Sunday, January 21, 2024

শরিফ সারেং পরিবারের গল্প-২ : মোহাম্মদ মোস্তফা সার্জিল

 

আমার জন্ম ১৯৭২ এর ৫ই নভেম্বর ঢাকার হলী ফ্যামিলি হাসপাতালে। শহরে জন্ম ও বড় হওয়ায় গ্রাম কাহাকে বলে এখনও ভালো করে বুঝি না। ছোট বেলায় জ্ঞান চক্ষু হওয়ার পর ছিলাম যশোরের মোবারকগঞ্জের  কালীগঞ্জ সুগার মিলে, বাবা ওই মিলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ওটার কম্পাউন্ডে ব্রিক সোলিং রাস্তায় দৌড়ানোর ফ্লসব্যাক স্মৃতি আছে আমার মনে। বড় হয়ে জেনেছি আমার আদি প্রজন্ম বিক্রমপুর বর্তমানের মুন্সিগঞ্জ এর লৌহজং উপজেলার মৌছা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। যশোর থেকে বাবা চাকুরী নিয় চলে গেলেন লিবিয়ার  ইজিপশিয়ান বর্ডারের কাছের পোর্ট-সিটি তবরুখ শহরে ১৯৮০ সালে। ছয় মাস পর আমাকে ও মাকে নিয়ে গেলেন সেখানে। তাই যশোরের পর দৌড়েছি সাহারা মরুভূমির বালুর পার্কে। ওখানে আমার একটা সাইকেলও ছিল। খেলেছি ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী, ফিলিস্তিনি, তুর্কী, বুলগেরিয়ান বাচ্চাদের সাথে। ছোট বেলায় মোটা ছিলাম অনেক, ঢাকায় এসে বাবার সাথে প্রথম গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম এক বর্ষায়। কাদা কাহাকে বলে কত প্রকার ও কিকি তা আমি ওখানে যেয়ে প্রথম জেনেছি। একে তো বেঢপ মোটা ছিলাম তার উপর জীবনে কর্দমাক্ত রাস্তায় কখনো হাটি নাই, যতদূর মনে পরে ১৭ বার পা পিছলে আছার খেয়েছিলাম সেবার। সেই গ্রামের বাড়ী, আমার বাপ দাদা ১৪ পুরুষের ভিটা বাড়ী তা সম্পর্কে জানার শুরু ওই ১৭ বার আছার খাওয়ার পর থেকেই। এর পরে একবার ইকবাল ভাই একটা গাড়ি টেস্ট ড্রাইভে নিয়ে যাবে, সাথে নিয়ে গেল, প্রথম বাবা মা ছাড়া গ্রামের বাড়ি যাওয়া। সাথে ছিল পলাশ, শিমুল আপা, লাবনী আপা আর জলীল চাচী। আমি তখন ক্লাস ৭ কি ৮ এ পড়ি। একা একা বাবা মা ছাড়া গ্রামের বাড়িতে যাওয়া দারুণ রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা ছিল । বাড়িতে যেয়ে আমি একাই হাটতে হাটতে সেই ব্রিক সোলিং রাস্তা দিয়ে মাওয়া চৌরাস্তা পর্যন্ত এসেছিলাম পদ্মা নদী দেখতে। আমার ধারনা ছিল না যে মাওয়া চৌরাস্তা গ্রামের বাড়ি থেকে এত দুর হাটা পথ হতে পারে। ফিরার পথে রিক্সা করে ফিরলাম তার পর বাবা যে  নতুন কতগুলা ১০ টাকার নোট দিয়েছিলেন (যদি লাগে তার জন্য), রিকশাওয়ালা সেই নোট দেখে মহা খুশি, তার চোখ চক চক করছিল আর ও যা চাইলো আমি তাই দিয়ে দিয়েছিলাম। আমি যে সময়ের কথা বলছি তা আনুমানিক ১৯৮৫’র শেষ ভাগে। সময় কত দ্রুত ধাবমান তা আমরা বুঝতে পারি না। এর পর ১৯৮৯ এ বাবা চলে আসলেন লিবিয়া থেকে একেবারে, ১৯৮৩ তে মিরপুর শ্যাওড়াপাড়ায় কোন রকমে একতলা বাসাটা কমপ্লিট করে আমাকে আর আমার মাকে একা রেখে চলে গিয়েছিলেন। আমাকে ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুলে ভর্তি করে রেখে গিয়েছিলেন। ১৯৮৯ এ আমার এসএসসি পরীক্ষার বছরে সে একবারে লিবিয়ার পাট চুকিয়ে চলে আসার পর মাত্র ১ বছর কাছে পেয়েছিলাম তাকে তার পর সবাইকে ছেড়ে চিরতরে ১৯৯০ এর ১৫ই ডিসেম্বর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন পরপারে। 

 ১৯৮৯ এ ঢাকা এসে খুব অল্প সময়ে  শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িটা শেষ করেন বাবা, তাও দোতালার পর তৃতীয় ও চতুর্থ তলার একাংশ। বাকি টাকা দিয়ে নিটোল মটরস থেকে ১টা আর সেকেন্ড হেন্ড ১টা মোট দুটা ঢাকা-ভূয়াপুর ইন্টার ডিসট্রিক্ট মিনি বাস নামিয়েছিলেন যা ছিল একটা মস্ত বড় ভুল ব্যবসা বাবার জন্য। সারা জীবন চাকুরী করে হঠাৎ ব্যবসায় হাত দেওয়া তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে হয় না এখন থেকে পিছন ফিরে তাকালে। ওই সময় কালেই মিজান চাচাও একবারে চলে আসেন সৌদি আরব থেকে। রুহুল চাচাও যতদূর মনে পরে তার আগেই একেবারে সৌদি আরব থেকে ফেরত আসেন। আমি বহু দিন ভাবতাম জলিল চাচাই বোধ হয় আমার বাপ চাচাদের মধ্যে সব থেকে বড়, অনেক পরে ভ্রম ভাঙল যখন জানলাম বড় চাচার নাম বারেক চাচা, যাকে তার ছোট ভাইরা বাঘের মত ভয় পেতেন। একটা গল্প শুনেছিলাম, একবার বড় চাচা বাড়ি আসছেন শুনে ছোট ভাইরা যারা কেরম বোর্ড খেলছিল, এত ভয় পেয়েছিলেন যে অনেকে দৌরে পালিয়েছেন ,কেউ কেউ নাকি পুকুরে লাফ দিয়ে সাতরে পালিয়েছেন। আমাদের বাড়িটার নাম হয়ে গিয়েছিল কেরানী বাড়ী। দাদা রজব আলী ছিলেন তার বাবার এক মাত্র ছেলে (দুই বোন ছিল দাদার)। উনার বাবার নাম ছিল শরিফ সারেং। আমার বাবা সহ সব গুলো ভাই কাজির পাগলা অভয় চন্দ্র হাই স্কুলে পড়াশুনা করতেন। সন্ধ্যা হলেই বাড়ীর পাশ দিয়ে কেউ গেলে তারা বাসায় যে পড়াশুনা হচ্ছে তার শব্দ শুনতে পেত। একটা বাড়ি থেকে সব কটা ভাই পড়াশুনা করে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এরকম আমাদের গ্রামের বাড়ির আশপাশের ২০ পঁচিশটা বাড়িতে দেখা যাবে না। সব বাড়ির যেমন গল্প থাকে আমাদের দেশের বাড়ীরও অনেক গল্প আছে। গল্পগুলো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই এই লেখা। হৃদরোগ প্রবণ হওয়ায় আমাদের উপরের মানে চাচাদের মধ্যে শহীদ চাচা বাদে বাকি সবাই স্বর্গবাসী হয়ে গেছেন এরই মধ্যে, তাই এখন আমরাই চাচাত ভাই বোন রা ফ্রন্ট লাইনে চলে এসেছি। এই কারণেই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের অতীত ঐতিহ্য ও গল্প গুলো যাতে বংশ পরম্পরায় প্রবাহমান থাকে তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও আমাদের উপরই এখন বর্তায়। কবে আমরাও নাই হয়ে যাবো তারতো কোন ঠিক ঠিকানা নাই। তবে একটা বিষয় উল্লেখ যোগ্য এখানে, অতীত থেকে আমাদের এই প্রজন্মটা শিক্ষা নিয়ে টিকে গেছে। আমার বাপ চাচারা জানতেন না যে হৃদ রোগটা আমাদের বংশগত বা জেনেটিক একটা সমস্যা, যা আমরা জেনে গিয়েছিলাম, তাই আমরা মানে বাপ চাচাদের পরে আমাদের জেনারেশনের অনেকেই হৃদ রোগের হঠাত আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে যথা সময়ে চিকিৎসা নিতে পেরেছি ও টিকে গেছি। জলিল চাচার একমাত্র ছেলে পলাশ কর্ডিওলজিতে মাস্টার্স করায় ও অনেকের দেখভালও করতে পেরেছে। তবে ও নিজেও যে হৃদ রোগের আক্রমণের শিকার হবে তা আমি চিন্তাও করতে পারি নি। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিক্ষা ও বোধগম্যতা প্রবাহিত হয়। পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মগুলো উন্নত হয়। তাই আমি আমার ভাতিজা রাকিব, মুক্তি, আবির, আসিফ ওদের বলেই দিয়েছি যে তোমাদের আর সন্দেহের অবকাশ না রেখে ভেবে নেয়া উচিত তোমাদের জেনেটিক কোডে এই রোগের উপস্থিতি আছে, হয়ত কারো কারো ক্ষেত্রে এখনও সুপ্ত বা কার কার ক্ষেত্রে প্রকাশ পাবে বয়স কলে।

আমাদের বৃহত্তর পরিবারের কতগুলো ভালো বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে একটা হলো ভাইরা বড় থেকে ছোট পয়েন্ট অব অর্ডার মানতেন। বড়ভাইয়ের কথা ছোট ভাইরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। বাবার কাছে শুনেছি তারা সাত ভাই অন্য গ্রামের যে কাউকে চ্যালেঞ্জ করতো, যে কোন খেলায় তারা তাদের হারতে পারবে। আমাদের বাপ চাচারা সেকেন্ডারি ও হাইয়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে গ্রামে কিন্তু শহরে এসে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাড় ভাই বাদে বাকি সবাই একটা ধাক্কা খায়। গল্পটা মজার আর পরবর্তী প্রজন্মর জানা থাকা দরকার। আগেই বলেছি বড় চাচা খুব রাশভারী ছিলেন আর সবাই তাকে ভয় পেত। মিজান চাচার ছেলে মোহাম্মদ সেদিন রমনা পার্কে মর্নিং ওয়াক শেষে রিক্সায় বাসায় ফিরার সময় বলছিল, আমাদের বড় চাচা খুব জনপ্রিয় ছিলেন আর গ্রামের সবাই তাকে খুব সম্মান করতো। বাবার ঠিক বড় আরেক চাচা ছিলেন খলিল চাচা যিনি খুব অল্প বয়সে মারা যান, বাবা বলেছিলেন আমাকে। যা হোক বড় চাচা ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন আর ওখানে যখন হিন্দু-মুসলমান রায়ট হয় তখন এক হিন্দু পরিবার তাকে ছাদের পানির ট্যাংকে লুকায়ে রায়টের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। পরে তিনি দেশে এসে ঘোষণা করে কার পড়ালেখা করার দরকার নাই, উনি যে বিদ্যা শিখে এসেছেন মানে কার মেকানিক্স তা দিয়ে তার সব ভাই জীবন ভর ভালো মত চলতে পারবে, তিনি তা শিখায়ে দিবেন সবাইকে। এই কথায় জীবনে সব ক্লাসে প্রথম হওয়া জলিল চাচা বেকে বসেন আর আমার বাবা এস এম আব্দুর রহিম উনিও জলিল চাচাকে সমর্থন দেন, সেই সুবাদে জলিল চাচার ও আমার বাবার নেতৃত্বে তারা তাদের সব ছোট ভাইদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন ও সাজাহানপুর এলাকায় বসবাস শুরু করেন। ছোট ভাইদের পড়াশুনার খরচ চালাতেন তিন বড় ভাই, তথা জলিল চাচা, আমার বাবা এস এম আব্দুর রহিম ও শহিদ চাচা। তিন বড় ভাই দ্রুত পড়াশুনা শেষ করে চাকুরীতে ঢুকে পরেন টাকা উপার্যনের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জলিল চাচা পড়াশুনা শেষ করে চাকুরীতে ঢুকেন পিডব্লিউডিতে, আমার বাবা পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট এ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে চিনি শিল্প কর্পোরেশনে ঢুকে সুগার মিলে চাকুরীতে চলে যান, শহিদ চাচা যতদূর জানি জগন্নাথ থেকে পড়াশুনা শেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকুরীতে ঢুকেন। এই তিন ভাই তাদের ছোট তিন ভাই আলিম চাচাকে বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ান, মিজান চাচাকে ঢাকা মেডিকেল থেকে ডাক্তারি আর রুহুল চাচাকে জাহাঙ্গীর নগর থেকে স্টেটিসটিক্স এ পড়াশুনা করান। সবাই তাদের উপার্যন থেকে জলিল চাচাকে ভাইদের পড়া শুনার জন্য তাদের উপার্যন থেকে খরচ দিতেন। ওদিকে বড় চাচা তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে এখনকার পিজি হাসপাতালের নিকট একটা বড়সড় গাড়ির গ্যারেজ দিয়েছিলেন। তখনকার সময় শাহবাগ এর মত এলাকায় গড়ির গ্যারেজ মানে বিশাল একটা ব্যাপার ছিল। অরুণ ভাই, মুসা ভাই ও ইকবাল ভাই কার মেকানিক্স এর কাজ শিখেছেন ওখানেই। পরে যখন মিজান চাচা সৌদি আরবে চলে যান, উনি বোধ হয় অরুণ ভাই আর মুসা ভাইকে সৌদি আরবে নিয়ে গিয়েছিলেন। আলেয়া আপা আর দুলাভাই এর সাক্ষাত ওই গ্যারেজেই। আব্বা ঢাকায় আসার পর আলেয়া আপা আর দুলাভাই প্রচুর আসতেন আমাদের বাসায়। দুলাভাই এর বছরের শুরুতে দেয়া ডায়েরি আমি ব্যবহার করেছি। একবার দুলাভাই একটা মোটরসাইকেলে করে এসেছিলেন আমাদের বাসায়। উনার কাছ থেকে মোটর সাইকেলটা আমি চালাতে নিয়ে যেয়ে ওটার এক দিকের লুকিং গ্লাস বা রিয়ার ভিউ মিরর ভেঙ্গে ফেলেছিলাম।

এর পরবর্তীতে আমাদের পরিবারে যে বড় ঘটনা ঘটে তা হলো আলিম চাচা আর জাহানারা চাচীর বিয়ে। শুনেছি সম্বন্ধটা আমার নানা ভাই এনে দিয়েছিল পরে জলিল চাচা খোজ খবর করে নতুন বাসা ভাড়া করে তার পর ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়। সেই আলিম চাচা সৌদি আরবে তার শ্বশুর সাহেবের কাছে যেয়ে ছয় মাসের মাথায় ওখানেই মারা যান। বিষয়টা এতই হৃদয়বিদারক ছিল যে সেই খবর শুনে, যতদূর জানি এর কয়েক মাসের মাথায় দাদাও মারা যান। যা হোক, তার পরের ঘটনা মিজান চাচার বিয়ে। চাচী পড়াশুনা করতেন বদরুন্নেসা কলেজে আর ঢাকা মেডিকেলে মিজান চাচার হল ছিল কাছা কাছি একই রাস্তায়। চাচী শহীদ চাচীর বোন তাই তাদের মধ্যে চেনা জানা ছিল আর সেই থেকে সম্পর্কের গভীরতা। যা হোক সেই সময়কার সমাজে প্রেম জাতীয় বিষয়গুলোকে ভীষণ নেতিবাচক ভাবে দেখা হতো। মিজান চাচা ও চাচীর প্রেমের বিষয়টা বড় ভাইদের জানাজানির পর তো লংকা কান্ড শুরু হলো। এই ঘটনা থেকেই বুঝা যায় উনাদের ভাইদের ভিতর কি রকম সম্পর্ক ছিল। একজন আরেকজনকে নিজের একদম কাছের মনে করতো। একে অপরের উপর তাদের দাবিও ছিল অনেক। যা হোক মিজান চাচা চাচীকে বিয়ে করে সৌদি আরব নিয়ে যায় আর আমার বাবা যায় লিবিয়ায় পরে আমাদেরও নিয়ে যায়। মিজান চাচা পরে রুহুল চাচাকে আর আমার মেঝ মামাকে (লাল মামা) সৌদি আরবে নিয়ে যান।
 

পরিবারকে আমরা সব থেকে দামী যে উপহারটা দিতে পারি তা হলো সময়। আমার সহকর্মীদের অনেককে বলতে শুনি অমুক ব্রাঞ্চ এর ম্যানেজারি দেওয়ার পর আমি পরিবারকে বলে দিছি যে আমাকে পাবা না, এখন আমি পুরোপুরি সোনালী ব্যাংকের মানে সোনালী ব্যাংককে ষোলআনা সময়ই দিয়ে দিল, এতে করে তার ক্যারিয়ার উন্নত হলো কিন্তু তার পরিবার বঞ্চিত হলো তার মূল্যবান সময় থেকে। আমি এর ঘোর বিরোধী। যার জন্য যেটুকু সময় আমি ঠিক ততটুকু দেই, বেশিও না কমও না। আমি সোনালী ব্যাংকের এমন এমডির কথা শুনেছি যার ছেলে নেশাষক্ত হয়ে শেষ হয়ে গেছে অথচ এক স্টাফ এর দুই ছেলেই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছে। শেষ বিচারে কে সফল ? ওইে এমডি না কি ওই স্টাফ যে অফিসারও হতে পারেনি। অনেকেই জানে না হয়তো রুথ চাইল্ড পরিবারের কথা। ওরা ইউরোপের রাজাদের টাকা ধার দিত। ওরা ইহুদি তো বটেই তার উপর ওরা ওদের বৃহত্তর পরিবারের বাইরে নিজেদের সন্তানদেরও বিয়ে দেয় না। আর এই রুথ চাইল্ড পরিবার প্রধানের অনুরোধেই ব্রিটিশ সরকার ৬ দিনের যুদ্ধে মিডিল ইস্টে ইহুদিদের হারান পবিত্র ভূমি ইসরাইল দখল করে দেয়। কত শক্তিশালী এই পরিবার চিন্তা করতে পারা যায়? বৃহত্তর পরিবার যত ঐক্যবদ্ধ থাকবে অন্যরা তাদের ভয় পাবে। আর যত বিভাজিত থাকবে ততটাই দুর্বল হয়ে যাবে। আমি সোনালী ব্যাংকে ২০০৪ সালে জয়েন করি, এখন আমি সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে ৬২ দিলকুশায় ওয়েজ আর্নার কর্পোরেট শাখার ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোতে কর্মরত আছি।

গ্রামে যদি আমার বাবা সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় তবে একটা কথা তারা বলবেই যে ”রহিম খুব সহজ সরল ছিল”। এটা আমার সকল পরিচিত মানুষকে জিজ্ঞাসা করলেও বলবে ”রওনক বা সার্জিল খুব সহজ সরল মানুষ”। আমি দেখেছি আমার বাবার কাছ থেকে তিনটা বিশেষ গুন আমি ও আমার সন্তানরা জেনেটিকালি বা জীনগতভাবে পেয়ে গেছে, যেই তিনটা গুনই হলো আমাদের দোষ বা ব্যাক পুলিং ফ্যাক্টর (Back pulling factor) ১) অতিরিক্ত সরলতা (Too much simplicity), ২) নিজের ক্ষতি হচ্ছে সত্যেও অপরের উপকার করা অব্যাহত রাখা (Helping others even when we don’t need to) ৩) সহজে অন্যের মতামতকে গ্রহণ করা (Easy accepting other’s opinion)। আমি যখন বুঝলাম এই তিনটা আমাদের গুন নয় বরং দোষ কারণ ১) আমাদের অতিরিক্ত সরলতাকে অন্যরা বোকামি মনে করে ২) নিজের ক্ষতি করে অন্যের উপকার করলে উপকৃত ব্যক্তি তা গুরুত্ব দেয় না আর ক্ষতিপূরণ দিতে ভুলে যায়। ৩) সহজে অন্যের মতামত গ্রহণ করলে আমরা লিডারশীপ থেকে বঞ্চিত হই। আমি আমার তিন সন্তানকে এ বিষয় তিনটি বুঝায়ে বলেছি। তারা প্রত্যেকেই এখন এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন। মাঝে মাঝে মনে করায়ে দেই। কিন্তু তার পরও কি পারি? এই যে আমি সময় ও মেধা  খরচ করে আমার বৃহত্তর পরিবারকে একত্রিত রাখার জন্য  কাজ করছি তাতে কি আমার ক্ষতি হচ্ছে না। আমার মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে না? অনেকে তো তার ক্যারিয়ার নিয়ে এতই মত্ত যে তারা সময় করে এগুলো পড়েও দেখে না। রক্তে যা আছে তা কি সহজে যায়? রুশো বিড়াল পালে তাদের নাম রেখে। আমার তিন সন্তানের মধ্যে প্রাপ্তির মধ্যে বিড়ালের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা, সে তার ছোট ভাই আর মার জন্য পারে না। এই জেনেটিক প্রকাশ্য প্রবণতার মধ্যে সাদৃশ্য কি কাকতালীয়? আমার বড় মেয়ে প্রাপ্তি আর রাকিব গাট্টা গোট্টা মোঙ্গলিয়ান দৈহিক গঠন পেয়েছে। আমার ছেলে মুসাব যখন দেখল শাহনাজের মেঝ ছেলে তার একটা সব দরজা খোলা যায় খেলনা গাড়ি খুব পছন্দ করে ফেলেছে তখন সে তা গায়েব করে দিল বা লুকায়ে ফেললো। এই সব জেনেটিক প্রবণতা গুলো প্রকাশ্য যা আমাদের আদি পুরুষদের জেনেটিক সেট থেকে আমাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আর এটাই বংশ ধারা। আমরা সবাই এখানে জেনেটিকালি কানেকটেড। আমাদের পরিবারে আমি তিনটি স্বতন্ত্র জেনেটিক ধারা সনাক্ত করতে পেরেছি। এই ধারা তিনটার মধ্যেই কনফ্লিক্ট হয়। আমরা যদি আমাদের জেনেটিক ট্রেন্ড গুলো ধরে তা শুধরাতে পারি তবে এই কনফ্লিক্ট গুলো কমে আসবে। ধারা তিনটা সম্পর্কে শুধুমাত্র দিলশাদ মিজান মিমিকে জানায়ে রেখেছি সবিস্তারে।

রাশেদ ভাই, কাইউম ভাই আর মৃত বাচ্চু ভাই প্রসঙ্গঃ উনাদের সম্পর্কে আমি যা জানি তা যারা জানে না তাদের জানায়ে রাখি। এরা আমাদের গ্রামের বাড়ির নিকটতম প্রতিবেশী ও দুর সম্পর্কের আত্মীয়। পলাশ, শিমুল আপা আর লাবনী আপাদের নিকট আত্মীয় আর আমাদের দুর সম্পর্কের আত্মীয়। গ্রামে আমাদের জমি গুলোর সাথে লাগোয়া উনাদের অনেক জমি আছে আর তাই সেই জমিগুলোর সীমানা নিয়ে তাদের সাথে আমাদের মত বিরোধও আছে প্রচুর। গ্রামে এরা এখন প্রভাবশালী হলেও এক সময় আমাদের পরিবারের সাথে এরা আরো ঘনিষ্ঠ ছিল ও এদের অবস্থা আমদের চেয়ে খারাপ ছিল। ইকবাল ভাই প্রায়ই বলে ওরা এক সময় আলু দিয়ে ভাত খেতো চালের উপর চাপ কমাতে। এখন তাদের অবস্থা অনেক ভালো। উনারা বিল বোর্ডের ব্যবসা করতেন এখন ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডের ব্যবসায় আরো ভালো অবস্থায় আছে বলে আমার ধারনা। কাইউম ভাই এর ছেলে আমেরিকায় অক্সফোর্ডে পড়ে বলে শুনেছি। আমি পরিবার নিয়ে একবার কাইউম ভাই এর বাসায় (গ্রামের বাড়িতে উনাদের ট্রিপলেক্সে) গিয়েছিলাম উনি পুর বাসা ঘুরায়ে দেখিয়েছিল ও খুব আদর আপ্যায়ন করেছিলেন। ওই বাসা এখন রেল মন্ত্রণালয় গেস্ট হাউজ হিসেবে ভাড়া নিয়েছে। রাশেদ ভাই যখন চেয়ারম্যান ছিলেন তখন আমার সোনালী ব্যাংকের চাকুরীতে গ্রামের বাড়িতে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছিল। আমার মোহাম্মদ মোস্তফা সার্জিল নাম বলাতে কেউ গ্রামে আমাকে চিনতে পারে নাই, তখন শহিদ চাচা রাশেদ ভাইকে বলায় সে ওই পুলিশ অফিসারকে ফোন করে আমার ক্লিয়ারেন্স এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রাশেদ ভাই চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তাদের ছোট ভাই( বর্তমানে মৃত) বাচ্চু ভাই এলাকায় প্রচুর মাস্তানি করেছে ও ভাই চেয়ারম্যান বলে দাপট দেখাতো। এই বাচ্চু ভাই যখন ছোট ছিল তখন বাড় চাচার শাহবাগের গ্যারেজে তাকে কিছু দিনের জন্য বোধ হয় নিয়ে আসা হয়েছিল তাই আলেয়া আপা, দুলাভাই আর ইকবাল ভাই এর সাথে বাচ্চু ভাই এর ভালো রকম সখ্যতা আছে। কিন্তু নিকট প্রতিবেশী হলেও এদের সাথে আমাদের বাদ প্রতিবাদ অনেক বেশি। শহিদ চাচার সাথে তারা বৈরি আচরণ করে এমনকি তার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে। রুশুকে বাচ্চু ভাই ধাক্কা দিয়ে রাস্তা থেকে ফেলে দিয়েছে। আমি এটাও শুনেছি দাদুকে মারতে যাওয়ার মত উদ্ধত আচরণ করেছে বাচ্চু ভাই। মিজান চাচার গাড়ি ভাংচুরও এরাই করেছে তবে তার পর ক্ষমাও চেয়েছে আর গাড়ির গ্লাস ঠিক করে দিয়েছে । আমার সাথে একবারই কথা হয় বাচ্চু ভাই এর তখন বাচ্চু ভাই আমার বাবা যে তাকে আমাদের যশোরের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই গল্প করলেন আমার সাথে। প্রচুর প্রশংসা করলেন আবার বাবার। তাই নিকট কিংবা দুরের আত্মীয় ও প্রতিবেশী হলেও এদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমাদের জমির প্রতি তাদেরে এক ধরনের  লোভ আছে, আমাকে কাইউম ভাই নাপতার ক্ষেতের জমি বিক্রি করব কিনা জানার জন্য ফোন দিয়েছিলেন কয়েক বছর আগে, আমি সাফ সাফ জানায়ে দিয়েছিলাম আমার বিক্রির কোন পরিকল্পনা নাই। মৃত বাচ্চু ভাই এর ছেলেটার সাথে আমার কথা হয়েছে এই কিছু দিন আগে। সে বাবার মতই বাউণ্ডুলে ও কথায় বার্তায় অভদ্র। রাশেদ ভাই, কাইউম ভাই আর মৃত বাচ্চু ভাই দের সাথে আমাদের পরিবারের যাদের ঘনিষ্ঠতা আছে আর যাদের বৈরিতা আছে উভয় পক্ষকেই আমার বলার আছে যে ওরা আমাদের কেউ না। তা যদি হতো তা হলে আমাদের ফ্যমেলি ট্রিতে বা পেডিগ্রিতে তাদের নাম আসতো। কাইউম ভাই ইকবাল ভাই সমবয়সী বিধায় তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক আছে বলে শুনেছি। তা থাকতেই পারে কিন্তু আমার মতে এই তিন ভাই আমাদের পরিবারের নানা জনের সাথে নানা ভাবে সম্পৃক্ত, তারা আমাদের সম্মানও করে আবার ক্ষতি করতেও ছাড়ে না। এরকম মিশ্র আচরণ করে দেখে আমি বলবো এরা আমাদের জন্য যতটা ভালো তার চেয়ে ক্ষতিকর বেশি। ওদের সাথে আমাদের সখ্যতারও কিছু নাই আবার আমাদের ক্ষতি করতে আসলে তাদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আর যদি সম অধিকারের ভিত্তিতে আসে তবে আমরা স্বাভাবিক আচরণ করবো। এটা আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এই প্রতিবেশী তিন ভাই এর পরিবারটির বিষয়ে। অন্যদের ভিন্ন মত থাকতে পারে।

কথায় বলে জীবন সম্পর্কে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দাও জীবন বদলে যাবে। কেউ অর্ধেক খালি গ্লাসকে অর্ধেক ভরা মনে করলেই কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়। আমাদের পরিবারে আমরা যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন ঘরে বড় হয়েছি তাই জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য আছে। এটাকে কাছাকাছি আনলেই আমাদের মধ্যে কনফ্লিক্ট অব অপিনিয়ন কমে যাবে। আর এটার জন্য চাই প্রচুর ডায়ালেকটিক বা বাক্যালাপ। সেটাই আপাতত করার চেষ্টা করছি আমি। পরিবারের সবাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিলেই এই কাজটা সহজ হবে। আজকের গল্প এখানেই শেষ করলাম পরে আরো লেখার ইচ্ছা আছে।

বাংলাদেশে প্রচলিত প্রবাদ আছে বিক্রমপুরকে নিয়ে, যার একটা হলো
বিক্রমপুইরা রা খাইতেও পারে খাওয়াইতেও পারে।”
আর আরেকটি হলো
বিক্রমপুইরা পোলা ৮০ টাকা তোলা”।

প্রাসঙ্গিক ভিডিও তে লেখরে বক্তব্য https://youtu.be/K7T2Zr-IgHU

সম্পাদনা ও উন্নয়কালঃ ২৮নভেম্বর২০২৩> ০৩ডিসেম্বর২০২৩>২০ডিসেম্বর২০২৩> ১৫ জানুয়ারী ২০২৪> ১৯ জানুয়ারী ২০২৪> ২৭ জানুয়ারী ২০২৪>

প্রাসঙ্গিক লিংকঃ শরিফ সারেং পরিবারের গল্প-১ : দিলশাদ মিজান মিমি

No comments:

Post a Comment