Monday, January 29, 2024

“সদ্য গুলানো রাজকীয় গণতন্ত্রের সরবত- একটা কিনলে একটা ফাও”-অরুন্ধতী রায়

নিউইয়র্কের হার্লেমে রিভারসাইড ইতিহাসখ্যাত গীর্জায় ১৩ মে, ২০০৩ ভারতীয় লৈখিকা অরুন্ধতী রায় উপরোক্ত শিরোনামে যে ভাষন দেন তা ২৬ মে, ২০০৩ দিললীর আউটলুক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করা হলো। [ভাষান্তর: ড.ইব্রাহীম মুকুল] দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ জুন, ২০০৩

২০০৩ সালে আমেরিকা - ইরাক যুদ্ধের উপর অরুন্ধতী রায়ের ভাষন

১৯৮৮ সালের কথা। পারস্য উপসাগরে সংস্থাপিত মার্কিন মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র দুর্ঘটনাক্রমে ইরানী বেসামরিক বিমান গুলিবিদ্ধ করে ভুপাতিত করে; এতে ২৯০ জন যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। প্রথম জর্জ বুশ তখন তার প্রেসিডেন্সিয়াল প্রচারাভিযানে দুর্ঘটনা সম্পর্কে তার মতামত চাওয়া হলে তিনি সম্পূর্ণ নির্দিধায় এবং অকপটে বলেন, “ঘটনা যাই হোক না কেন আমি কখনো যুক্তরাষ্টের পক্ষে ক্ষমা চাইবো না। বিষয়টি কি- আমি থোড়াই তোয়াক্কা করি- আসলে ঘটনাটি ঘটবে এমন, যেমন আমরা চাই”। -নব্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কি বাহারী প্রবচন।

তারপর যুক্তরাষ্ট্র আক্রমন করল ইরাক। নিউইয়র্ক টাইমস/সিবিএস নিউজ জরিপে বলা হলো ৪২% মার্কিনী বিশ্বাস করে সাদ্দাম হোসেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগর আক্রমণের জন্য সরাসরি দায়ী এবং এবিসি সংবাদ জরিপ মতে ৫২% মার্কিনী বিশ্বাস করে সাদ্দাম হোসেন প্রত্যক্ষভবে ‘আল কায়েদা’- কে সমর্থন প্রদান করেছিল। অথচ এ ধরনের কোন মতামতই প্রমান -নির্ভরশীল নয়; কারন কোন প্রমাণই উপস্থিত নেই এ সবই মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়া প্রচারিত পরোক্ষ উস্কানি, ইশারা এবং মিথ্যার ফুলঝুরির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই মিডিয়া অন্যভাবে ফ্রী প্রেস হিসাবে পরিচিত যা সমসাময়িক মার্কিন গণতন্ত্রের ফাঁপা স্তম্ভ ছাড়া আর কিছু নয়।

ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পক্ষে জনমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বহুস্তর বিশিষ্ট মিথ্যার উপাখ্যান এবং প্রবঞ্চনার মাধ্যমে যা সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন স্বয়ং মার্কিন সরকার এবং বিশস্ততার সঙ্গে সম্প্রসারিত করে মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়া।

ইরাক এবং ‘আল-কায়েদা’-এর যোগসূত্রের কাহিনী আবিষ্কার ছাড়াও ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে এ জাতীয় প্রবল উন্মাদনা তো তৈরীই ছিল। জর্জ বুশ এ পর্যন্তই বলেছিলেন, বরং ইরাক আক্রমন না করাই হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতীমূলক। আমরা পুনরায় প্রত্যক্ষ করলাম এমন এক মস্তিষ্কবিকৃত ভ্রান্ত ধারণা যে একটি অনাহারক্লিষ্ট, বোমাক্রান্ত এবং অবরুদ্ধ দেশ সর্বশক্তিমান যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেবে। কিউবা, নিকারাগুয়া, লিবিয়া, গ্রানাডা এবং পানামার পর সম্প্রতি ইরাক এই তালিকার একমাত্র দেশ। কিন্তু এবার সাধারণ মানের প্রতিবেশীসুলভ উন্মাদনা নয়; বরং এবারের উন্মাদনায় রয়েছে মতলব।

ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলো, যুদ্ধে জয়ী হলো যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু গণ বিধ্বংসী অস্ত্র (WMD or Weapon of Mass distraction) পাওয়া গেল না, একটিও না। সম্ভবত সেগুলো আবিষ্কারের আগেই মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। এখন সম্ভবত আমাদের জন্য একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন যে সাদ্দাম হোসেন কেন সেগুলো ব্যবহার করলো না যখন তার দেশ আক্রান্ত হচ্ছিল।  




অবশ্য কোন উত্তরই পাওয়া যাবে না। খাঁটি বিশ্বাসীরা অবশ্য উত্তর খুঁজবেন অস্পষ্ট এবং ঝাপসা টিভি প্রতিবেদনে প্রদর্শিত পুরানো গুদামের কয়েক ব্যারেল নিষিদ্ধ রাসায়নিক থেকে। তবে সেগুলো সত্যি সত্যি রাসায়নিক কিনা, বাস্তবিকই নিষিদ্ধ কিনা কিংবা প্রাপ্ত ক্যানব্যারেল কিনা সে বিষয়ে অভিন্ন মত পাওয়া যায়নি। অবশ্য অসমর্থিত গুজব রয়েছে যে, সেখানে এক চা চামচ পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট এবং পুরানো হার্মোনিকা পাওয়া গেছে।

কিন্তু এরি মধ্যে একটি বর্বর জাতি কর্তৃক নিশ্চিহ্ন্ হলো একটি সুপ্রাচীন সভ্যতা। যারা একথা বলেন যে, ইরাকের যদি রাসানিক এবং নিউক্লিয়ার অস্ত্র না থাকে, যদি ‘আল-কায়েদা’-এর সঙ্গে সম্পর্ক না থাকে, যদি ওসামা বিন লাদেন সাদ্দাম হোসেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সমপরিমাণ ঘৃণা করেন, তাদের উদ্দেশ্য বুশের বক্তব্য-সাদ্দাম নরঘাতী স্বৈরাচারী, কাজেই ইরাকে সরকার পরিবর্তন প্রযোজন।

চল্লিশ বৎসর আগে জন এফ কেনেডী-এর সময়ে সিআইএ বাগদাদের সরকার পরিবর্তনের ইঙ্গিত করে। ১৯৬৩ সালে এক সফল অভ্যুথানে ইরাকে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে। নতুন বাথ সরকার সিআইএ সরবরাহকৃত তালিকা অনুসারে শত শত ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবী এবং বামপন্থী হিসাবে খ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিকে অপসারন করে। সমগ্র বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করা হয়। ইন্দোনোশিয়া ও পূর্ব তিমুরেও একই কায়দায় শত শত লোককে হত্যা করা হয়। কথিত আছে এই রক্তস্নান তত্ত্বাবধানে তরুণ সাদ্দামেরও ভুমিকা ছিল। ১৯৭৯ সালে বাথ পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বের পর সাদ্দাম হোসেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮০ সালের এপ্রিলে তিনি যখন শিয়াদের হত্যা করছিলেন, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ঝিগনিউ ব্রিঝিনস্কী ঘোষনা দিলেন, ‘আমি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরাকের মৌলিক স্বার্থের কোন অসামঞ্জস্য দেখি না’। ওয়াশিংটন এবং লন্ডন গোপনে এবং প্রকশ্যে সাদ্দাম হোসেনকে সমর্থন দিলেন। তারা তাকে অর্থ দিলেন, অস্ত্র দিলেন এবং দ্বৈত ব্যবহারোপয়োগী গণ বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরীর উপকরণ সরবরাহ করলেন। সার্বিকভাবে তারা তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ালো। ৮ বৎসর স্থায়ী ইরান যুদ্ধ এবং ৮৮ সালে কুর্দিদের উপর গ্যাস প্রয়োগকেও তারা সমর্থন দিলো, এখন ১৪ বৎসর পর সেই অপরাধ পুনঃ উত্তপ্ত করা হলো এবং ইরাক আক্রমণের যৌক্তিকতা হিসাবে ব্যবহৃত হলো। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পর বসরায় শিয়াদের উত্থানকে তারা প্ররোচিত করলো এবং সাদ্দামের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। কিন্তু সাদ্দাম সেই বিদ্রোহ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলো এবং হাজার হাজার লোককে হত্যা করলো প্রতিহিংসার আগুনে পুড়িয়ে। 


এখানে বিচার্য বিষয় হলো যদ্ধদ সাদ্দাম হোসেন দুষ্কর্মের হোতা হন, তবে যারা তাকে সমর্থন যুগিয়েছেন, নিশ্চয়ই তাদের অন্তত যুদ্ধাপরাধের বিচার হওয়া উচিত। কেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সেই সমস্ত কুখ্যাত নারী বা পুরুষ মুখ গুলো আবশ্যক ব্যক্তি তালিকায় থাকবে না, কারণ সাম্রাজ্যবাদে এসব কোন বিষয়ই নয়। আমাদেরকে বলা হচ্ছে এ সবই অতীত, সাদ্দাম হোসেন একটা দানব যাকে অবশ্যই থামাতে হবে এবং একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই তাকে থামাতে পারে। অতীতের শয়তানী পাপ এবং ভবিষ্যতের একটা মন্দ পরিকল্পনা থেকে বর্তমানের জরুরী নৈতিকতার অজুহাতে ব্যবহারের এটা একটা কার্যকর কৌশল। ইন্দোনেশিয়া, পানামা, নিকারাগুয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, তালিকা বেড়েই চলেছে। মিশর, সৌদি আরব, তুরস্ক, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ান প্রজাতন্ত্র সমূহেও অশুভ সরকার ভর করার প্রস্তুতি চলছে ঠিক এখনি। মার্কিন এটর্নী জেনারেল জন এসক্রফট সম্প্রতি ঘোষণা করেন, মার্কিন স্বাধীনতা স্বয়ং বিধাতার দান, কোন সরকার বা দালিলিক মঞ্জুরী নয়। বিধাতা যখন হাতের মুঠোয়, তখন জাতিসংঘের তোয়াক্কা করার কি আছে? সুতরাং আমরা বিশ্ববাসী স্বর্গ থেকে প্রাপ্ত ম্যান্ডেটের অদিকারী এক সাম্রাজ্যের মুখোমুখি। আমরা মুখোমুখি এমন এক সাম্রাজ্যের যার অধিকার রয়েছে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যাওয়ার, যার অধিকার রয়েছে মানুষকে ধর্মীয় মৌলবাদ, কলুষিত আদর্শ, স্বৈরাচার, দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার। এই সাম্রাজ্য এগিয়ে চলছে এবং গণতন্ত্র চোরাগুপ্তা পথে যুদ্ধের জন্য মরিয়া হয়ে আছে। আপনার বাড়ীর দরজায় এখন গনতন্ত্র হাজির। এই নতুন পণ্য, সদ্য গুলানো রাজকীয় গণতন্ত্রের (গরম করুন, তেল দিন এবং বোমা মারুন) সুবিধা জনগণ মৃত্যুর মত সামান্য মূল্যে পেতে পারেন। কিন্তু সম্ভবত নিগ্রো বা পূর্ব এশিয়ার অধিবাসিগণ প্রকৃত মানুষ নন, সম্ভবত আমদের মৃত্যুও প্রকৃত মৃত্যু হিসাবে গণ্য হবার নয়, আমাদের ইতিহাসও প্রকৃত ইতিহাস হবার মত নয়। ইতিহাস হলো বিগত কয়েক মাসের ইতিহাস যখন পথিবী প্রত্যক্ষ করলো টিভিতে সরাসরি প্রচারিত যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক আক্রমণ ও দখল। ওসামা বিন লাদেন এবং আফগানিস্তানে তালেবান যেভাবে মিলিয়ে গেলো, সেভাবে অদৃশ্য হয়ে গেলো সাদ্দামের সরকার যাকে বিশ্লেষকগণ আখ্যায়িত করেেলন- ‘ক্ষমতার শূন্যতা’ হিসেবে। যেসব নগরী অবরুদ্ধ ছিল, দিনের পর দিন খাদ্য বিহীন, পানি বিহীন, বিদ্যুৎ বিহীন ছিল, যেসব নগরীতে নির্বিচারে বোমা বর্ষিত হয়। সেখানে এক দশকের অধিক সময় ধরে জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা আরোপিত থাকায় জনগণ ছিল অনাহারে এবং দারিদ্র্যপীড়িত, সে সব জনপদ আকস্মিকভাবে হয়ে পড়লো নগর প্রশাসন বিহীন। ৭০০০ বৎসরের পুরোন সভ্যতা পর্যবসিত হলো অরাজকতায়-বিশৃঙ্খলায়।

দোকান, অফিস, হোটেল, হাসপাতালে লুট হলো, মার্কিন-বৃটিশ সেনারা পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। তারা বললো, এ বিষয় তাদের প্রতি কিছু করার নির্দেশ নেই। কার্যত তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল শুধু মানুষ মারার, তাদেরকে রক্ষা করার নয়। তাদের অগ্রাধিকার করণীয় পরিষ্কার ছিল। ইরাকীদের নিরাপত্তা-নিশ্চিতা তাদের কাজ ছিল না। ইরাকের অবকাঠামো যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা রক্ষা করা মোটেই তাদের কাজ নয়। ইরাক আক্রমনের পূর্ব থেকেই তাদের কাজ স্থিরকৃত ছিল ইরাকের তেলক্ষেত্র রক্ষা করার মধ্যে।

সিএনএন এবং বিবিসি বার বার প্রচার করে ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র। টিভি, প্রতিবেদক, সেনাবাহিনী এবং সরকারী মুখপাত্র এই গর্হিত কাজকে স্বৈরতন্ত্রের প্রতি ‘মুক্ত মানুষে’র উষ্মা প্রকাশ হিসাবে চিত্রিত করলেন। মার্কিন প্রতরিক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামসফেল্ড বলেন, এটা স্বাধীনতা, মুক্ত মানুষ অপরাধ করার জন্য স্বাধীন, তারা ভুল করে এবং খারাপ কাজ করে। কেউ কি জানে যে  ডোনাল্ড রামসফেল্ড ছিলেন একজন নৈরাজ্যবাদী ? আমি বিস্মিত, রডনি কিং কে প্রহার করার পর লস  এঞ্জেলসের দাঙ্গার সময়ও তিনি কি একই মত পোষন করতেন ? বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী দু'মিলিয়ন লোকের স্বাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তি সম্পর্কেও কি তিনি তার থিসিসে বিশ্বাসী কি ? পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী স্বাধীন দেশে সবচেয়ে বেশী বন্দী ? বিষয়টির উপকারিতা সম্পর্কে কি তিনি অফ্রিকান-আমেরিকানদের সঙ্গে কথা বলবেন যাদের ২৮% লোক তাদের প্রাপ্ত বয়ষ্ক জীবনের কিছু অংশ জেলে কাটাবেন? তিনি কি ব্যাখ্যা করবেন কেন তিনি এমন এক জন প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করেন যিনি টেক্সাসের গভর্নর থাকাকালীন ১৫২ টি প্রানদন্ড কার্যকর করেন?

ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগে ১৬টি গুররুত্বপূর্ণ অবস্থান রক্ষা করার জন্য The Office of Reconstruction & Humanitarian Assistance (ORHA) পেন্টাগনে একশটি তালিকা পাঠিয়েছিল। জাতীয় যাদুঘর ছিল তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে। তদসত্ত্বেও এটা শুধু লুট করা হয়নি, ধ্বংস করা হয়। জাদুঘরটি ছিল প্রাচীন সংস্কৃতির ঐতিহ্য। আজ আমরা যেই ইরাককে জানি, তা ছিল মেসোপোটেমিয়ার নদী বিধৌত ভূমিখন্ড। যেই সভ্যতা ফোরাত এবং ইউপ্রেটিস নদী তিরে গড়ে উঠেছিল, সেই সভ্যতার কীর্তি হলো বিশ্বের প্রথম লেক, প্রথম ক্যালেন্ডার, প্রথম নগরী, প্রথম লাইব্রেরী এবং হ্যাঁ বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র। ব্যাবিলনের রাজা হামবুরাবি সর্বপ্রথম নাগরিকদের জন্য সমাজ জীবনের উপর আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনে পরিত্যক্ত নারী, গণিকা, ক্রীতদাস এবং এমন কি প্রাণীদের অধিকারও লিপিবদ্ধ করা হয়। হামরাবি প্রণীত আইনকে শুধু বৈধতার জন্ম হিসাবেই স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি, বরং সামাজিক ইনসাফের ধারনা ও উপলব্ধি হিসাবেও গণ্য করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র তার এই অন্যায্য যুদ্ধের জন্য কম উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করতে পারলো না এবং ইনসাফের প্রতি অসম্ভব অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করলো।


অদ্ধকারের যুবরাজ রামসফেন্ড লুটপাটের সময় পেন্টগন ব্রিফিং এ তার অনুগত মিডিয়া বাহিনীকে ব্যবহার করেন। টিভিতে দেখা গেল বার বার একই চিত্র, ফুলদানি নিয়ে কয়েকটি ভবন থেকে কতিপয় ব্যক্তির হাঁটা-চলা, অন্তত বিশবার এবং আপনি বলবেন- ও খোদা! সেখানে কি এত ফুলদানি ছিল এটা কি সম্ভব যে সমগ্র দেশে অত ফুলদানি আছে।

হার্লেমের দরিদ্রদের পক্ষে কি মেট্রোপলিটন জাদুঘর লুট করা শোভন। এটা কি সানন্দে অভিনন্দনযোগ্য? তেল মন্ত্রণালয় রক্ষা করার অবস্থান ছিল ORHA কর্তৃক চিহ্নিত ১৬টি তালিকার ১৬ তম অবস্থানে। একমাত্র এটাকেই রক্ষা করা হয়েছিল। সম্ভবত দখলদার সেনারা ভেবেছিল মুসলমান দেশে উল্টোদিক থেকে পড়তে হয় কিনা? টিভি আমাদেরকে জানালো, ইরাককে মুক্ত করা হয়েছে এবং ধন্যবাদ বুশ-ব্লেয়ার, ২১ শতকের নেতৃস্থানীয় নারীবাদী ব্যক্তিত্ব, আফগানিস্তানও নারীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়ার পথে। বস্তুতঃ ইরাকের অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত, খাদ্য নিঃশেষিত, জনগন অভুক্ত থাকার প্রান্তসীমায় উপনীত, শিয়া-সুন্নীদের মধ্যে সিভিল ওয়ার ঘটতে যাচ্ছে। এরইমধ্যে আফগানিস্তানও তালেবান পর্ব অরাজকতার পথে অগ্রসরমান হচ্ছে এবং দেশটিও প্রতিদ্বন্দ্বী যুদ্ধবাজদের দ্বারা বিভাজিত হচ্ছে।

এভাবে উৎসাহিত হয়ে ২রা মে বুশ ২০০৪ প্রচারাভিযানে নেমেছেন চুড়ান্তভাবে মার্র্কিন প্রেসিডেন্ট নিবাচিত হওয়ার জন্য। প্রচারাভিযানাটি ছিল ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম মিলিটারী জেট বিমান উড্ডয়ন যা সমুদ্র তীরে নোঙ্গর করা বিমানবাহী রণতরী আব্রাহাম লিস্কনে অবতরণ করে, এসোসিয়েটেড প্রেসের মতে, প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ স্বীকার করেন যে বিশাল জাহাজটি এমন একটি অবস্থানে রাখা ছিল যাতে সান দিয়াগো উপকূলরেখার পরিবর্তে পটভূমি হিসাবে সমুদ্রসহ বুশের ভাষনের জন্য যথার্থ টিভি এঙ্গল পাওয়া যায়। বুশ যিনি কখনো সামরিক বাহিনীতে ছিলেন না, মিলিটারী জ্যাকেট, কমবেট বুট এবং বৈমানিকের গগলস পরিহিত আকর্ষণীয় পোশাকে ককপিট থেকে বেরিয়ে আসলেন। উৎফুল্ল সেনাদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাক যুদ্ধ বিজয় ঘোষণা করলেন। তিনি সতর্কতার সাথে বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এটা প্রাথম জয়। এভাবে চলতেই থাকবে। সরাসরি বিজয় ঘোষণা এড়িয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারন জেনেভা কনভেনশন অনুসারে বিজয়ী সেনারা দখলদার হিসাবে পরিগণিত হয়। আর বৃটিশ প্রশাসন দখলদারের দায় স্বীয় কাঁধে নিতে নারাজ। এদিকে যতই ২০০৪- নির্বাচন এগুচ্ছে, ততই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরো একটি জয় প্রদর্শনের প্রয়োজন জরুরী হয়ে দেখা দিচ্ছে আন্দোলিত ভোটারদেরকে প্রলুব্ধ করার জন্য। এক্ষেত্রে সিরিয়া বলী হওয়ার জন্য মেদবহুল হয়ে উঠছে। বৃদ্ধ নাৎসী হার্মান গোয়েরিং বলেন-জনগণকে সবসময়ই নেতাদের দর-কষাকষিতে আনা যায়-যা আপনাকে করতে হবে, তা হলো তাদেরকে বলতে হবে যে আপনারা আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন এবং শান্তিবাদীদের দোষারোপ করতে হবে এই বলে যে, যে তাদের দেশপ্রেম নেই এবং তারা দেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। যে কোন দেশে এই প্রচারণা কাজ করে।

তিনি যথার্থই বলেছেন। এটা খুবই সহজ। বুশ সরকার এর উপরই ভরসা রাখে। নির্বাচনী প্রচার এবং যুদ্ধ, গণতন্ত্র এবং স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির শাসনের প্রভেদ দ্রত বদ্ধ হয়ে আসছে। প্রচারণা যুদ্ধের সতর্কবাণী হলো যুক্তরাষ্ট্র নিঃশেষ হবে না, টিকে থাকবে। এটা ভোটারের আস্থা আন্দোলিত করে। কিন্তু যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যের মৃত্যুর সমস্যা কম-বেশী আঘাতপ্রাপ্ত।

অপারেশন “Shock & Awe”-এর প্রাক্কালে এক মিডিয়া ব্রিফিং-এ জেনারেল টমী ফ্রাঙ্ক ঘোষানা দিলেন-এই অভিযান ইতিহাসের অন্য কোনটির মত নয়। সম্ভবত তিনি যথার্থই বলেছেন। আমি কোন সমর বিষয়ক ঐতিহাসিক নই, কিন্তু সর্বশেষ কখন এরকম একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল?

সত্যি সেটা ইতিহাসে বিরলই হবে যে, জাতিসংঘ কুটনীতির দাপ্তরিক কর্তত্ব (অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অস্ত্র পরিদর্শন) খাটিয়ে ইরাককে হাঁটু পর্যন্ত নামানো, জনগণকে অনাহারী রাখা, অর্ধ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যু, মারাতœকভাব অবকাঠামো ধ্বংস এবং অধিকাংশ অস্ত্রশস্ত্রও মারাতœকভাবে ধ্বংস হয়েছে মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পর, Coalition of the Willing কাপরুষোচিত ভাবে ইরাকে আক্রমনকারী বাহিনী পাঠায়।

ইরাকীদের মুক্তির জন্য আক্রমণ? আমি তা মনে করি না। এ যুদ্ধ এমন একটি যুদ্ধ যে, ‘আসুন দৌড় প্রতিযোগিতায় নামি, তবে তার আগে আপনার হাঁটু ভেঙ্গে ফেলতে দিন’। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত ইরাক যুদ্ধের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রস্তাবনায় অসম্মতি জ্ঞাপনকারী ফ্রান্স, জার্মান এবং রাশিয়ান সরকার, যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র একে-অপরের সঙ্গে এমন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলো যে তারা কে কতটা চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র যেন যুদ্ধে জয়ী হয়।

প্রেসিডেন্ট জেক সিরাক বৃটিশ আমেরিকান বিমান বাহিনীকে তাদের বিমান সীমা ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করলো। জার্মনীতে মার্কিন সামরিক স্থাপনা সমুহকে কাজ শুরু করার জন্য খুলে দেওয়া হলো। জার্মন পররষ্ট মন্ত্রী জোসস্কা ফিসার জনসমক্ষে সাদ্দাম হোসেন সরকারের দ্রুত পতন-এর ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। একই আশাবাদ ব্যক্ত করলেন ভøাদিমির পতিনও। আক্রমণকারীদের দলে অতি দ্রুত অবস্থান নেয়ার পুর্বে ইরাককে নিরস্ত্রকরণে এই সরকারগুলোই বিভক্ত হয়ে পড়ে। ধ্বংসের সঙ্গে শরিক হওয়ার ইচ্ছাবাদ ব্যক্ত করা ছাড়াও তারা আশাবাদী হলো ইরাকের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ-পূর্ব তেল চুক্তিগুলোর প্রতি সাম্রজ্যবাদী শক্তি সম্মান প্রদর্শন করবে। কেবল কলাকৌশল জানে না এমন কেউ আশা করতে পারে পুরানো সাম্রাজ্যবাদীরা তা করবে না।

যুদ্ধ বিতর্কের সময়ে জাতিসংঘে প্রদত্ত রোমাঞ্চকর এবং দাম্ভিক উচ্চরব নৈতিক ভাষেণের বিষয়টি পাশ কাটালে, পরিণামে জনগণের বিরোধিতা সত্ত্বেও সন্ধিক্ষণে পশ্চিমা সরকারসমূহের একজোট হওয়ার ব্যাপরটি ছিল অভিভূত হওয়ার মত।

যখন তুর্কী সরকার তাদের ৯০ শতাংশ জনগণের মতামতের নিকট নতী স্বীকার করলো এবং তুরস্কের মাটি ব্যবহারের বিনিময়ে রক্তমুল্যের বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো, তখন তুরস্কের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির অভাবের অভিযোগ উত্থাপিত হলো। আন্তর্জাতিক গ্যালাপ জরিপ মতে, এককভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে কোন ইউরোপিয়ান দেশের ১১ শতাংশের উপরে সমর্থন ছিল না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামত উপেক্ষা এবং অবৈধ আক্রমন সমর্থন করার জন্য ইংল্যান্ড, ইঁটালী, স্পেন, হাঙ্গেরী এবং পর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের সরকার সমূহের প্রশংসা করা হলো। ধারণা করা হচ্ছে সম্ভবত সেটাই গণতান্ত্রিক রীনি-নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ। এটাকে কি বলা যায়? নব্য গণতন্ত্র (বৃটেনের New Labour -এর মত)?

আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ পূর্বে ১৫ই ফেব্রুয়ারী সরকারগুলো কর্তৃক প্রদর্শিত অবিবেচক পণ্য বিকিকিনির বিপরীতে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করলো প্রথমবারের মত ৫টি মহাদেশে যুদ্ধের বিরুদ্ধে নৈতিকতার স্বপক্ষে ১০ মিলিয়নের অধিক লোকের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয়-দর্শনীয় মিছিল। আমি নিশ্চিত, আপনাদের অনেকেই সেখানে অংশ গ্রহণ করেছেন।

তাদেরকে এবং আমাদেরেকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অবজ্ঞা করা হয়। যুদ্ধ-বিরোধী প্রতিবাদ সুম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে প্রেসিডেন্ট বুশ বলেন-‘এটা যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মত, ঠিক একটা ফোকাস গ্রুপের উপর ভিত্তি করে আমি পলিসি সিদ্ধন্ত নিতে যাচ্ছি। একজন নেতার ভূমিকা হলো নিরাপত্তা বিষয়ে পলিসি সিদ্ধান্ত গ্রহন করা, এক্ষেত্রে জনগনের নিরাপত্তা’।

আধুনিক বিশ্বের পবিত্র গাভী-গণতন্ত্র, আজ সংকটাপন্ন, এই সংকট খুবই গভীর। গণতন্ত্রের নামেই সকল প্রকার ক্ষতি সাধন করা হয়। গণতন্ত্র অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা বুলি থেকে সামান্য বেশি। এটা এমন কিছু হতে পারে যা আপনি চাইবেন। গণতন্ত্র মুক্ত বিশ্বের বীরাঙ্গনা যে পোশাক খুলতে পারে, পরতে পারে, সকল স্বাদ পুরণ করতে প্রস্তুত, যাকে চাইলেই ব্যবহার বা অপব্যবহার করা যায়।

ঠিক ১৯৮০ সাল নাগাদ গণতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে সামাজিক ইনসাফ কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক গণতন্ত্র নব্য উদার পূঁজিবাদীদের পক্ষে সেসব ধ্বংস করার কৌশল আয়ত্ত করার লক্ষ্যে বেরিয়ে পড়েছে। তারা স্বাধীন বিচার বিভাগ, স্বাধীন সংবাদপত্র, স্বাধীন সংসদ-গণতন্ত্রের এসব হাতিয়ার সমূহ প্রবিষ্ট করানো এবং সেগুলোকে নিজেদের মতলবে রূপান্তরের কৌশল আয়ত্ত করেছে। কর্পোরেট বিশ্বায়ন প্রকল্প সকল বিধি-বিধান চুর্ণ করে ফেলেছে। অবাধ নির্বচন, স্বাধীন সংবাদপত্র স্বাধীন এবং বিচার ব্যবস্থা খুব কমই অর্থবহ হয়ে উঠে যখন মুক্ত বাজার সেগুলোকে বিক্রয় যোগ্য পণ্যে রূপান্তর করে সর্বোচ্চ দরদাতাদের নিকট সহজলভ্য করে তোলে।

গণতন্ত্র কতটা অচল-অবরুদ্ধ এটা বোঝার জন্য আমাদের কতিপয় সমসাময়িক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার মাধ্যমে ধারণা পাওয়া সম্ভব। সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ভারত (এ সম্পর্কে আমি খানিকটা লিখেছি, তই আজ আর এ বিষয়ে বলছি না), সবচেয়ে আকর্ষণীয় দক্ষিণ আফ্রিকা, সবচেয়ে ক্ষমতাশালী যুক্তরাষ্ট্র এবং সবগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশী শিক্ষমুলক হলো সেসব পরিকল্পনা সমুহ যেগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে বিশ্বের নবীনতম ইরাককে অগ্রগামী করার জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ এবং ঔপনিবেশবাদের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠদের উপর বর্বর রাজত্বের ৩০০ বছর পর ১৯৯৪ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র ক্ষমতাসীন হলো। এটা দৃশ্যমান অর্জন। ক্ষমতাসীন হওয়ার দু’বছরের মধ্যে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস কাঠামোতে বিন্যাস, প্রাইভেটাইজেশন এবং উদারীকরণের বিশাল কর্মসূচীর অনুসরণে শুধুমাত্র অদৃশ্যভাবে ধনী-দারিদ্রের ব্যবধান সৃষ্টি হলো। এক মিলিয়নেরও অধিক সংখ্যক লোক চাকরি হারালো। বিদ্যুৎ পানি এবং গৃহায়ণের মত মৌলিক সেবাগুলো কর্পোরেশনে রূপান্তরের ফলে ১০ মিলিয়ন দক্ষিন আফ্রিকান যা জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ, পানি এবং বিদ্যুৎ থেকে বিচ্যুত হলো, দু মিলিয়ন তাদের বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হলো।

ইত্যবসরে, ঐতিহাসিকভাবে শতাব্দীকালের অমানবিক শোষণের সুবিধাভোগী স্বল্প সংখ্যক শেতাঙ্গ পূর্বের  তুলনায় অধিক নিরাপদ হলো। তারা সে দেশের ভূমি, খামার, কারখানা এবং পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলো। তাদের জন্য বর্ণবাদ থেকে নব্য উদারতাবাদে উত্তরণ যেন ঘাসের বিরক্তির কারন ঘটায় মাত্র। আসলে এটা হলো পরিচ্ছন্ন বিবেকে বর্ণবাদ যা গণতন্ত্রের নামে পরিচিত হয়।

গণতন্ত্রের জন্য সাম্রাজ্যবাদের কোমল উক্তি হলো নব্য উদার পুঁজিবাদ। প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতেও গণতন্ত্রের মেশিন গুলো কার্যকর ভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত। রাজনীতিক, মিডিয়া, ব্যক্তিবর্গ, বিচারপতিগণ, ক্ষমতাশালী কর্পোরেট এবং সরকারী কর্মকর্তাগণ এমনভাবে একটি গুপ্ত কাঠামোতে সংস্থাপিত থাকে যা সংবিধান, কোর্ট, সংসদ এবং প্রশাসনের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর করে ফেলে এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বাধীন মিডিয়া যা সংসদীয় গণতন্ত্রের সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরী করে এ অবস্থাটা অস্পষ্টও নয়, আবার বিশদও নয়।

উদাহরণ স্বরূপ, ইটালিয়ান প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকনি প্রাধান প্রধান ইটালিয়ান সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, টিভি চ্যানেল এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের স্বার্থ সংরক্ষণ করেন। ফাইনান্সিয়াল টাইমসের রিপোর্ট করে যে তিনি ইটালিয়ান টিভি প্রদর্শনের ৯০% নিয়ন্ত্রণ করেন। সম্প্রতি একটি ঘুষের অভিযোগের বিচারের সময় তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বামপন্থীদের কাছ থেকে ইটালীকে রক্ষা করতে সমর্থ হন। তিনি বলেন, ‘ত্যাগের জন্য আর কতকাল আমাকে বেঁচে থাকতে হবে’? যা অবশিষ্ট ১০ ভাগ টিভি দর্শকের জন্য ছিল অশুভ লক্ষণ। স্বাধীন বক্তৃতার মূল্য কত? কাদের জন্য স্বাধীন বক্তৃতা?

যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থাটা আরো জটিল। দেশের সবচেয়ে বড় রেডিও ষ্টেশনের মালিক হলো ক্লিয়ার চ্যানেল ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইনকর্পোরেটেড যা বারোশ’র অধিক চ্যানেল পরিচালনা করে এবং বাজারের নয় ভাগ ধারণ করে। প্রতিষ্ঠানের কর্মাধ্যক্ষ শত শত হাজার ডলার প্রদান করে বুশের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে। যখন শত শত হাজার মার্কিন নাগরিক ইরাক যুদ্ধের-বিরুদ্ধে রাজপথে অবস্থান নেয়, তখন ক্লিয়ার চ্যানেল দেশব্যাপী যুদ্ধের পক্ষে দেশপ্রেমিক ‘র‌্যালিজ ফর আমেরিকা’-এর আয়োজন করে। এটা তার রেডিও স্টেশন গুলোকে প্রচরে কাজে লাগায় এবং তার প্রতিনিধি পাঠায় তথ্য সংগহে যেন সেগুলো জনগুরুত্বপূর্ণ। সম্মতি উৎপাদনের সময় জায়গা করে দিয়েছে বার্তা উৎপাদনের সময়কে। শীঘ্রই মিডিয়া বার্তা কক্ষ মিথ্যা বর্ণনা পরিত্যাগ করে এবং সাংবাদিকের পরিবর্তে নাট্য পরিচালক নিয়োগ করা শুরু করে। যেহেতু মার্কিন প্রদর্শনী ব্যবসা (শো-বিজনেস) ক্রমে ক্রমে ভয়ংকর এবং যুদ্ধ-সদৃশ হয়ে ওঠছে, মার্কিন যুদ্ধ ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠছে প্রদর্শনী ব্যবসার (শো-বিজনেস) মত, সেহেতু কতগুলো আকর্ষণীয় পরিবর্তন ঘটছে। ডিজাইনার যিনি কাতারে ২৫০,০০০ ডলার মূল্যমানের সেট তৈরী করেছেন যেখান থেকে জেনারেল টমী ফ্রান্ক Operation Shock and Awe নিউজ কভারেজ এর মঞ্চ-আয়োজন, তা ডিজনী, এমজিএম এবং গুড মর্নিং আমেরিকার জন্যও সেট নির্মান করেছে।

এটা সত্যি নিষ্ঠুর নিয়তি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে মতামতের স্বাধীনতার সর্বাপেক্ষা উৎসাহী এবং ঘোষিত রক্ষাকরী এবং (অতি সম্প্রতি নাগাদ) যার এই স্বাধীনতা রক্ষায় রয়েছে পূর্ণাঙ্গ আইন, এতটাই সীমিত জায়গা জুড়ে আছে যেখানে স্বাধীনতা প্রকাশ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র মতামতের স্বাধীনতার আইনগত এবং ধারণাগত প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত হৈ চৈ অদ্ভুত পেঁচানো পথে আড়াল করে ফেলে স্বাধীনতার প্রকৃত প্রয়োগের সম্ভবনার দ্রুত ভাঙ্গন প্রক্রিয়াকে। AOL,-Time Warner Disney, Viacom, News Corporations -এর মত কতগুলো বৃহৎ কর্পোরেশন বহুলাংশে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ এবং বিনোদন শিল্প নিয়ন্ত্রণ করে। এসব কর্পোরেশনের প্রত্যেকের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে টিভি ষ্টেশন, ফিল্ম ষ্টুডিও, রেকর্ড কোম্পানী এবং প্রকাশনা সংস্থাসমূহ। এর বাইরে যাওয়ার দ্বার কার্যকর ভাবে বন্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া সাম্রাজ্য একটি গোষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। কলিন পাওয়েলের পুত্র ফেডারেল কমুনিকেশনের চেয়ারম্যান মাইকেল পাওয়েল কমুনিকেশন শিল্পের আরো বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রস্তাব রাখেন যা এই নিয়ন্ত্রণ আরো সুদৃঢ় করবে। সুতরাং এখানেই বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্র পরিচালিত হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি কর্তৃক যিনি আইনসম্মতভাবে নির্বাচিত হননি। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্ট তাকে এই পদে আসীন করেছে। মার্কিন জনগণ এই ভেজাল রাষ্ট্রপতি পদের জন্য কত মূল্য প্রদান করেছেন?

বুশের শাসনের তিন বৎসরের মেয়াদে আমেরিকান অর্থনীতিতে দু মিলিয়নের অধিক সংখ্যক লোক চাকরি হারায়। বৈদেশিক সামরিক ব্যয়, ধনীদেরকে প্রদত্ত কর্পোরেট কল্যাণ এবং ট্যাক্স সুবিধা মার্কিন শিক্ষা ব্যবস্থাকে আর্থিক সংকটে ফেলে। National Council of State Legislatures -এর জরিপ মতে, ২০০২ সালে রাজ্যগুলো পাবলিক সার্ভিস, স্বাস্থ্য খাত, কল্যাণ সুবিধা এবং শিক্ষা খাতে ৪৯ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ হ্রাস করে। এ বৎসরও তারা আরো ২৫.৭ বিলিয়ন ডলার হ্রাসের পরিকল্পনা করেছে। সর্বমোট ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ইরাক যুদ্ধের জন্য কংগ্রেসের নিকট বুশের প্রাথমিক বাজেট চাহিদা ছিল ৮০ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং যুদ্ধের জন্য অর্থের যোগানদাতা কে? দরিদ্র মার্কিনীরা, ছাত্ররা, বেকাররা, মায়েরা, হাসপাতাল এবং গৃহে শুশ্রষারত রোগীরা, শিক্ষকরা এবং স্বাস্থ্যকমীরা এবং প্রকৃতপক্ষে কারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল?

পুনরায় বলতে হয়, দরিদ্র মার্কিনীরা। ইরাকের তপ্ত মরুতে যে সৈন্যরা জ্বলছিল, তারা ধনীদের সন্তান-সম্ভতি ছিল না। কংগ্রেস এবং সিনেটের সকল প্রতিনিধিগণের একজন মাত্র সন্তান ইরাক যুদ্ধে অংশ নেয়। ফেডারেল পরিসংখ্যানে দৃষ্ট হয় যে আফ্রিকান-আমেরিকান সমন্বয়ে গঠিত হয় সমগ্র সশস্ত্রবাহিনীর শতকরা ২১ ভাগ এবং সেনাবাহিনীর শতকরা ২৯ ভাগ। তারা সাধারন জনসংখ্যার মাত্র শতকারা ১২ ভাগ। অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে সেনাবাহিনীতে এবং কারাগারে উচ্চ হারে আফ্রিকান-আমেরিকান প্রতিনিধিত্ব দুঃখজনক নিশ্চয়ই। সম্ভবত আমাদের একটা ইতিবাচক দৃষ্টি দেয়া উচিত এবং বিষয়টির প্রতি কার্যকর ভাবে পদক্ষেপ নেয়া সমীচীন। চরম দুবৃত্তিপূর্ণ কাজের অভিযোগে প্রায় ৪ মিলিয়ন মার্কিনী (জনসংখ্যার শতকরা ২ ভাগ) ভোটাধিকারহারা; যার ১.৪ মিলিয়ন আফ্রিকান-আমেরিকান। অর্থাৎ ভোটের বয়সের সকল কৃঞ্চাঙ্গ জনগণের শতকরা ১৩ ভাগ ভোটাদানের অধিকার বঞ্চিত।

আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য মৃত্যুতে হ্যাঁ-সূচক কাজের সুযোগ থাকে। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের গবেষণায় দৃষ্ট হয় চীন, ভারতের কেরালা, শ্রীলংকা অথবা কোষ্টারিকায় জন্মগ্রহণকারী লোকদের তুলনায় দলীয়ভাবে আফ্রিকান-আমেরিকানদের গড় আয়ুষ্কাল কম বা নিম্ন মানের। হার্লেমে আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষদের তুলনায় বাংলাদেশী পুরুষদের ৪০ বৎসর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেশী।

এ বৎসর মার্টিন লুথার কিং-এর ৭৪তম জন্ম দিবসে প্রেসিডেন্ট বুশ আনুষ্ঠানিক ভাবে কৃষ্ণাঙ্গ এবং ল্যাটিনীদের পক্ষে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যাঁ-সূচক কর্মসূচী ঘোষণা করেন। তিনি এটাকে বিভাজন মূলক, মন্দ এবং অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করেন। জর্জ বুশকে নির্বাচিত করার জন্য ফ্লোরিডায় কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটার তালিকাচ্যুত করার সফল প্রচেষ্টা অবশ্যই মন্দ বা অসাংবিধানিক ছিল না। সুতরাং আমরা জানি, কে যুদ্ধের অর্থ জোগায়, আমরা জনি কে যুদ্ধ করে। কিন্তু যুদ্ধ থেকে কে সুবিধা প্রাপ্ত হয়? কে একশত বিলিয়ন ডলার মূল্যামানের পুনঃর্গঠন চুক্তি পেতে যাচ্ছে? এটা কি দরিদ্র পীড়িত এবং বেকার মার্কিনীরা পাচ্ছেন? একক মার্কিন মায়েরা পাচ্ছেন? অথবা আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ এবং ল্যাটিন সংখ্যা লঘুরা?

জর্জ বুশ আমাদেরকে আশ্বস্ত করেন যে, ইরাকী তেল ইরাকী জনগণকে ফেরত দেয়ার জন্যই ‘অপারেশন ইরাকী ফ্রীডম’। অর্থাৎ বেকটেল, সেভরণ, হ্যালিবার্টন-এর মত কর্পোরেট বহুজাতিকদের মাধ্যমে ইরাকী তেল ইরাকী জনগণকে ফেরত দেয়া। পুনরায় এটা হলো ছোট একটি বৃত্ত। একটি কর্পোরেট, সামরিক এবং সরকারী নেতৃত্বকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

এটা বিবেচনা করুনঃ ডিফেন্স পলিসি বোর্ড সরকার নিয়োজিত গ্রুপ যা পেন্টাগণকে ডিফেন্স পলিসি সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান করে থাকে। বোর্ডের সদস্যগণ প্রতিরক্ষা বিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারী কর্তক নিয়োগপ্রাপ্ত এবং ডোনাল্ড রামসফেল্ড কর্তৃক অনুমোদিত হন। এর সভা গুলো শ্রেণী বিন্যাসিত। জনগণের বাছাইয়ের জন্য কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ওয়াশিংটন ভিত্তিক Centre for Integrity দেখতে পায় যে ডিফেন্স পলিসি বোর্ড-এর ৩০ সদস্যের মধ্যে ৯ জনই কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত যাদেরকে ২০০১ এবং ২০০২ বৎসরের মধ্যে ৭৬ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের প্রতিরক্ষা চুক্তির কাজ প্রদান করা হয়। যাদের একজন নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্পোঃ জেনারেল, যিনি বিশাল আন্তর্জাতিক সংস্থা বেকটেলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। কোম্পানীর চেয়ারম্যান রিলে বেকটেল প্রেসিডেন্টের এক্সপোর্ট কাউন্সিলেরও অন্তর্ভুক্ত। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বেকটেল গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত জর্জ শুলজ হলেন ইরাক মুক্ত করার লক্ষ্যে গঠিত কমিটির উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান। স্বার্থের দ্বন্দ্বের উদ্ভবের ব্যাপারে উদ্বিঘœ কিনা এই মর্মে নিউইয়র্ব টাইমস কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেন ‘আমি জানি না যে বেকটেল তা থেকে বিশেষ ভাবে উপকৃত হবে। কিন্তু যদি সেখানে করার মত কাজ থাকে, তবে বেকটেলই তা করার উপযুক্ত কোম্পানী’। বেকটেলকে ইরাকে ৬৮০ মিলিয়ন ডলারের পুনর্গঠন চুক্তি প্রদান করা হয়েছে। সেন্টার ফর রিসপনসিভ পলিটিক্স-এর মতে বেকটেল ১৯৯৯-২০০০ সালের রিপাবলিকান প্রচারের অভিযনে ১.৩ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।

১৩ অক্টোবর ২০০১ এ পাস হয় ইউএসএ প্যাট্রিয়ট এ্যাক্ট যার আদলে বিশ্বব্যাপী দেশসমূহে একই ধরনের সন্ত্রাস বিরোধী বিল গৃহীত হয়। এই আইনটি প্রতিনিধি পরিষদ হাউজ অব ডিপ্রেজেটীয় ভঙ্গ কর্তৃক ৩৩৭-৭৯ সংখ্যা গরিষ্ঠ ভোটে পাস হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস অনুসারে, অনেক আইনপ্রণেতা বলেন, আইনটির উপর বিতর্ক কিংবা এমন কি আইনটি পড়াও ছিল অসম্ভব।

Patriot Act পদ্ধতিগত স্বয়ংক্রিয় নজরদারীর সূচনা করলো। এটা ফোন এবং কম্পিউটার মনিটর করায় এর এমন ভাবে লোকজনের উপর গোয়েন্দাগিরির সুযোগ করে দিল সরকারকে যা কয়েক বৎসর পুর্বে ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এটা এফবিয়াইকে সকল সার্কুলেশন ক্রয় এবং লাইব্রেরী ব্যবহার কারীদের অন্যান্য রেকর্ডপত্র এবং বুক ষ্টোর ক্রেতাদেরকে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের অংশ সন্দেহে আটক করার ক্ষমতা প্রদান করে।

এই আইন মতামত এবং দুস্কর্মের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীরটা ম্লান করে ফেলে যার ফলে আইন লংঘনকারী হিসাবে নাগরিক অবাধ্যতার অভিযোগের অজুহাত সৃষ্টির সুযোগ তৈরী হয়। ইতোমধ্যে দেশে দেশে শত শত লোককে ‘আইন অমান্যকারী’ হিসাবে অনির্দষ্ট মেয়াদে আটক করা হচ্ছে। ভারতে আটকের সংখ্যা হাজার হাজার, আর ইসরাইলে ৫,০০০ ফিলিস্তিনী রয়েছে কারাঅন্তরালে। অবশ্য অনিবাসীদের আদৌ কোন অধিকার নেই। তারা শুধু নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে যেমন চিলিতে হতো ওয়াশিংটনের পুরানো মিত্র। জেনারেল পিনোশের আমলে। এক হাজারের অধিক সংখ্যক লোককে আটক করা হয়েছে যাদের বেশীর ভাগই মুসলমান অথবা মধ্যপ্রাচ্য উদ্ভব, যাদের কেউ কেউ অবৈধ অভিবাসীও বটে। যুদ্ধের প্রকৃত আর্থিক মূল্য বহন করা ছাড়াও মার্কিন জনগণ আজ ইরাকের মুক্তির নামে নিজেদের স্বাধীনতাকে আত্মাহুতি দিচ্ছে। নিজ দেশে খাঁটি গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে বিশ্বের অপরাপর দেশে ‘নব্য গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে সাধারণ মার্কিন নাগরিকদেরকে।

ইতোমধ্যেই মুক্তির নামে ইরাককে পরিণত করা হয়েছে ধ্বংস স্তুপে। (অথবা তারা কি এর মানে চিরমুক্তি বোঝাচ্ছেন?) ওয়াল ষ্ট্রীট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বুশ প্রশাসন মার্কিন আদলে ইরাকের অর্থনীতি পুনর্নিমাণের পরিকল্পনা করছে। ইরাকের সংবিধান পুনর্লিখিত হচ্ছে। তৈরী হচ্ছে বাণিজ্য আইন, কর আইন, এবং মেধা সম্পদ আইন এমন ভাবে যাতে এটা মার্কিন ধাঁচের পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়।

মার্কিন এজেন্সী ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইতোমধ্যে মার্কিন কোম্পানী সমূহের নিকট হতে ইরকে সড়ক-কাঠামো নির্মাণ, পানি সরবরাহ, পাঠ্যবই বিতরণ এবং সেলফোন নেটওয়ার্ক কজে অংশ নেয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে।


 

Saturday, January 27, 2024

সদ্য সমাপ্ত ও আংশিক বিতর্কিত ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে

 

সম্প্রতি ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সংঘটিত আংশিক বিতর্কিত ১২ তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে আমার মতামত এরকম, দেশের পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির ফাঁকা বক্তব্য শুনলে আফসোস হয়। তারা বলছে দেশে একটা ডামি নির্বাচন হইছে অথচ ওদিকে নতুন মন্ত্রীসভা শপথ নিচ্ছে। তারা বলছেন জনগণ এই নির্বাচন বর্জন করেছেন। অথচ কত পারসেন্ট ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে নির্বাচন সঠিক হয়েছে বলে গণ্য হওয়া উচিত তা নিয়ে কিছু বলছেন না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ৪১.৮ শতাংশ লোক ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে বলেছেন, সেই বক্তব্যকেও তারা বানোয়াট বলছেন। বৈদেশিক পর্যবেক্ষণ দলের বক্তব্যও তাদের কাছে সরকারের মদত পুষ্ট বৈদেশিক পর্যবেক্ষক দল বলে আখ্যা দিচ্ছেন। যখন সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন সংবিধানে বাদ দেয়া হলো তখন তারা জোর আন্দোলন করেন নি অথচ নির্বাচনের সময় এসে সংবিধান আবার সংশোধন করে নির্বাচন কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃ সহযোজনের দাবি জানাচ্ছেন। তাদের সমমনা দল গুলোর লিফলেট বিলি করে জনমত গঠনের সময় বহু আগেই পার হয়ে গেছে। শেষ সময়ে এসে এত হুলুস্থুল করে যে জনমত গঠন করা যায় না তা বুঝার মত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাদের থাকার কথা ছিল। কই এখন তো কোন অগ্নি সংযোগ, গাড়ি পোড়াও, রেল লাইন স্থান চ্যুতির ঘটনা ঘটছে না। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে অনধিকার প্রবেশ কি কার নির্দেশ ছারা কেউ করছে এখন বা কখনো করবে? পুলিশের উপর নির্যাতন সত্যেও তারা একটা গুলিও ছুড়েনি বরং উল্টা মার খেয়েছে। এগুলো সরকারই করে বিরোধী শক্তির উপর দোষ চাপিয়েছে, এরকম উদ্ভট বক্তব্যও তারা মানুষকে বিশ্বাস করতে বলছে আর কিছু মানুষ তা বিশ্বাস করে মজাও পাচ্ছে। রাজনৈতিক মতাদর্শে মতভেদ থাকতে পারে কিন্তু একেবারে এসপার (নর্থ পোল) কি ওসপার (সাউথ পোল) এত পার্থক্য কোন সভ্য দেশে থাকাটা শোভন দেখায় না। সমঝোতার মানে এই না যে, আমাকে চেয়ারম্যান না মানলে আমি সব বিষয়েরই বিরোধিতা করবো। দেশের জনগণ আগের চেয়ে শিক্ষিত, ভদ্র ও রাজনীতি সচেতন হয়েছে। তাদের যা খুশি বুঝাবেন তা তারা মেনে নিবে না। আমার মতে হ্যা-না ভোট হলে বিরোধী শক্তি হালে পানি পাবে না। জনমত এখনও বলে যদি বিরোধী দল নির্বাচনে আসতো তা হলে তারা হয়তো জয়ী হতেও পারতো। বিরোধী শক্তির নির্বাচন বিষয়ে এক কথায় না বলে দেয়াটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। দেশের সংবিধানে যা থাকবে তাই আইন আর তা মেনেই নির্বাচন হতে হবে। এটাই ভদ্র শিক্ষিত সমাজের চাওয়া। এটা কোন দলিয় মতের চাওয়া নয় বলেই আমি মনে করি। স্বাধীন ও দল নিরপেক্ষ নাগরিক সকলের এটা চাওয়া হওয়াটাই যুক্তি যুক্ত। উপরোক্ত আমার এই বক্তব্য কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয় আর সরকার বিরোধী দলের সিদ্ধান্ত গুলোর সাথে আমি একমত হতে পারি নি যেটা আমার সুচিন্তিত নিরপেক্ষ মতামত। 

এই মতামত একটি সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ করার সাথে সাথে প্রতিবাদ আসলো এটা নাকি নিরপেক্ষ মতামত হয় নি। আমি প্রশ্ন করলাম কি বললে নিরপেক্ষ হতো? যারা সঠিক কাজ করছে আর যারা বেঠিক কাজ করছে বলে আমার মনে হয়েছে তার প্রেক্ষিতে আমার উপরোক্ত বক্তব্য প্রকাশ করেছি, এটাকে পক্ষপাত দুষ্ট বলা যায় তখনি যখন তা অযৌক্তিক হবে কিন্তু আমার বক্তব্যের পক্ষে আমি আমার যুক্তি গুলোও তো লিখে দিয়েছি। যারা বেঠিক কাজ করেছে তারা কি করলে ঠিক হতো তার ইঙ্গিতও আমি প্রদান করেছি আমার লেখাতে। তা হলে তাকে পক্ষপাত মূলক কেন বলা হচ্ছে। যারা পক্ষপাত দুষ্ট মানুষিকতা পোষণ করে তাদের কাছে তা মনে হতেই পারে। আমাদের কালচারটাই এমন হয়ে গেছে যে, হয় তুমি আমার পক্ষে না হয় বিপক্ষে, মধ্যবর্তী কোন স্থান যেন রাখা হয়নি। এই মানুষিকতাটাই রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপে প্রকাশ পায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এ পর্যন্ত ৫২ বছরে আমাদের সংবিধান ২১ বার সংশোধিত হয়েছে আর সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনটি নিয়ে ১২ টি সংসদ গঠিত হয়েছে । বিষয়টা সবারই জানা কিন্তু স্পষ্ট করে সত্য বার বার বলা যায় তাতে করো বিরক্তির কিছু নাই বলে আমি মনে করি। 

১৩ই জানুয়ারি, ২০২৪ এর জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতে বলা হয়েছে “এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের যে বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে, তা হলো কম ভোটার উপস্থিতি। আগের যেকোনো সময়ের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে এবার সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের বর্জনের মুখে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ যে ‘একতরফা’ নির্বাচন করেছিল, নির্বাচন কমিশনের হিসাবে সেই নির্বাচনেও ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ২০১৪ সালের তুলনায় এবার কিছুটা বেশি ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, এবার ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোটের এই হিসাব ধরা হলেও প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ভোট দেননি। এর মানে বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী ভোটে আগ্রহ দেখায়নি।” https://www.prothomalo.com/politics/n88s11u6ww জনপ্রিয় পত্রিকাতে প্রকাশিত এই তথ্য থেকে সত্যটা পাওয়া গেলেও এর পিছনের কারটার কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। আমরা যারা অনেকের কথা শুনি ও বুঝি তারা প্রকৃত সত্যটা ধরতে পরি মনে হয়। নির্বাচনের আগ দিয়ে বেশির ভাগ লোকের মুখে ছিল, নির্বাচন তো হয়েই গেছে। বিএনপি একটা বড় দল তারা যখন নির্বাচনে আসেনি তখন মাঠ ফাঁকা পেয়ে আওয়ামেলিগকে পিছনে ফেলতে পারে এমন শক্তি আর মাঠে রইলো কই? সবাই ধরে নিয়েছিল ক্ষমতাসীন দলই নির্বাচনে জিতে যাবে আর তা হয়েছেও তাই। বিএনপি নির্বাচনে না এসে মাঠ কেন ছেড়ে দিল? তাদের যুক্তি এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা নিরপেক্ষ হবে না। তারা গণ অভ্যুত্থানের আশা করেছিল কিন্তু জনগণ সাড়া দেয় নি তা স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে। প্রচার পত্র বিলি করে জনমত গঠন করেও কোন লাভ হয়নি। বরং তৃণমূল বিএনপি নামে নতুন আরেকটি দল বিএনপি থেকে বের হয়ে এসেছে। জনগণের মধ্যে ভোটের প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে যখন মাঠে কেবল একটাই দল আছে আর তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম দলটি নির্বাচন বর্জন করেছে। নির্বাচন বর্জন করে যদি বিএনপি দেখাতে পারতো যে যারা নির্বাচন করেছে তারা ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারছে না বা দেশের লোকজন তাদের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমে এসেছে তা হলেও কথা ছিল কিন্তু তা তো বাস্তবে দেখা গেল না। এতকিছুর পরও বিএনপির নেতারা বলছে ডামি নির্বাচন হয়েছে, ডামি সংসদ বসেছে, ডামি সরকার গঠন করেছে। কই তাদের কথায় তো জনগণ সাড়া দিচ্ছে না। বিএনপি’র এতগুলো নেতা কারাবন্দী তাদের মুক্তি দাবিতেতো কোন আন্দোলনও তারা করে দেখাতে পারছে না। দলটির নেতৃত্ব স্থানীয়রা যে সকল কথা মিডিয়াতে বলছে তা এখন হাস্যকর শোনাচ্ছে। ঢাল নাই, তলোয়ার নাই নিধিরাম সরদার এর মত অবস্থা তাদের। গলাবাজি করা ছাড়া তারা আর কিছুই করতে পারছে বলে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। কোন একটি বড় দল নির্বাচনে না আসলেই যে সেটা নিরপেক্ষ হবে না এমন কথা কিন্তু আমাদের সংবিধানে নেই। কত পারসেন্ট জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে সেই ভোট গ্রহণযোগ্য হবে আর তার নিচে হলে পুন নির্বাচন দিতে হবে এরকম কথা নিশ্চয়ই সংবিধানে থাকার কথা। যদি তাই থেকে থাকে তবে ৪০.৮% ভোটার ভোট দিলে যদি তা গ্রহণযোগ্য হয় তবে কারো কিছু বলার থাকে না। এর বিরোধিতা করলে তো সে সংবিধানের আইনের বিপক্ষে চলে গিয়ে দেশদ্রোহী হয়ে যাবে।

যদি বিএনপি মত পরিবর্তন করে ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে আসতো তা হলে হতে পারতো যে তারা দুই তৃতীয়াংশ ভোট না পেলেও আওয়ামীলীগকে সংখ্যা গরিষ্ঠ হতে নাও দিতে পারতো। সেক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ও জাতীয় পার্টির সাথে কোয়ালিশনে এসে সরকার গঠন করতে পারতো। বিএনপি বলে জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামীলীগ একটা সমঝোতায় এসেছে এই ভাবে যে, কিছু কিছু সিটের নির্বাচনী এলাকায় তারা তাদের প্রার্থী সরায়ে নিয়েছে জাতীয় পার্টিকে জিতিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে বিএনপিও কৌশল অবলম্বন করে ভিন্ন কোন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে পারতো। পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো হয়নি বলে পরীক্ষাই দিব না এই মনোভঙ্গিটা আমার পছন্দ হয়নি। তারা রাজপথে আছে তা হলে মাঠে কেন খেলবে না। মাঠে খেলতে তাদের ভয় কিসের? তাদের এক দাবি ক্ষমতাসীনকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে, কিন্তু তা তো সংবিধান পরিপন্থী হয়ে যায়। এই অবস্থায় তো সংবিধানে সংশোধনীয় আনা যাবেনা। বিপক্ষকে মাঠ ছেড়ে দিলে তো তারা জিতবেই, আর সেটাই তো স্বাভাবিক। এখন তারা না পারছে সইতে না পারছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। পরাজয় আগেই মেনে নিয়ে দলটি আজ অস্তিত্বর সংকটে পড়ে গেছে। রাজনীতিতে মার্সি বলে কিছু নাই। বিজিত দল পরাজিত দলকে চরম আঘাতে ঘায়েল করতে চাইবেই, এটাই রাজনীতি বা রাজার নিতি কিংবা নিতির রাজা যাই বলেন না কেন। একটা আদর্শ অন্য আদর্শকে প্রভাব বিস্তার করতে দিবে কেন?

কেউ কি এই নির্বাচনকে অস্বীকার করতে পারবে? এই নির্বাচন কি ঐতিহাসিক একটি ঘটনা হয়ে যায়নি? কেউ এটাকে ডামি নির্বাচন বলছে, তার মানে তারা কিন্তু মেনে নিয়েছে নির্বাচনটি হয়েছে যদিওবা তাদের দৃষ্টিতে এটা একটি পাতানো খেলা বৈ আর কিছু নয় কিন্তু নির্বাচন যে হয়েছে তা তারা অস্বীকার করতে পারে নাই।  আমার এই বক্তব্য কোন বিএনপি সমর্থক পড়লে বলবে নিশ্চয়ই এই লোক আওয়ামে লিগ সমর্থক তা না হলে কেন কেবল আওয়ামে লিগের পক্ষে কথা বলছে। তাকে আমার বলার আছে এই যে, আমি এমন কার চাকুরী করি না যাতে কোন দলকে তেল দেওয়ার বা তোয়াজ করার প্রয়োজন হয়।  আমি কোন রাজনৈতিক দলের কোন সাংগঠনিক কিংবা সমর্থক গোষ্ঠীর কোন সদস্যও নই এমনকি তাদের কারো সাথে জড়িতও নই। আমি যা দেখছি ও বুঝছি তার ভিত্তিতে আমার যা মনে হয়েছে তাই লিখছি। আমার মন্তব্যগুলো পক্ষপাত দুষ্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি বরং বিএনপিকে রাজনৈতিক ভাবে আরো কৌশলী ও পারদর্শী দেখলে খুশি হতাম কিন্তু তাদের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তগুলো দেখে আমি হতাশ হয়েছি। বিএনপিতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব আমাকে কষ্ট দিয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এর প্রতিষ্ঠিত একটি দলের এরকম রাজনৈতিক দৈউলিয়াত্ব দেখে আমি যার পর নাই নিরাশ হয়েছি। যারা নিজের ঘামে গন্ধ পায় না বা নিজের ভুল গুলো সনাক্ত করে তা শুধরাতে পারে না তারা উন্নত হবে কি করে। বোকার মত একই ভুলের চক্রে পাক খেতে থাকে। আমার মতে বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাসের প্রধান কারণ তাদের তরুণ নেতৃত্বের পূর্বের অপকর্মগুলো। যে নেতা দেশকে ও দেশের জনগণকে ভালোবাসে ও তাদের উন্নতি দেখতে চায় সে বিদেশে বসে দেশিয় রাজনীতি পরিচালনা করছে আর ভাবছে দেশে তার জনপ্রিয়তা টিকে আছে তবে বলতে হবে তার চিন্তা ভাবনায় মারাত্মক ত্রুটি আছে। নেলসন মেন্ডেলা বহু বছর জেল খেটে তবে তার মত প্রতিষ্ঠা করেছে তার দেশে। কোন আদর্শ ছাড়া কোন রাজনৈতিক দল টিকে থাকতে পারে না। ”একটি রাজনৈতিক দলের চারটি জিনিস প্রয়োজন, ১) নেতৃত্ব ২) মেনিফেস্ট বা আদর্শ ৩) নিঃস্বার্থ কর্মী ৪) সংগঠন“ এই বক্তব্যটি ২১ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে দৈনিক বাংলা মোড়ের কর্মসংস্থান ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের প্রবেশ পথের ডিজিটাল মারকিউ বা চলমান লেখা থেকে সংগৃহীত। আলোচ্য বিরোধীদলটির জনগণকে এ্যাডরেস করার ইস্যুটি ঠিক নাই। তারা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে ইস্যু বানাতে পারতো, কিংবা তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে গন হারে মামলা নিয়ে ইস্যু বানাতে পারতো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়াকে ইস্যু বানাতে পারতো। তা না করে ক্ষমতাসীন দল যে ভাবে তাদের নাচাচ্ছে তারা তাদের উঠানে সেইভাবে নাচছে বলে আমার মনে হয়েছে। এটাকে আমি রাজনৈতিক পরাজয় বলবো। দলটি জনগণের সামনে কোন স্বপ্নও দ্বার করাতে পারছে না। আওয়ামীলীগ দেশের জনগণকে ৪২ সালের মধ্যে স্মার্ট দেশ বানানোর স্বপ্ন দেখিয়েছে, বিপরীত পক্ষে বিএনপি কি কোন স্বপ্নর কথা বলেছে? নেতা সেই হতে পারে যে স্বপ্নও দেখাবে ও সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে দেখাবে। যা আওয়ামীলীগ সরকার করেছে ইতোমধ্যেই। পদ্মা ব্রিজের স্বপ্ন দেখিয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে। মেট্রো রেলের স্বপ্ন দেখিয়েছে আর জনগণ তার সুবিধা পাচ্ছে। এরকম আরো আছে যা ক্ষমতাসীন দলের বিগত সময়কালের অর্জন। আমি বুঝি না এত গুলো প্রকল্পর সফল বাস্তবায়ন করা স্বত্বেও কেন জনগণ তাকে সমর্থন দিবে না বলে অনেকে মনে করে। বহু লোক আছে যারা এত কিছু বাস্তবে দেখেও এই দলটাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। খুঁজে খুঁজে এর দোষত্রুটি বের করে বিতর্ক করে। এরা আমার দৃষ্টিতে নিরপেক্ষ নয়। দলের মার্কা দেখে ও কোন দলের সাথে ইমোশনালি যুক্ত হয়ে অন্ধভাবে তার সমর্থন দেয় কিংবা তাদের স্বার্থ জড়িত বলে সমর্থন দেয়। আমরা যেমন যারা ভালো করবে তাদের ভালো আর যারা খারাপ করবে তাদের খারাপ বলবো এরা তেমন নয়। এরা ভালো হোক মন্দ হোক কোন একটা দলের পক্ষ নিয়ে কথা বলবে। এই সব লোকেরাই মূলত দেশের জন্য ক্ষতিকারক। আমি এই মানুষিকতার ঘোর বিরোধী আর এদের আমি খানিকক্ষণ কথা বললেই ধরতে পারি। আমাদের দেশে খুব কম লোক আছে বলে আমার মনে হয় যারা নিরপেক্ষ বিচার করার সামর্থ্য রাখে। বেশির ভাগ লোকজনই হুজুগে মাতে, যার আরেক মানে ইমোশনালি জাজমেন্ট করে। রেশনাল নিরপেক্ষ বিচার বোধ সম্পন্ন মানুষরা তাই সংখ্যা লঘিষ্ঠ হওয়ায় চুপ করে থাকে, কাউকে কিছু বলে না, তারা ভোটও দিতে চায় না। আমার মতে এই ১২ তম সংসদ নির্বাচনের ব্যালটে একটা ঘর ফাঁকা রাখা উচিত ছিল যাতে কোন মার্কা নাই। ওটাতে নামের জায়গায় লেখা থাকতো আমি যারা দাঁড়িয়েছে তাদের কাউকেই ভোট দিতে চাই না। এই ঘরটা থাকলে কত পারসেন্ট এই নির্বাচনকে বর্জন করেছে তা জানা যেত। আসলে দেশের জনগণের মধ্যে নতুন কোন কিছু চিন্তা করার অভ্যাস নাই, তারা গতানুগতিক চিন্তা ভাবনাতেই নিমজ্জিত থাকতে চায়। বিএনপিও এই প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারতো নির্বাচন কমিশনকে।

বিএনপি’র রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দৈউলিয়াত্ব প্রমাণ করে তারা আর শক্তিশালী বিরোধী শক্তি নেই। জন বিচ্ছিন্ন তো হয়েছেই তার উপর তারা কোন জনগুরত্বপূর্ণ ইস্যুই দার করাতে পারেনি। জনগণকে কোন স্বপ্নও দেখাতে পারেনি । তাদের নেতাদের এখনকার বক্তব্যগুলো হাস্যকর। অপরপক্ষে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা গ্রহণ করে সরকার হিসেবে আগামী ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে রাষ্ট্রদূতরাও তাদের শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে। বিএনপির এই শোচনীয় পরাজয় যাতে জনগণ বা তাদের সমর্থকরা বুঝতে না পারে তাই একের পর এক ফাঁকা বুলি বলে যাচ্ছে তাদের নেতারা বিভিন্ন জনসভার আয়োজন করে। আমেরিকা যখন ইরাকে তার সেনা বহর ঢুকিয়ে দিচ্ছে তখন সংবাদ মাধ্যমে ইরাকী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নানা রকম বক্তব্য দিচ্ছিল, বলছিল ওরা সাপের মত ঢুকে গেছে, এবার ওদের মাথাটা কেটে দিব, এই সব। তার পর যখন মার্কিন সামরিক বাহিনী বাগদাদ দখল করে সাদ্দামের মূর্তি ভেঙ্গে দিল তখন সেই পররাষ্ট্র মন্ত্রীর আর হদিস পাওয়া গেল না। বুঝা গেল সে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। সাদ্দামকে মাটির নিচের এক গর্ত থেকে তুলে এনে ফাঁসি দিল আমেরিকা। আমেরিকার ইরাক দখলের যুদ্ধটা আমি সংবাদ মাধ্যমে মুভি দেখার মত করে দেখেছি। প্রসঙ্গটা এই কারণে আনলাম যে, আগেও আমি প্রভাবশালী শক্তির পরাজয় দেখেছি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তির হাতে। আমার জীবনে নিজের দেশের একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের এতটা অধঃপতন দেখতে হবে কখনও ভাবি নাই। নতুন অভিজ্ঞতা হলো, চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে, আমার বলার কিছু ছিল না, গনটা দিয়ে তাই শেষ করতে হচ্ছে।

সম্পাদনা ও উন্নয়ন ইতিহাসঃ ১২জানুয়ারী২০২৪> ১৫জানুয়ারী২০২৪> ২৩জনুয়ারী২০২৪> ২৫জনুয়ারী২০২৪>


আমার কাছে অনেকের প্রশ্ন
আপনি এত সময় কই পান? এত বড় বড় লেখা কখন লিখেন?

উত্তরঃ আমি একটা লেখা শুরু করার পর বিভিন্ন সময় তাতে আমার চিন্তা গুলো যোগ করে যখন দেখি তা অন্যর সাথে শেয়ার করার উপযুক্ত হয়েছে তখন তা ব্লগে প্রকাশ করে মতামত আশা করি। আমার লেখার উদ্দেশ্য মূলত অন্যর সাথে আমার চিন্তা ভাবনা গুলো শেয়ার করা। অনেকের প্রশ্ন লেখার জন্য এত সময় আমি পাই কই। একটু একটু করে লিখি অনেক দিন ধরে, কোন কোন লেখা বছর গড়ায়ে যায়। তাই আমার প্রতিটি লেখার নিচে কবে কবে লিখেছি তার একটা উন্নয়ন ও সম্পাদনা ইতিহাস যোগ করা থাকে। আমার এক বন্ধুর জানার আগ্রহে বলেছিলাম, কেউ আছে যারা দুইটা বল নিয়ে জাগল করতে পারে না আবার কেউ কেউ আছে যারা ৪, ৫ টা বল নিয়ে দুই হাতে জাগল করতে পারে। এটা তার বা যার যার দক্ষতার বিষয়। তাছাড়া বিন্দু বিন্দু করেই তো সিন্ধু হয়। অল্প অল্প করে লিখি একসময় তা অনেক হয়ে যায়, তখন সম্পাদনা করে কাট ছাট করে দরকারি কথা গুলো রেখে বাকি গুলো বাদ দিয়ে দেই। আজকের জমানায় এত এত সফটওয়ার আর অনলাইন টুল চলে আসছে যে আমরা অল্প সময়ে অনেক কাজ ও অনেকের সাথে যোগাযোগ করতে পারি তবে সেটা তখনই পারি যখন আমরা এই উন্নত টুলস গুলো সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে শিখি। সিস্টেমেটিক ভাবে কাজ করলে প্রচুর কাজ ও জটিল কাজ গুলো সহজে করা যায়। তাই যারা যত বেশি টুল ব্যবহার করতে শিখেছে তারা তত বেশি অন্যর চেয়ে বেশি কাজ করতে পারছে। আমি টুলস গুলো ব্যবহার করে অনেক কাজ দ্রুত করে ফেলতে শিখেছি তাই অন্য কারো কাছে মনে হতে পারে আমি হাইপার একটিভিটি শো করছি, প্রকৃত পক্ষে তা নয়, বরং ডিসিপ্লিন ও মেথড ব্যবহার করে আমি প্রচুর কাজ করছি স্বচ্ছন্দে ও সাবলীল ভাবেই। অন্যরা পারছে কি না সেটা আমার ধর্তব্যের বিষয় না।

আমি আমার লেখায় কম্পিউটার ব্যবহার করি আর আমার চিন্তাভাবনা গুলো লিখে রাখি বিভিন্ন সময়। আমার টাইপ স্পিড বাংলায় মিনিটে ৫০ শব্দ আর ইংরেজিতে ৫৫ শব্দ হওয়ায় প্রচুর কথা লিখতে পারি। টাইপ স্পিড বৃদ্ধির জন্য আমি মেভিস বেকন টিচার্স টাইপিং ভার্শন ফোর এর কাছে আমি ঋণী। বানান ভুল সংশোধনের জন্য আমি অভ্রর স্পেল চেকারের কাছে ঋণী। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড এর ট্রেক চেঞ্জ ফাংশন আমাকে আমার লেখা সম্পাদনা করতে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করে। একটা হাইলি কাস্টমাইজড কম্পিউটার ফাইল আমার লেখাগুলো সংরক্ষণ করে যেটাতে আমি ন্যাভিগেশন টুল ব্যবহার করে যখন যে লেখাটাতে আমার কথা সংযুক্ত করতে চাই তা করতে পারি। এ সব গুলো টুল ব্যবহার করে আমার মনের কথা আপনার কাছে পৌঁছে দেই এই প্রত্যাশায় যে আপনি তা পড়ে আপনার মূল্যবান মতামত দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করবেন। কিন্তু মানুষ পড়ে (কতগুলো হিট হলো তা আমি দেখতে পাই ব্লগের কন্ট্রোল প্যানেলে) কিন্তু কোন মন্তব্য করে না দেখে প্রায়শই হতাশ হই। বেশির ভাগ পাঠকই হয়তো এত বড় লেখা দেখে সুইপ ডাউন করে চোখ বুলায়ে যায়। পড়লে তো সে মন্তব্য করতো কিন্তু বাঙ্গালীদের মধ্যে ভারচুয়াল রিয়ালিটির কনসেপ্টটা এখনও পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি কিংবা তারা সহজে মন্তব্য করতে চায় না, যা আমার বিশ্বের অন্যান্য অংশে দেখি না। ওখানে প্রায়শই তাদের পোস্টে মিলিয়ন মিলিয়ন রিএকশন আসতে দেখা যায়।

আপনি রাজনৈতিক ভাবে কোন মতাদর্শের অনুসারী?

উত্তরঃ আমাদের সংবিধানের মূল নীতি মতে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্যে আমি নাই। এই কিছুদিন আগেও ছিলাম কিন্তু এখন এর চরম বিরোধিতা করি। প্রতিটি ধর্মের ছাতার  নিচেই অন্ধকার আর ঝর বৃষ্টির ভয়ে অনেকেই সেই ছাতা মাথায় দিয়ে আছে, আমি মনে করি ছাতা সরালেই তারা আলোকিত আকাশটা দেখতে পাবে। আমি ছাত্রাবস্থায় কিংবা চাকুরী জীবনে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না তবে ২০০২ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মুসলিম প্রফেশনালস ফোরাম এর সাথে যুক্ত ছিলাম। ওই সময় ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাই। ২০১৬ তে মায়ের মৃত্যুর পর ধর্মের উপর সকল আস্থা হারায়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও পরবর্তীতে প্রথা বিরুদ্ধ মানুষিকতায় চলে আসি। দেশের কোন রাজনৈতিক দলের সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই, কখন ছিলও না। যারা ভালো কাজ করে ও সঠিক পথে চলে আমি তাদের সমর্থন করি আমার লেখার মাধ্যমে তা প্রকাশও করি।

Sunday, January 21, 2024

শরিফ সারেং পরিবারের গল্প-২ : মোহাম্মদ মোস্তফা সার্জিল

 

আমার জন্ম ১৯৭২ এর ৫ই নভেম্বর ঢাকার হলী ফ্যামিলি হাসপাতালে। শহরে জন্ম ও বড় হওয়ায় গ্রাম কাহাকে বলে এখনও ভালো করে বুঝি না। ছোট বেলায় জ্ঞান চক্ষু হওয়ার পর ছিলাম যশোরের মোবারকগঞ্জের  কালীগঞ্জ সুগার মিলে, বাবা ওই মিলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ওটার কম্পাউন্ডে ব্রিক সোলিং রাস্তায় দৌড়ানোর ফ্লসব্যাক স্মৃতি আছে আমার মনে। বড় হয়ে জেনেছি আমার আদি প্রজন্ম বিক্রমপুর বর্তমানের মুন্সিগঞ্জ এর লৌহজং উপজেলার মৌছা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। যশোর থেকে বাবা চাকুরী নিয় চলে গেলেন লিবিয়ার  ইজিপশিয়ান বর্ডারের কাছের পোর্ট-সিটি তবরুখ শহরে ১৯৮০ সালে। ছয় মাস পর আমাকে ও মাকে নিয়ে গেলেন সেখানে। তাই যশোরের পর দৌড়েছি সাহারা মরুভূমির বালুর পার্কে। ওখানে আমার একটা সাইকেলও ছিল। খেলেছি ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী, ফিলিস্তিনি, তুর্কী, বুলগেরিয়ান বাচ্চাদের সাথে। ছোট বেলায় মোটা ছিলাম অনেক, ঢাকায় এসে বাবার সাথে প্রথম গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম এক বর্ষায়। কাদা কাহাকে বলে কত প্রকার ও কিকি তা আমি ওখানে যেয়ে প্রথম জেনেছি। একে তো বেঢপ মোটা ছিলাম তার উপর জীবনে কর্দমাক্ত রাস্তায় কখনো হাটি নাই, যতদূর মনে পরে ১৭ বার পা পিছলে আছার খেয়েছিলাম সেবার। সেই গ্রামের বাড়ী, আমার বাপ দাদা ১৪ পুরুষের ভিটা বাড়ী তা সম্পর্কে জানার শুরু ওই ১৭ বার আছার খাওয়ার পর থেকেই। এর পরে একবার ইকবাল ভাই একটা গাড়ি টেস্ট ড্রাইভে নিয়ে যাবে, সাথে নিয়ে গেল, প্রথম বাবা মা ছাড়া গ্রামের বাড়ি যাওয়া। সাথে ছিল পলাশ, শিমুল আপা, লাবনী আপা আর জলীল চাচী। আমি তখন ক্লাস ৭ কি ৮ এ পড়ি। একা একা বাবা মা ছাড়া গ্রামের বাড়িতে যাওয়া দারুণ রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা ছিল । বাড়িতে যেয়ে আমি একাই হাটতে হাটতে সেই ব্রিক সোলিং রাস্তা দিয়ে মাওয়া চৌরাস্তা পর্যন্ত এসেছিলাম পদ্মা নদী দেখতে। আমার ধারনা ছিল না যে মাওয়া চৌরাস্তা গ্রামের বাড়ি থেকে এত দুর হাটা পথ হতে পারে। ফিরার পথে রিক্সা করে ফিরলাম তার পর বাবা যে  নতুন কতগুলা ১০ টাকার নোট দিয়েছিলেন (যদি লাগে তার জন্য), রিকশাওয়ালা সেই নোট দেখে মহা খুশি, তার চোখ চক চক করছিল আর ও যা চাইলো আমি তাই দিয়ে দিয়েছিলাম। আমি যে সময়ের কথা বলছি তা আনুমানিক ১৯৮৫’র শেষ ভাগে। সময় কত দ্রুত ধাবমান তা আমরা বুঝতে পারি না। এর পর ১৯৮৯ এ বাবা চলে আসলেন লিবিয়া থেকে একেবারে, ১৯৮৩ তে মিরপুর শ্যাওড়াপাড়ায় কোন রকমে একতলা বাসাটা কমপ্লিট করে আমাকে আর আমার মাকে একা রেখে চলে গিয়েছিলেন। আমাকে ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুলে ভর্তি করে রেখে গিয়েছিলেন। ১৯৮৯ এ আমার এসএসসি পরীক্ষার বছরে সে একবারে লিবিয়ার পাট চুকিয়ে চলে আসার পর মাত্র ১ বছর কাছে পেয়েছিলাম তাকে তার পর সবাইকে ছেড়ে চিরতরে ১৯৯০ এর ১৫ই ডিসেম্বর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন পরপারে। 

 ১৯৮৯ এ ঢাকা এসে খুব অল্প সময়ে  শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িটা শেষ করেন বাবা, তাও দোতালার পর তৃতীয় ও চতুর্থ তলার একাংশ। বাকি টাকা দিয়ে নিটোল মটরস থেকে ১টা আর সেকেন্ড হেন্ড ১টা মোট দুটা ঢাকা-ভূয়াপুর ইন্টার ডিসট্রিক্ট মিনি বাস নামিয়েছিলেন যা ছিল একটা মস্ত বড় ভুল ব্যবসা বাবার জন্য। সারা জীবন চাকুরী করে হঠাৎ ব্যবসায় হাত দেওয়া তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে হয় না এখন থেকে পিছন ফিরে তাকালে। ওই সময় কালেই মিজান চাচাও একবারে চলে আসেন সৌদি আরব থেকে। রুহুল চাচাও যতদূর মনে পরে তার আগেই একেবারে সৌদি আরব থেকে ফেরত আসেন। আমি বহু দিন ভাবতাম জলিল চাচাই বোধ হয় আমার বাপ চাচাদের মধ্যে সব থেকে বড়, অনেক পরে ভ্রম ভাঙল যখন জানলাম বড় চাচার নাম বারেক চাচা, যাকে তার ছোট ভাইরা বাঘের মত ভয় পেতেন। একটা গল্প শুনেছিলাম, একবার বড় চাচা বাড়ি আসছেন শুনে ছোট ভাইরা যারা কেরম বোর্ড খেলছিল, এত ভয় পেয়েছিলেন যে অনেকে দৌরে পালিয়েছেন ,কেউ কেউ নাকি পুকুরে লাফ দিয়ে সাতরে পালিয়েছেন। আমাদের বাড়িটার নাম হয়ে গিয়েছিল কেরানী বাড়ী। দাদা রজব আলী ছিলেন তার বাবার এক মাত্র ছেলে (দুই বোন ছিল দাদার)। উনার বাবার নাম ছিল শরিফ সারেং। আমার বাবা সহ সব গুলো ভাই কাজির পাগলা অভয় চন্দ্র হাই স্কুলে পড়াশুনা করতেন। সন্ধ্যা হলেই বাড়ীর পাশ দিয়ে কেউ গেলে তারা বাসায় যে পড়াশুনা হচ্ছে তার শব্দ শুনতে পেত। একটা বাড়ি থেকে সব কটা ভাই পড়াশুনা করে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এরকম আমাদের গ্রামের বাড়ির আশপাশের ২০ পঁচিশটা বাড়িতে দেখা যাবে না। সব বাড়ির যেমন গল্প থাকে আমাদের দেশের বাড়ীরও অনেক গল্প আছে। গল্পগুলো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই এই লেখা। হৃদরোগ প্রবণ হওয়ায় আমাদের উপরের মানে চাচাদের মধ্যে শহীদ চাচা বাদে বাকি সবাই স্বর্গবাসী হয়ে গেছেন এরই মধ্যে, তাই এখন আমরাই চাচাত ভাই বোন রা ফ্রন্ট লাইনে চলে এসেছি। এই কারণেই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের অতীত ঐতিহ্য ও গল্প গুলো যাতে বংশ পরম্পরায় প্রবাহমান থাকে তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও আমাদের উপরই এখন বর্তায়। কবে আমরাও নাই হয়ে যাবো তারতো কোন ঠিক ঠিকানা নাই। তবে একটা বিষয় উল্লেখ যোগ্য এখানে, অতীত থেকে আমাদের এই প্রজন্মটা শিক্ষা নিয়ে টিকে গেছে। আমার বাপ চাচারা জানতেন না যে হৃদ রোগটা আমাদের বংশগত বা জেনেটিক একটা সমস্যা, যা আমরা জেনে গিয়েছিলাম, তাই আমরা মানে বাপ চাচাদের পরে আমাদের জেনারেশনের অনেকেই হৃদ রোগের হঠাত আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে যথা সময়ে চিকিৎসা নিতে পেরেছি ও টিকে গেছি। জলিল চাচার একমাত্র ছেলে পলাশ কর্ডিওলজিতে মাস্টার্স করায় ও অনেকের দেখভালও করতে পেরেছে। তবে ও নিজেও যে হৃদ রোগের আক্রমণের শিকার হবে তা আমি চিন্তাও করতে পারি নি। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিক্ষা ও বোধগম্যতা প্রবাহিত হয়। পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মগুলো উন্নত হয়। তাই আমি আমার ভাতিজা রাকিব, মুক্তি, আবির, আসিফ ওদের বলেই দিয়েছি যে তোমাদের আর সন্দেহের অবকাশ না রেখে ভেবে নেয়া উচিত তোমাদের জেনেটিক কোডে এই রোগের উপস্থিতি আছে, হয়ত কারো কারো ক্ষেত্রে এখনও সুপ্ত বা কার কার ক্ষেত্রে প্রকাশ পাবে বয়স কলে।

আমাদের বৃহত্তর পরিবারের কতগুলো ভালো বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে একটা হলো ভাইরা বড় থেকে ছোট পয়েন্ট অব অর্ডার মানতেন। বড়ভাইয়ের কথা ছোট ভাইরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। বাবার কাছে শুনেছি তারা সাত ভাই অন্য গ্রামের যে কাউকে চ্যালেঞ্জ করতো, যে কোন খেলায় তারা তাদের হারতে পারবে। আমাদের বাপ চাচারা সেকেন্ডারি ও হাইয়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে গ্রামে কিন্তু শহরে এসে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাড় ভাই বাদে বাকি সবাই একটা ধাক্কা খায়। গল্পটা মজার আর পরবর্তী প্রজন্মর জানা থাকা দরকার। আগেই বলেছি বড় চাচা খুব রাশভারী ছিলেন আর সবাই তাকে ভয় পেত। মিজান চাচার ছেলে মোহাম্মদ সেদিন রমনা পার্কে মর্নিং ওয়াক শেষে রিক্সায় বাসায় ফিরার সময় বলছিল, আমাদের বড় চাচা খুব জনপ্রিয় ছিলেন আর গ্রামের সবাই তাকে খুব সম্মান করতো। বাবার ঠিক বড় আরেক চাচা ছিলেন খলিল চাচা যিনি খুব অল্প বয়সে মারা যান, বাবা বলেছিলেন আমাকে। যা হোক বড় চাচা ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন আর ওখানে যখন হিন্দু-মুসলমান রায়ট হয় তখন এক হিন্দু পরিবার তাকে ছাদের পানির ট্যাংকে লুকায়ে রায়টের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। পরে তিনি দেশে এসে ঘোষণা করে কার পড়ালেখা করার দরকার নাই, উনি যে বিদ্যা শিখে এসেছেন মানে কার মেকানিক্স তা দিয়ে তার সব ভাই জীবন ভর ভালো মত চলতে পারবে, তিনি তা শিখায়ে দিবেন সবাইকে। এই কথায় জীবনে সব ক্লাসে প্রথম হওয়া জলিল চাচা বেকে বসেন আর আমার বাবা এস এম আব্দুর রহিম উনিও জলিল চাচাকে সমর্থন দেন, সেই সুবাদে জলিল চাচার ও আমার বাবার নেতৃত্বে তারা তাদের সব ছোট ভাইদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন ও সাজাহানপুর এলাকায় বসবাস শুরু করেন। ছোট ভাইদের পড়াশুনার খরচ চালাতেন তিন বড় ভাই, তথা জলিল চাচা, আমার বাবা এস এম আব্দুর রহিম ও শহিদ চাচা। তিন বড় ভাই দ্রুত পড়াশুনা শেষ করে চাকুরীতে ঢুকে পরেন টাকা উপার্যনের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জলিল চাচা পড়াশুনা শেষ করে চাকুরীতে ঢুকেন পিডব্লিউডিতে, আমার বাবা পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট এ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে চিনি শিল্প কর্পোরেশনে ঢুকে সুগার মিলে চাকুরীতে চলে যান, শহিদ চাচা যতদূর জানি জগন্নাথ থেকে পড়াশুনা শেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকুরীতে ঢুকেন। এই তিন ভাই তাদের ছোট তিন ভাই আলিম চাচাকে বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ান, মিজান চাচাকে ঢাকা মেডিকেল থেকে ডাক্তারি আর রুহুল চাচাকে জাহাঙ্গীর নগর থেকে স্টেটিসটিক্স এ পড়াশুনা করান। সবাই তাদের উপার্যন থেকে জলিল চাচাকে ভাইদের পড়া শুনার জন্য তাদের উপার্যন থেকে খরচ দিতেন। ওদিকে বড় চাচা তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে এখনকার পিজি হাসপাতালের নিকট একটা বড়সড় গাড়ির গ্যারেজ দিয়েছিলেন। তখনকার সময় শাহবাগ এর মত এলাকায় গড়ির গ্যারেজ মানে বিশাল একটা ব্যাপার ছিল। অরুণ ভাই, মুসা ভাই ও ইকবাল ভাই কার মেকানিক্স এর কাজ শিখেছেন ওখানেই। পরে যখন মিজান চাচা সৌদি আরবে চলে যান, উনি বোধ হয় অরুণ ভাই আর মুসা ভাইকে সৌদি আরবে নিয়ে গিয়েছিলেন। আলেয়া আপা আর দুলাভাই এর সাক্ষাত ওই গ্যারেজেই। আব্বা ঢাকায় আসার পর আলেয়া আপা আর দুলাভাই প্রচুর আসতেন আমাদের বাসায়। দুলাভাই এর বছরের শুরুতে দেয়া ডায়েরি আমি ব্যবহার করেছি। একবার দুলাভাই একটা মোটরসাইকেলে করে এসেছিলেন আমাদের বাসায়। উনার কাছ থেকে মোটর সাইকেলটা আমি চালাতে নিয়ে যেয়ে ওটার এক দিকের লুকিং গ্লাস বা রিয়ার ভিউ মিরর ভেঙ্গে ফেলেছিলাম।

এর পরবর্তীতে আমাদের পরিবারে যে বড় ঘটনা ঘটে তা হলো আলিম চাচা আর জাহানারা চাচীর বিয়ে। শুনেছি সম্বন্ধটা আমার নানা ভাই এনে দিয়েছিল পরে জলিল চাচা খোজ খবর করে নতুন বাসা ভাড়া করে তার পর ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়। সেই আলিম চাচা সৌদি আরবে তার শ্বশুর সাহেবের কাছে যেয়ে ছয় মাসের মাথায় ওখানেই মারা যান। বিষয়টা এতই হৃদয়বিদারক ছিল যে সেই খবর শুনে, যতদূর জানি এর কয়েক মাসের মাথায় দাদাও মারা যান। যা হোক, তার পরের ঘটনা মিজান চাচার বিয়ে। চাচী পড়াশুনা করতেন বদরুন্নেসা কলেজে আর ঢাকা মেডিকেলে মিজান চাচার হল ছিল কাছা কাছি একই রাস্তায়। চাচী শহীদ চাচীর বোন তাই তাদের মধ্যে চেনা জানা ছিল আর সেই থেকে সম্পর্কের গভীরতা। যা হোক সেই সময়কার সমাজে প্রেম জাতীয় বিষয়গুলোকে ভীষণ নেতিবাচক ভাবে দেখা হতো। মিজান চাচা ও চাচীর প্রেমের বিষয়টা বড় ভাইদের জানাজানির পর তো লংকা কান্ড শুরু হলো। এই ঘটনা থেকেই বুঝা যায় উনাদের ভাইদের ভিতর কি রকম সম্পর্ক ছিল। একজন আরেকজনকে নিজের একদম কাছের মনে করতো। একে অপরের উপর তাদের দাবিও ছিল অনেক। যা হোক মিজান চাচা চাচীকে বিয়ে করে সৌদি আরব নিয়ে যায় আর আমার বাবা যায় লিবিয়ায় পরে আমাদেরও নিয়ে যায়। মিজান চাচা পরে রুহুল চাচাকে আর আমার মেঝ মামাকে (লাল মামা) সৌদি আরবে নিয়ে যান।
 

পরিবারকে আমরা সব থেকে দামী যে উপহারটা দিতে পারি তা হলো সময়। আমার সহকর্মীদের অনেককে বলতে শুনি অমুক ব্রাঞ্চ এর ম্যানেজারি দেওয়ার পর আমি পরিবারকে বলে দিছি যে আমাকে পাবা না, এখন আমি পুরোপুরি সোনালী ব্যাংকের মানে সোনালী ব্যাংককে ষোলআনা সময়ই দিয়ে দিল, এতে করে তার ক্যারিয়ার উন্নত হলো কিন্তু তার পরিবার বঞ্চিত হলো তার মূল্যবান সময় থেকে। আমি এর ঘোর বিরোধী। যার জন্য যেটুকু সময় আমি ঠিক ততটুকু দেই, বেশিও না কমও না। আমি সোনালী ব্যাংকের এমন এমডির কথা শুনেছি যার ছেলে নেশাষক্ত হয়ে শেষ হয়ে গেছে অথচ এক স্টাফ এর দুই ছেলেই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছে। শেষ বিচারে কে সফল ? ওইে এমডি না কি ওই স্টাফ যে অফিসারও হতে পারেনি। অনেকেই জানে না হয়তো রুথ চাইল্ড পরিবারের কথা। ওরা ইউরোপের রাজাদের টাকা ধার দিত। ওরা ইহুদি তো বটেই তার উপর ওরা ওদের বৃহত্তর পরিবারের বাইরে নিজেদের সন্তানদেরও বিয়ে দেয় না। আর এই রুথ চাইল্ড পরিবার প্রধানের অনুরোধেই ব্রিটিশ সরকার ৬ দিনের যুদ্ধে মিডিল ইস্টে ইহুদিদের হারান পবিত্র ভূমি ইসরাইল দখল করে দেয়। কত শক্তিশালী এই পরিবার চিন্তা করতে পারা যায়? বৃহত্তর পরিবার যত ঐক্যবদ্ধ থাকবে অন্যরা তাদের ভয় পাবে। আর যত বিভাজিত থাকবে ততটাই দুর্বল হয়ে যাবে। আমি সোনালী ব্যাংকে ২০০৪ সালে জয়েন করি, এখন আমি সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে ৬২ দিলকুশায় ওয়েজ আর্নার কর্পোরেট শাখার ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোতে কর্মরত আছি।

গ্রামে যদি আমার বাবা সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় তবে একটা কথা তারা বলবেই যে ”রহিম খুব সহজ সরল ছিল”। এটা আমার সকল পরিচিত মানুষকে জিজ্ঞাসা করলেও বলবে ”রওনক বা সার্জিল খুব সহজ সরল মানুষ”। আমি দেখেছি আমার বাবার কাছ থেকে তিনটা বিশেষ গুন আমি ও আমার সন্তানরা জেনেটিকালি বা জীনগতভাবে পেয়ে গেছে, যেই তিনটা গুনই হলো আমাদের দোষ বা ব্যাক পুলিং ফ্যাক্টর (Back pulling factor) ১) অতিরিক্ত সরলতা (Too much simplicity), ২) নিজের ক্ষতি হচ্ছে সত্যেও অপরের উপকার করা অব্যাহত রাখা (Helping others even when we don’t need to) ৩) সহজে অন্যের মতামতকে গ্রহণ করা (Easy accepting other’s opinion)। আমি যখন বুঝলাম এই তিনটা আমাদের গুন নয় বরং দোষ কারণ ১) আমাদের অতিরিক্ত সরলতাকে অন্যরা বোকামি মনে করে ২) নিজের ক্ষতি করে অন্যের উপকার করলে উপকৃত ব্যক্তি তা গুরুত্ব দেয় না আর ক্ষতিপূরণ দিতে ভুলে যায়। ৩) সহজে অন্যের মতামত গ্রহণ করলে আমরা লিডারশীপ থেকে বঞ্চিত হই। আমি আমার তিন সন্তানকে এ বিষয় তিনটি বুঝায়ে বলেছি। তারা প্রত্যেকেই এখন এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন। মাঝে মাঝে মনে করায়ে দেই। কিন্তু তার পরও কি পারি? এই যে আমি সময় ও মেধা  খরচ করে আমার বৃহত্তর পরিবারকে একত্রিত রাখার জন্য  কাজ করছি তাতে কি আমার ক্ষতি হচ্ছে না। আমার মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে না? অনেকে তো তার ক্যারিয়ার নিয়ে এতই মত্ত যে তারা সময় করে এগুলো পড়েও দেখে না। রক্তে যা আছে তা কি সহজে যায়? রুশো বিড়াল পালে তাদের নাম রেখে। আমার তিন সন্তানের মধ্যে প্রাপ্তির মধ্যে বিড়ালের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা, সে তার ছোট ভাই আর মার জন্য পারে না। এই জেনেটিক প্রকাশ্য প্রবণতার মধ্যে সাদৃশ্য কি কাকতালীয়? আমার বড় মেয়ে প্রাপ্তি আর রাকিব গাট্টা গোট্টা মোঙ্গলিয়ান দৈহিক গঠন পেয়েছে। আমার ছেলে মুসাব যখন দেখল শাহনাজের মেঝ ছেলে তার একটা সব দরজা খোলা যায় খেলনা গাড়ি খুব পছন্দ করে ফেলেছে তখন সে তা গায়েব করে দিল বা লুকায়ে ফেললো। এই সব জেনেটিক প্রবণতা গুলো প্রকাশ্য যা আমাদের আদি পুরুষদের জেনেটিক সেট থেকে আমাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আর এটাই বংশ ধারা। আমরা সবাই এখানে জেনেটিকালি কানেকটেড। আমাদের পরিবারে আমি তিনটি স্বতন্ত্র জেনেটিক ধারা সনাক্ত করতে পেরেছি। এই ধারা তিনটার মধ্যেই কনফ্লিক্ট হয়। আমরা যদি আমাদের জেনেটিক ট্রেন্ড গুলো ধরে তা শুধরাতে পারি তবে এই কনফ্লিক্ট গুলো কমে আসবে। ধারা তিনটা সম্পর্কে শুধুমাত্র দিলশাদ মিজান মিমিকে জানায়ে রেখেছি সবিস্তারে।

রাশেদ ভাই, কাইউম ভাই আর মৃত বাচ্চু ভাই প্রসঙ্গঃ উনাদের সম্পর্কে আমি যা জানি তা যারা জানে না তাদের জানায়ে রাখি। এরা আমাদের গ্রামের বাড়ির নিকটতম প্রতিবেশী ও দুর সম্পর্কের আত্মীয়। পলাশ, শিমুল আপা আর লাবনী আপাদের নিকট আত্মীয় আর আমাদের দুর সম্পর্কের আত্মীয়। গ্রামে আমাদের জমি গুলোর সাথে লাগোয়া উনাদের অনেক জমি আছে আর তাই সেই জমিগুলোর সীমানা নিয়ে তাদের সাথে আমাদের মত বিরোধও আছে প্রচুর। গ্রামে এরা এখন প্রভাবশালী হলেও এক সময় আমাদের পরিবারের সাথে এরা আরো ঘনিষ্ঠ ছিল ও এদের অবস্থা আমদের চেয়ে খারাপ ছিল। ইকবাল ভাই প্রায়ই বলে ওরা এক সময় আলু দিয়ে ভাত খেতো চালের উপর চাপ কমাতে। এখন তাদের অবস্থা অনেক ভালো। উনারা বিল বোর্ডের ব্যবসা করতেন এখন ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডের ব্যবসায় আরো ভালো অবস্থায় আছে বলে আমার ধারনা। কাইউম ভাই এর ছেলে আমেরিকায় অক্সফোর্ডে পড়ে বলে শুনেছি। আমি পরিবার নিয়ে একবার কাইউম ভাই এর বাসায় (গ্রামের বাড়িতে উনাদের ট্রিপলেক্সে) গিয়েছিলাম উনি পুর বাসা ঘুরায়ে দেখিয়েছিল ও খুব আদর আপ্যায়ন করেছিলেন। ওই বাসা এখন রেল মন্ত্রণালয় গেস্ট হাউজ হিসেবে ভাড়া নিয়েছে। রাশেদ ভাই যখন চেয়ারম্যান ছিলেন তখন আমার সোনালী ব্যাংকের চাকুরীতে গ্রামের বাড়িতে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছিল। আমার মোহাম্মদ মোস্তফা সার্জিল নাম বলাতে কেউ গ্রামে আমাকে চিনতে পারে নাই, তখন শহিদ চাচা রাশেদ ভাইকে বলায় সে ওই পুলিশ অফিসারকে ফোন করে আমার ক্লিয়ারেন্স এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রাশেদ ভাই চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তাদের ছোট ভাই( বর্তমানে মৃত) বাচ্চু ভাই এলাকায় প্রচুর মাস্তানি করেছে ও ভাই চেয়ারম্যান বলে দাপট দেখাতো। এই বাচ্চু ভাই যখন ছোট ছিল তখন বাড় চাচার শাহবাগের গ্যারেজে তাকে কিছু দিনের জন্য বোধ হয় নিয়ে আসা হয়েছিল তাই আলেয়া আপা, দুলাভাই আর ইকবাল ভাই এর সাথে বাচ্চু ভাই এর ভালো রকম সখ্যতা আছে। কিন্তু নিকট প্রতিবেশী হলেও এদের সাথে আমাদের বাদ প্রতিবাদ অনেক বেশি। শহিদ চাচার সাথে তারা বৈরি আচরণ করে এমনকি তার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে। রুশুকে বাচ্চু ভাই ধাক্কা দিয়ে রাস্তা থেকে ফেলে দিয়েছে। আমি এটাও শুনেছি দাদুকে মারতে যাওয়ার মত উদ্ধত আচরণ করেছে বাচ্চু ভাই। মিজান চাচার গাড়ি ভাংচুরও এরাই করেছে তবে তার পর ক্ষমাও চেয়েছে আর গাড়ির গ্লাস ঠিক করে দিয়েছে । আমার সাথে একবারই কথা হয় বাচ্চু ভাই এর তখন বাচ্চু ভাই আমার বাবা যে তাকে আমাদের যশোরের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই গল্প করলেন আমার সাথে। প্রচুর প্রশংসা করলেন আবার বাবার। তাই নিকট কিংবা দুরের আত্মীয় ও প্রতিবেশী হলেও এদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমাদের জমির প্রতি তাদেরে এক ধরনের  লোভ আছে, আমাকে কাইউম ভাই নাপতার ক্ষেতের জমি বিক্রি করব কিনা জানার জন্য ফোন দিয়েছিলেন কয়েক বছর আগে, আমি সাফ সাফ জানায়ে দিয়েছিলাম আমার বিক্রির কোন পরিকল্পনা নাই। মৃত বাচ্চু ভাই এর ছেলেটার সাথে আমার কথা হয়েছে এই কিছু দিন আগে। সে বাবার মতই বাউণ্ডুলে ও কথায় বার্তায় অভদ্র। রাশেদ ভাই, কাইউম ভাই আর মৃত বাচ্চু ভাই দের সাথে আমাদের পরিবারের যাদের ঘনিষ্ঠতা আছে আর যাদের বৈরিতা আছে উভয় পক্ষকেই আমার বলার আছে যে ওরা আমাদের কেউ না। তা যদি হতো তা হলে আমাদের ফ্যমেলি ট্রিতে বা পেডিগ্রিতে তাদের নাম আসতো। কাইউম ভাই ইকবাল ভাই সমবয়সী বিধায় তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক আছে বলে শুনেছি। তা থাকতেই পারে কিন্তু আমার মতে এই তিন ভাই আমাদের পরিবারের নানা জনের সাথে নানা ভাবে সম্পৃক্ত, তারা আমাদের সম্মানও করে আবার ক্ষতি করতেও ছাড়ে না। এরকম মিশ্র আচরণ করে দেখে আমি বলবো এরা আমাদের জন্য যতটা ভালো তার চেয়ে ক্ষতিকর বেশি। ওদের সাথে আমাদের সখ্যতারও কিছু নাই আবার আমাদের ক্ষতি করতে আসলে তাদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আর যদি সম অধিকারের ভিত্তিতে আসে তবে আমরা স্বাভাবিক আচরণ করবো। এটা আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এই প্রতিবেশী তিন ভাই এর পরিবারটির বিষয়ে। অন্যদের ভিন্ন মত থাকতে পারে।

কথায় বলে জীবন সম্পর্কে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দাও জীবন বদলে যাবে। কেউ অর্ধেক খালি গ্লাসকে অর্ধেক ভরা মনে করলেই কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়। আমাদের পরিবারে আমরা যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন ঘরে বড় হয়েছি তাই জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য আছে। এটাকে কাছাকাছি আনলেই আমাদের মধ্যে কনফ্লিক্ট অব অপিনিয়ন কমে যাবে। আর এটার জন্য চাই প্রচুর ডায়ালেকটিক বা বাক্যালাপ। সেটাই আপাতত করার চেষ্টা করছি আমি। পরিবারের সবাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিলেই এই কাজটা সহজ হবে। আজকের গল্প এখানেই শেষ করলাম পরে আরো লেখার ইচ্ছা আছে।

বাংলাদেশে প্রচলিত প্রবাদ আছে বিক্রমপুরকে নিয়ে, যার একটা হলো
বিক্রমপুইরা রা খাইতেও পারে খাওয়াইতেও পারে।”
আর আরেকটি হলো
বিক্রমপুইরা পোলা ৮০ টাকা তোলা”।

প্রাসঙ্গিক ভিডিও তে লেখরে বক্তব্য https://youtu.be/K7T2Zr-IgHU

সম্পাদনা ও উন্নয়কালঃ ২৮নভেম্বর২০২৩> ০৩ডিসেম্বর২০২৩>২০ডিসেম্বর২০২৩> ১৫ জানুয়ারী ২০২৪> ১৯ জানুয়ারী ২০২৪> ২৭ জানুয়ারী ২০২৪>

প্রাসঙ্গিক লিংকঃ শরিফ সারেং পরিবারের গল্প-১ : দিলশাদ মিজান মিমি

Wednesday, January 17, 2024

শরিফ সারেং পরিবারের গল্প-১ : দিলশাদ মিজান (মিমি)

 

আলহামদুলিল্লাহ, রওনক ও রুশো ভাইয়ার উদ্যোগে এখানে অনেককে পেলাম। ভাল লাগছে। এতটা সময় বের করে সবার সাথে যোগাযোগ করে একসাথে করা এবং উৎসাহ নিয়ে সবাইকে রেগুলার আপডেট রাখা সত্যি এপ্রিশিয়েট করার মত। সবাই একত্রিত হলে বা হওয়ার মনোভাব দেখালে, আমার আমাদের আব্বুর কথা খুব মনে পড়ে। আমার আব্বু ডঃ মিজান, সবার সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা জীবনের শেষ পর্যন্ত করে গিয়েছেন। মানুষের ছোটবেলার স্মৃতি খুব পাওয়ারফুল। ছোটবেলায় কোন ঈদ ছিল না যে আমরা আমাদের প্রত্যেক চাচাদের বাসায় যায়নি। আব্বু আমাদের কে নিয়ে সবার বাসায় যেতেন। কোন বিয়ের দাওয়াত থাকলে আমাদের চার ভাই-বোনের একজন কেও ফেলে যেতে চাইতেন না। গ্রামের বাড়িতে ও আব্বুর সঙ্গে অনেক গিয়েছি। নিজেদের বাড়ি ছাড়াও  অন্যান্য অনেক গ্রামের আত্মীয়স্বজনদের বাসায় গিয়েছি। গ্রামের আত্মীয়রাও আসতেন, এখনো আসেন আমাদের শান্তিবাগের বাসায় । তাই গ্রামের আত্মীয় এবং ফুপু অম্মার পরিবারের সবার সঙ্গে খুব আন্তরিক সম্পর্ক আমাদের সবসময়। এখন ফিরে তাকালে দেখি, পরিবারের প্রায় সবাইকে চিনি মাশাআল্লাহ, সবার সঙ্গেই ছোট -বড় স্মৃতি আছে। আমি অনেক বছর দূরে থাকি তাই আমার সঙ্গে এখন দেখা কম হয়। কিন্তু একা থাকি তো, সবাইকে মনে করি।  

এখানে যারা বড়-চাচার ফ্যামিলি থেকে আছ, তোমাদের বড় হওয়ার সময়টাতে আমাদের যোগাযোগ কম হয়েছে। কিন্তু আগে অরুন মুসা ইকবাল ভাইরা যখন একসঙ্গে ছিলেন তখন এবং তারপর ও ভাইয়ারা বেঁচে থাকা পর্যন্ত দেখা হতো, আমাদের বাসায় সবাই আসতেন। আমরাও শবে বরাতে,  ঈদ সহ এমনিতেও যেতাম। রাকিব আমার চেয়ে কিছুটা ছোট।  তানিয়া, রাকিবের মনে থাকবে। রিয়াদ রাসেল ছোট ছিল। মুসা ভাইয়া মনিকা -সৈকত কে নিয়ে আমাদের বাসায় আসতেন। পরে মুসা এবং ইকবাল ভাই অনেক দূরে থাকতেন তাই ওদের আমরা বড় হতে দেখিনি। আসলে আমাদে বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের মাযেরা খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন। পলাশ ভাইয়ারা, রওনক ভাইয়া, হীরা ভাইয়া, আমরা, রাকিবারা, মনিকারা আমাদের বড় হওয়ার লেখাপড়ার এই সময়টাতে আমাদের বাবারা চলে গেছেন। আমাদের মায়েরা আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের এতদূর নিয়ে এসেছেন। অনেক ধৈর্য্য আমাদের মায়েদের, তাদের কষ্টের, ত্যাগের ফলে আজকে সবাইকে এখানে সাকসেসফুল মানুষ হিসাবে দেখছি, আলহামদুলিল্লাহ।  

আব্বু-আম্মু  আমাদেরকে ধর্মীয় বাউন্ডারিয়াস এর মধ্যে বড় করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের চাচাদের মেযেদের মধ্যে আমাদের তিন বোনের বয়সী কোন মেযে তখন ছিল না। আলেয়া আপা আমাদের অনেক বড়, হলেও একটা সময় আলেয়া আপাকে আমরা অনেক পেয়েছি তাই সেলিনা আন্টির সঙ্গেও সখ্যতা ছিল। শিমুল আপু - লাবনী আপু আমাদের বড় ছিলেন, বাসা বেশ দূরে ছিল। কম দেখা হতো।কিন্তু যখনি দেখা হয়েছে খুব মিষ্টি করে কথা বলেছেন, আদর করেছেন। আমাদের জেনারেশন এ আর কোন মেয়ে নেই।  আব্বু মারা যাওয়ার পর রুহুল কাক্কু- কাকী আমাদের সঙ্গে সব সময় ছিলেন। অনন্যা অনেক ছোট হলেও, ও আমাদের অনেক কাছের। হঠাৎ রুহুল কাক্কু ও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কাক্কুকে অনেক মনে পড়ে, একদম ছোটবেলা থেকে রুহুল কাক্কুর সঙ্গে আমাদের অনেক স্মৃতি, অনেক আদর-স্নেহ পেয়েছি। বড় কাক্কু আর আলীম কাক্কু ছাড়া আমার সব কাক্কুদের সঙ্গে আনন্দের স্মৃতি আছে। আমি লিখবো ইনশাআল্লাহ।

আমাদের লেখাপড়া, চাকরী, ছেলেমেয়ে নিয়ে মোটামোটি সবাই কিছুটা সেটেলড হতেও অনেকটা  সময় চলে গিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন বলে আমরা এখন যে যার জায়গা থেকে আবার কানেক্টেড হতে চেষ্ট্রা করছি। সবার কান্ট্রিবিউশন এখানে জরুরী।  রওনক ভাইয়া চেষ্টা করছে, আমরা যে যখন ফ্রি, কিছটা যোগাযোগের চেষ্টা করি।  আমি দূরে থাকি কিন্তু সবাই গেট-টুগেদার করছে দেখলে ভাল লাগবে। এক-দেড় বছর পর পর দেশে আসি, ইনশাআল্লাহ তখন দেখা হবে। ২০২১ এ পলাশ ভাইয়ার আয়োজন করা গেট-টুগেদার গিয়ে অনেকের সঙ্গে একসঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভাল লেগেছিলো।   

আমাদের চাচাদের জীবনে একটা পর্যায়ে তারা প্রচন্ড একতাবদ্ধ ছিলেন। সমযের সাথে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য কিছুটা দূরে চলে গিয়েছিলেন। আব্বু আমাদের তাদের জীবনে ভাইদের অবদান, সুন্দর স্মৃতিগুলো নিয়ে অনেক গল্প করতেন, কথা বলতেন। দাদুর কাছ থেকে অনেক অনেক আগের তাদের জীবনের গল্প শুনেছি। কাক্কুরা যখন যে আমাদের বাসায় এসেছেন বা কোথাও দেখা হয়েছে আমাদে চার ভাই-বোনকে অনেক আদর করেছেন। তাদের সবার মাঝেই একটা নরম-সুন্দর মন ছিল, আমার সবসময় মনে হয়েছে। খুব মেধাবী এবং আবেগী মানুষও ছিলেন তারা।

আল্লাহ আমার দাদা-দাদু, আব্বু, কাক্কু-কাকীদের, ভাইদের এবং যারা চলে গিয়েছেন তাদেরকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।  সত্যিকার অর্থে আমাদের বাবা-চাচারা প্রত্যেকে ব্যাক্তিগতভাবে খুব ভাল মানুষ ছিলেন। আমার আব্বু তার ৫৩ বছরের এই ছোট্ট জীবনে এমন অনেক কিছু করেছেন যেটা মানুষ অনেক লম্বা হায়াৎ পেয়েও করতে পারেনা, নিঃস্বার্থভাবে  সাধ্যমতো মানুষের জন্য করেছেন, আল্লাহর জন্য যেভাবে মানুষ কে আল্লাহর পথে ডেকেছেন, দুনিয়ার এম্বিশন থেকে সরে গিয়ে আখিরাত-মুখী জীবন করার চেষ্টা করেছেন। আমার আব্বুকে তার গুনের জন্য এখনো জানা- অজানা অনেক মানুষ মনে করে, দোআ করে। আর একজন আমার কাছ থেকে দেখা মানুষ হলেন রুহুল কাক্কু, তার মতো এত সহজ মানুষ, এত অনেস্ট মানুষ নেই বললেই চলে। অনুকরণ করার মতো মানুষ। আমি খুব কাছ থেকে এই দুইজন কে দেখেছি বলে তাদের কথা তুলে ধরলাম। আমার অন্য কাক্কুরাও অনেক গুণী মানুষ ছিলেন।  আমাদের ভাই-বোন, ভাগ্না-ভাগ্ন, ভাতিজা-ভাতিজি সবার মাঝেও মানুষ হিসেবে অনেক ভাল গুন আছে। সেগুলোও যেন আমরা এক্সপ্লোর করি।

ফুপু আম্মা আর সোনা কাক্কুকে আল্লাহ নেক হায়াৎ দিন এই দোআ করি। আমাদের বাবাদের জেনারেশন এর প্রায় সবাই চলে গিয়েছেন। তাদের দেখে একটা জিনিস তো আমরা নিশ্চিত যে ' মানুষ আসলে চলেই যায়, আমাদের চলে যাওয়ার দিন ও খুব কাছেই '। এরপর অনন্ত আখিরাত। তাই যেকদিন দুনিয়াতে আছি নিজেরা আল্লাহর দেওয়া পথ অনুযায়ী চলার চেষ্টা করি। যারা চলে গিয়েছেন তাদের দুআ করার, ভাল কাজ করার আর কোন সুযোগ নেই, তাই তারা বেনিফিটেড হবেন এমন কাজ যেন আমরা করি।  আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখা খুব বড় একটা কাজ।  আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পরিচায়ক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’। আমরা যেন সেটা বজায় রাখতে পারি, সুখে দুঃখে একে ওপরের পাশে থাকতে পারি । এই দোআ সবার জন্য।