন্ধানে বইটি পড়ে দেখার অনুরোধ রেখে এই লেখাটা শেষ করছি।
জীবনের তাৎপর্যের সন্ধানে [ম্যান’স সার্চ ফর মিনিং] মূলঃ ভিক্টর এমিল ফ্র্যাঙ্কেল ভাষান্তর এহসান উল হক, প্রকাশকঃ আতাউল কবির খান, বিন্দুতে সিন্ধু, প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০১৯।
এডিট ও আপডেট হিস্ট্রিঃ ২৭অক্টবর ২০২২> ২৫মে২০২৩> ১৮আগস্ট২০২৩>৩১আগস্ট২০২৩> ২২জুলাই২০২৪>
আমার কাছে অনেকের প্রশ্ন
https://surzil.blogspot.com/2024/02/blog-post_28.html
ব্লগ লিংকঃ https://surzil.blogspot.com
ফেইসবুক প্রফাইলঃ https://www.facebook.com/mustafa.surzil.rawnak
No comments:
Post a Comment