(সতর্কীকরণঃ যারা ধর্মনিরপেক্ষ নন কিংবা পরমত সহিষ্ণু নন তাদের জন্য লেখাটা পড়া কষ্টদায়ক হতে পারে, তাই তাদের না পড়াই ভাল। যদি উন্মুক্ত ভাবনা চিন্তাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন তবে পড়ে ভাল লাগতেও পারে।)
মঙ্গলময় জীবনের উদ্দেশ্যে ধর্মের সেকাল, একাল আর আগামীকাল নিয়ে অনেক কথাই বলা যায় কিন্তু সবই যে গ্রহনযোগ্য হতে হবে তা’ও নয়। সবাই চায় তার জীবন মঙ্গলময় হোক কিন্তু লক্ষ্য জানা থাকলেও তাতে পৌছাতে নানা জন নানা পথের কথা বলে। এই লক্ষ্য ও পথ নিয়ে এলডাস হক্সলির (Aldous Huxley) বই “লক্ষ্য ও পথ” যথেষ্ট চমকপ্রদ। বইটার প্রথম কয়েকটা অধ্যায় এতই তথ্যবহুল আর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন যা যে না পড়েছে সে জানতে পারবে না। তবে শেষের অধ্যায়গুলো অতি দীর্ঘ যা পড়তে পড়তে মনে হতে পারে বছর শেষে হয়ে গেছে তার পরও বইটা পড়ে শেষ করা যাচ্ছে না। মঙ্গলময় জীবন নাকি আত্ম তৃপ্তি যাকে ইংরেজিতে ইনার পিস (Inner peace) বলা হয় সেই ভারসাম্যে মানুষের মন পৌছাতে চায় প্রগাড় মানুষিক পূর্ণতা বা শান্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমার মনে হয় এই আল্টিমেট ইনার পিসের সন্ধানেই মানুষ শেষ জীবনে হন্যে হয়ে যায়। মেসল’স হায়ারারকি অব হিউমেন নিড থিউরি অনুযায়ী মানুষের মানবিক চাহিদার সর্বশেষ স্তর যাকে বলা হয় সেল্ফ একচুয়ালাইজেশন বা সামগ্রিক পরিপূর্ণতা এটা তাই। মুসলিম সম্প্রদায়ে যারা শেষ জীবনে হজ্জ্বে যায় তারা মূলত এই শেষ ধাপটা পূরণ করতেই যায়। কেউ কেউ একাধিকবার হজ্জ্ব করেও তৃপ্তি পায় না আরো যেতে চায়। অনেকে হজ্জ করে এসে ৪০ দিন পার হওয়ার পর পূর্বে যে পাপ কাজ করছিল তা আবার করা শুরু করে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ যাত্রাও অনেকটা সেই একই প্রবৃত্তি থেকে আসে বলে আমার ধারণা।
"The good life is one inspired by love and guided by knowledge" মঙ্গলময় জীবন হল সেই জীবন যা প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত আর জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত। "Outside human desire there is no moral standard" মানবিক ইচ্ছার বাইরে কোন নৈতিক মান নাই। কথাগুলো বারট্রান্ড রাসেলের (Bertrand Russell) হলেও তার সম্পর্কে ক্রিটিক আছে যে, তিনি বর্ণচোরা ভাববাদী। যদিও তিনি কেন ধর্ম বিশ্বাসী নন বলে ভাষণ দিয়েছেন যা বই আকারে প্রকাশও হয়েছে। “আমি কেন ধর্ম বিশ্বাসী নই” বইয়ের পৃষ্ঠা-৩৬ এ বারট্রান্ড রাসেল বলেন “ধর্ম প্রধানত ভয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। ভয়টাই হলো আসল ভিত্তি- রহস্যের ভয়, পরাজয়ের ভয়, মৃত্যুর ভয়। ভয় হল নিষ্ঠুরতার জনক-জননী। ধর্ম ও নিষ্ঠুরতা পরস্পর হাত ধরে চলে। ঈশ্বর সম্পর্কে সমগ্র ধারণাটি জগৎজোড়া প্রাচীন স্বৈরাচারী কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মুক্ত মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের কল্পনা নিছক বাতুলতা মাত্র।”তিনি ও’র পরের পাতাতেই আরও বলেন “একটি মঙ্গলময় জগত সৃষ্টি করতে চাই জ্ঞান, দয়া এবং সাহস। ঘৃণ্য অতীতের ধ্বজা আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলে আর চলবে না।” তিনি এগুলো বলেছেন আজ থেকে ৬০ থেকে ৭০ বছর আগে আর আজও আমাদের বোধগম্যতায় সেই জ্ঞান আসে নাই বলেই মনে হয়। মঙ্গলময় সমাজ কাকে বলে তাই নিয়েই আমরা এখনো একমত হতে পারি নাই। দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলিম আর তাদের ধারনা দিন রাত আল্লাহ-বিল্লাহ করলেই মঙ্গলময় জীবন বিধাতার কৃপায় প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে যেখানে তার বা তাদের তেমন কিছুই করার নাই। এই প্রকার ধারণার ঘোর বিরোধী আমি কারণ বাস্তবতা বলে না যে ফেরেশতাদের দ্বারা সামাজিক কাঠামো চলমান থাকে। তাহলে ফেরাশতাদের দিয়েই সরকার, অর্থনীতি, সমাজনীতি পরিচালনা করার জন্য দোয়া দরুদ পরলেই চলত। প্রতি নামাজ শেষে যে দীর্ঘ দোয়ার আয়োজন করা হয় মসজিদে তার কতটা ফলে তা লক্ষ্য করার বিষয়। দোয়া ফলুক বা না ফলুক তাতে ধর্মের কিছুই যায় আসে না, ধর্মের ধ্বজা এমনি নরে।
নতুন করে বলার বিষয় নয় যে, মানুষ একক ভাবে অত্যন্ত অসহায়। কয়েক শত কোটি বছর আগের জীবাশ্ম রেকর্ডে মানব নির্মিত যন্ত্রের যে সব নজির পাওয়া যায় তা বড় হাড় থেকে মজ্জা বের করে আনার জন্য ব্যবহৃত হতো বলে দেখ গেছে। তখন মানুষ প্রকৃতির খাদ্য শৃঙ্খলের মাঝা মাঝি কোন স্তরে অবস্থান করত তাই সিংহ কিংবা বাঘের খেয়ে রেখে যাওয়া শিকারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে জীবন ধারণ করতো কিংবা যখন আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না তখন দাবানলে পুরে যাওয়া বন এর মধ্যে মরে যাওয়া বা রোস্ট হয়ে যাওয়া প্রাণীর মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করতো বলে ইউভাল নোয়া হারারী তার বই “হোমো সেপিয়েন্স দ্যা হিস্ট্রি অব মেন” বইতে উল্লেখ করেছেন। চিন্তাশীল মানবের আদিতে কি ছিল? দেবীপ্রসাদ ভট্টাচার্যর বই ”সত্যের সন্ধানে মানুষ” এ সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন কি ভাবে ধর্মের আগে যা ছিল। তার লেখা পড়লে বুঝা যায় তিনি বস্তুবাদী বা দ্বান্দিক বস্তুবাদী কিংবা বলা যায় সম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের ঘোর সমর্থক। তা যাই হোক না কেন তার বক্তব্য কতটা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তা’ই বিচার্য হওয়া উচিত। তিনি বলেছেন এখনো বর্তমান আদি সমাজগুলোতে দেখা যায় ব্রত পালন করা হয় মানে হলো প্রকৃতিকে জয় করার মহড়া। যা মোটেও ধর্ম নয়। ব্রত আর পূজায় তফাত আছে। তার বই সত্যের সন্ধানে মানুষ এর ৪৬ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন “ব্রতের ফুলের সঙ্গে পুঁজর ফুলের তফাত আছে। ধর্ম বিশ্বাস বলতে ঠিক কি বোঝায়? বোঝায় পৃথিবীর ঘটনাগুলো পৃথিবীর নিয়ম অনুসারে ঘটছে না; তার বদলে ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঘটছে। এই ঈশ্বরকে ফুল দিয়ে, নৈবেদ্য দিয়ে খুশি করা যায়, তাঁর ইচ্ছের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া যায় – ইত্যাদি। আদিম মানুষের হালচালটা ভালো করে পরীক্ষা করো। দেখবে, দেবতা মানে কি, ঈশ্বর মানে কি, ভগবান মানে কি- এ সব কথা ওরা কিছুই জানে না। ওরা জানে না পুজো করতে, প্রার্থনা করতে, ফুল নৈবেদ্য দিয়ে দেবতাকে খুশি করবার কল্পনা করতে। ওদের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাসের পরিচয় নেই। তার বদলে, পরিচয় শুধু জাদু বিশ্বাসের।“ ইসলাম ধর্মে কিংবা ইহুদী ধর্মে মুসা আঃ এর যে ঘটনা তাতেও দেখা যায় তাঁর হাতের লাঠি সাপ হয়ে তখনকার সকল জাদুকরের জাদু খেয়ে ফেলে। ধর্মের আগে জাদু বিশ্বাস যে মানব সম্প্রদায়ে ছিল এটা তার একটা বড় প্রমাণ বলা যায়।
ব্রত বা যজ্ঞ এক রকম মহড়া যা টোটেম বিশ্বাস থেকে আসে। জগতে জয় লাভের জন্য কোন প্রার্থনা কিংবা স্রষ্টার কাছে আকুতি কিংবা তাকে তুষ্ট করার জন্য কোন প্রাণী বলি এর চল নাই এতে। এটা নিতান্তই এক প্রকার উদ্দীপনা জাগানিয়া ও সমবেত শক্তির উচ্ছ্বাস জনিত একপ্রকার নৃত্য যা প্রকৃতিকে বা প্রকৃতির সাথে সংগ্রামের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করা। তখন সমাজে টোটেম বিশ্বাস ছিল, মানে হলো কোন গোত্রের সবাই মনে করতো তারা হরিণ থেকে হয়েছে তাই তারা হরিণের দল, হরিণ হলো তাদের টোটেম। কেউ ভাবতো তারা সূর্যমুখী ফুল থেকে হয়েছে তাই তাদের টোটেম ছিল সূর্যমুখী ফুল। সবার মধ্যে একই শক্তি ও প্রভাব, কেউ কার চেয়ে উন্নত বা অনুন্নত নয়, সবাই সমান। সেটা ছিল শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা যাতে কোন গোত্র প্রধান বলে কিছু থাকতো না বা থাকার প্রয়োজন পড়ত না। সবাই তাদের টোটেম থেকে হয়েছে তাই সবাই সমান। তখন হাতিয়ার ছিলো অনুন্নত আর শিকারের মাধ্যমে যা জুটত তাতে সবার কোন মতে খেয়ে পড়ে চলে যেত। বাড়তি উৎপাদন বা প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য সংরক্ষণ কাকে বলে ও কেন দরকার তা’ও বোধ হয় তাদের চিন্তায় বা বুদ্ধিতে ছিল না।
এর পর যখন মানুষ কৃষি কাজ শুরু করল বা সংঘবদ্ধ ভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে শিকার করা শিখল কিংবা বলা যায় প্রথম প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে শিকার ছেড়ে ভূমি কর্ষণ করে খাদ্য উৎপাদন করতে শিখল, লোহা বা শীশা গলায়ে অস্ত্র তৈর করতে পারল তখন তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারল আর তখনই শুরু হলো সঞ্চিত সম্পদের বণ্টন জনিত সমস্যা। আগে ছিল প্রকৃতির সাথে মানুষের সংগ্রাম এর পর শুরু হলো মানুষের সাথে মানুষের সম্পদ বণ্টনের সংগ্রাম। এ সময়টাতেই সমাজে শ্রেণীর আবির্ভাব অর্থাৎ শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীযুক্ত সমাজে উত্তরণ। শ্রেণী সমাজে গোত্র প্রধান, পুরোহিত, শ্রমজীবী মানুষ ইত্যাদির সমাহার আর তার সাথে সাথে সামাজিক নীতি নিয়ম ও ধর্মের উৎপত্তি। কিছু মানুষ অন্যর উৎপাদিত বা উপার্জিত সম্পদ বিনাশ্রমে অর্জনের সুযোগ করে নিলো আর ধর্মের ধ্বজা উড়ায়ে আকাশ কুসুম ভাববার সুযোগ পেল। এ সময়টাতে মন্ত্রশক্তি আর মন্ত্রগুপ্তির চল হয়েছিল বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন। এ সব পর্যায় উত্তরণ চট জলদি হয়নি বরং শত শত বছর বা শত কোটি বছরের বিবর্তন বা পরিবর্তনের ফসল এই শ্রেণী সমাজ। দেবীপ্রসাদ ভট্টাচার্যর অতি পুরাতন বেদ থেকে শ্লোকের উদাহারণ দিয়ে দেখিয়েছেন কখন শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণী সমাজের বিবর্তন হয়েছে যার প্রমাণ উনি বেদ বেদান্ত উপনিষদের বিভিন্ন পুথি’র নানান গল্পের মধ্যেও নজির পেয়েছেন। সমাজতান্ত্রিকদের বক্তব্য অনুসারে শ্রেণীযুক্ত সমাজ মূলত শোষক ও শাসিতের সমাজ যেখানে একদল শ্রমজীবী মানুষকে অপর একদল মানুষ শোষণ করে জীবন নির্বাহ করছে বা করে আসছে। বর্তমানের উদ্যোগতা ও ভোক্তা শ্রেণীকরণ এর সাথে এর পার্থক্য আছে। বর্তমানের সমাজ আমার মনে হয় বেশ জটিল তবে শোষক ও শাসিত ধারণাটি চলমান আছে, জটিল নগর জীবনের জট খুললে এই সরলীকরণ ফুটে উঠবে ঠিকই। ধর্ম বা ঈশ্বর বিশ্বাস শোষক বা শাসক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে জন্ম থেকেই কাজ করে আসছে। পুরাণ জমিদার বাড়িগুলোর কাছে বা একেবারে মধ্যখানে একটা মন্দির অবশ্য অবশ্যই পাবেন। ধার্মিকতার ধারণা অনুচ্ছেদের শেষে বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন, “এটি সম্ভবত সত্য যে মনুষ্য-জাতি স্বর্ণযুগের দোরগোড়ায়, কিন্তু যদি এটা সত্যই হয়, তবে প্রথম প্রয়োজন সেই ড্রাগনটিকে কেটে হত্যা করা যে দোরগোড়ায় পাহারা দিয়ে বসে আছে এবং এই ড্রাগনটি হল ধর্ম।”একই অনুচ্ছেদের শুরুর দিকে তিনি বলেছেন “ধার্মিকতার ধারণার সারবস্তুটি হল বিচারের নামে নিষ্ঠুরতার বোরখা পরা ধর্ষকামের বহির্গমন ( The Essence of the conception of righteousness, therefore, is to afford an outlet for sadism by cloaking cruelty as justice.)" ধর্ম নিয়ে মানুষের বাড়াবাড়ি দেখলেই বুঝা যায় তাদের আচরণগুলো যতটা ধর্মানুরাগের জন্য তার চেয়ে বেশী ধর্মটাকে নিজের মনে করার জন্য। আমি আগের লেখা গুলোয় উল্লেখ করেছি যে, ধর্ম মানুষকে এক ধরনের প্রগাড় প্রশান্তি দেয় যা তাকে জগতের সকল অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে এবং তাতে তার দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে উঠে। যখনই তাকে চ্যালেঞ্জ করা হয় তখন সে ক্ষেপে যায়। অন্য ধর্মের চেয়ে তার ধর্মটি সঠিকতার বিচারে শ্রেষ্ঠ এটা অনুধাবন করে সে মহা তৃপ্তি অনুভব করে। কেউ সেই কমফোর্ট জোন বা পাকা ধানে মই দিতে গেলেই সে হই হই করে তেড়ে আসে। আসাটাই স্বাভাবিক কারণ সে অত্যন্ত সহজে এই পুণ্যভূমি দখলদার তাকে তা থেকে উৎখাত করতে যে আসবে তার রক্ষা থাকার কথা না।
আমরা যখন কোন অশুভ আশংকা করি ধরা যাক একমাত্র পুত্র সন্তান অসুস্থ কিংবা মা অসুস্থ আর তার অসুখের কারণ ডাক্তারের অজানা। এ রকম অবস্থায় আমাদের মন একটা সহায় খুঁজে আর সাধারণের বক্তব্য হলো যার কেউ নাই তার বিধাতা আছে। অসুস্থ পুত্রর জন্য দাওয়া তো চায়ই সাথে দোয়াও চাওয়া জরুরী। মানুষ তখন খড় কুটা আঁকড়ে ধরতে চায়। বারট্রান্ড রাসেলের ফতোয়া যে ভয় থেকেই সকল ধর্মের উৎপত্তি তা সত্য বলেই মনে হয়। মানুষের না না রকমের ভয় সেই অনাদিকাল থেকেই তাকে আকৃতি দান করে আসছে। পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহ করতে না পারার ভয় বা আশংকা, অসুস্থতা হতে মুক্ত না হতে পারার ভয় বা আশংকা, একাকীত্বর ভয়, এরকম নানা প্রকারের ভয় তাকে আস্টে পৃষ্টে বেধে রেখেছে। ভয় তা হলো মানুষের সহজাত। ভয় কে জয় করার মাধ্যমে মানুষ উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়। মূলত বিভিন্ন ভয়কে জয় করে চলাই জীবন সংগ্রাম। ধর্ম এই ভয়কে জয় করতে সর্বত ভাবে সহায়তা করে। ধর্মের করাত দুদিকেই কাটে। যদি আশা পূর্ণ হয় তবে বিধাতা মহান আর না হলে বিধাতা যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন।
আমার এক স্কুলের বন্ধু নওশাদ মাঝে মাঝে আমাদের স্কুল বন্ধুদের ভাইবার গ্রুপে আচমকা কিছু তত্ত্ব কথা ছেড়ে দেয়, কেউ বুঝুক আর নাই বুঝুক ও এ রকম করবেই। একবার ওর লেখা গুল নিয়ে আমার ভিন্ন মতগুলো উল্লেখ করেছিলাম, তাতে কিছুই হয় নাই, ও পুরোপুরি নির্বাক ছিল। ০২ এপ্রিল, ২০২৩ এ ওর আরেকটা লেখা পেলাম যেখানে সেই ভয় এর কথাই ও বলেছে। ও’র কথাগুলো হুবহু তুলে দিচ্ছি “উপেক্ষা করা যায় না এমন একটি প্রবল পরাক্রমশালী সত্ত্বার উপস্থিতি যখন কেউ উপলব্ধি করতে পারে, তখন ভয় মাখানো এক বিস্ময় নিয়ে সে নতুন এক সচেতনতার মোড়কে নিজেকে আবৃত করে চারপাশের বাস্তবতাকে দেখতে পায়। এই ভয় মাখানো বিস্ময় [আরবিঃ তাক্কওয়া] জাগিয়ে রাখা আর স্রষ্টার বিশ্বাস করা এক নয়। বিশ্বাস যারা করতে পেরেছে তাদের তাক্কওয়া বা স্রষ্টার সচেতনাত ধরে রেখে সৎকর্মশীল হয়ে চলতে থাকার প্রশিক্ষণ হিসেবে রোজা রাখার উপদেশ দেয়া হয়েছে কোরআনে (২:১৮৩) । এই মানব সত্ত্বা এই সচেতনতা স্বেচ্ছায় তুলে ধরবে সুখে বিনয়ী থাকায়, কষ্টে অবিচল থাকায়, কঠিন হলেও সত্য বলার জন্য দাঁড়াতে – তবে সম্মানের সাথে তা করতে এবং কখনোবা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষয় সহনশীল হওয়াতে। নিজের মাঝে শালীনতা ও চরিত্রের শুদ্ধতা বজায় রাখায়, প্রকাশ্যে গোপনে দান করতে – তবে স্রষ্টাকে খুশি করার জন্য অন্য কারো অনুরাগ কামনায় নয়। এমনকি সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার প্রচেষ্টার মাঝেও, তার কাছে প্রত্যাশিত হয় যে, সে প্রকাশ্যে জাহির করার অভিপ্রায় এড়িয়ে যেতে তাক্কওয়া ধরে রাখবে। প্রতিটি রমাদান মাসই স্রষ্টায় সচেতনাতা গড়ার জন্য এবং পরবর্তী রমাদান পর্যন্ত ১১ মাসে এই তাক্কওয়া পরিচর্যা করার জন্য একটা বিশেষ মাইলফলক হয়ে ফিরে আসে।“ এই বক্তব্য থেকেই বুঝা যায় বর্তমান এই শহরের মানুষের মানুষিক অবস্থা কোন পর্যায়ের । তারা মারত্মক ভাবে ধর্মের প্রতি অনুরক্ত এবং নিজেরাই এর আচার বিচার করে বক্তব্য দিচ্ছেন। যখন তার ধর্মগ্রন্থেই বলা আছে কেন রোজা ফরজ করা হয়েছে সেখানে তার মানে আমার বন্ধুর মনে এত এত কারণ জন্ম নিলো কেন, কি কারণে সে এর উপকারিতা কিংবা এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে। ধর্মানুরাগীদের তাদের ধর্ম নিয়ে বার বার তাকে সত্য প্রমাণের চেষ্টা প্রমাণ করে যে তাদের মনের অত্যন্ত গভীরে সন্দেহের বীজ বপন করা আছে। এক রিক্সা চালক বৃদ্ধ বলছিলেন তপ্ত গরমে ক্লান্ত হয়ে এক দিন রিক্সা চালান নি, রেডিও খবরে শুনলেন তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নাই কিন্তু আসরের আজানের পরই হাওয়া ছাড়ল তখন রেডিও খবরে প্রচার করা হলো বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। তিনি বোঝাতে চাইলেন এমনকি বললেনও লোকে যে বলে কোরআন সত্য নয় এই দেখ তার প্রমাণ যে কোরআন সর্বত ভাবে সত্য। ইন্ডিয়ান আইডল এ দেখাচ্ছে এক কিশোরী গায়িকা তার গান গাচ্ছে, ঈশ্বর সত্য হে – শিবই ঈশ্বর হে – শিব সুন্দর হে – সত্যম-শীবম-সুন্দরম। খেয়াল করে দেখবেন এখানে ঈশ্বর কে শিব ও শিবকে সুন্দরের সাথে যুক্ত করে সেই সুন্দরের পূজা করা হচ্ছে। ও’রা তো শিব লিঙ্গরও পূজা করে থাকে, তার উপর কলশি কলশি দুধ ঢেলে আচার অনুষ্ঠান করে। তাদের এরূপ উদ্ভট আচরণের বিরোধিতা করায় এক বিশাল জনসভায় এক ভারতীয় মহিলাকে অপদস্থ হতে হয়েছিল। তার যুক্তি ছিল এত দুধ এভাবে অপচয় না করে যারা দরিদ্র শিশু খেতে পায় না সেই সব বাচ্চাদের দেয়া উচিত।
বারট্রান্ড রাসেলের কথায় ফিরে আসি তিনি বলেছেন “আমি এই রকম কোন ভান করতে চাই না যার দ্বারা বোঝাবে যে আমার প্রমাণ করবার সামর্থ্য আছে যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই। একই ভাবে আমি এটাও প্রমাণ করতে পারব না যে শয়তান মানেই হল কল্পিত কাহিনী। খ্রিষ্টীয় ঈশ্বর থাকতেই পারে এবং ঠিক একই ভাবে অলিম্পাসের ঈশ্বর, অথবা প্রাচীন ইজিপ্টের ঈশ্বর অথবা ব্যাবিলনের ঈশ্বর থাকতেই পারে। কিন্তু এদের মধ্যে কোন প্রকল্পই (hypothesis) একে অন্যের চেয়ে অধিক সম্ভাব্য নয় এমন কি এই সমস্ত প্রকল্পগুলি বা অনুমানগুলি সম্ভাব্য জ্ঞানের অঞ্চলের বাইরে অবস্থান করে থাকে। এই জন্যেই তাদের কোনটাকেই বিবেচনা করে দেখার কোন কারণ নেই। ” -বারট্রান্ড রাসেল, প্রকৃতি ও মানুষ অনুচ্ছেদ। আমার ৫১ বছর এর অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় যেন এত সব কিছুই উদ্ভট। মানব সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টা তাহলে স্রষ্টাকে সৃষ্টি করল কে? যদি বলি মানুষই সৃষ্টি করেছে স্রষ্টাকে তারপর তাকে হত্যা করেছে কোন দ্বিধা ছাড়াই তবে এই ইহলোকেই আমার জীবন নিপাত যাবে ওই যারা স্রষ্টাকে সৃষ্টি করেছে তাদের দ্বারা। স্রষ্টা নেই, কোন কালে ছিলোও না। মানুষই স্রষ্টাকে সৃষ্টি করেছে আর আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেদের প্রয়োজনে। এখন স্রষ্টার নাম নিয়ে ব্যবসা, রাজনীতি, সমাজনীতি সব করায়ত্ত করছে আর এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঘুম পাড়ায়ে রেখেছে। এই সহজ সরল সত্যটা বিশ্বাস করতে মানুষ ভয় পায় আর ভয় থেকে পালাতেই ধর্মের জন্ম, স্রষ্টার জন্ম, যে সকল কিছুর প্রতিপালক, ও সকল ভয়য়ের বিপরীতে আস্থা ও ভরসা প্রদানকারী। যারা বহু অতীতে বেদ রচনা করেছেন তারাও বলেছেন এটা দৈব বানি। বেদান্ত উপনিষদে তারই ব্যাখ্যার চলমান প্রবাহ। সেমেটিক ধর্মগুলোরও তো প্রচুর ধারা উপধারা। এত সব গাজাখুরি মানুষ কেন বিশ্বাস করে তার ব্যাখ্যাও তো বিজ্ঞ লোকজন মানে ভিন্ন মনষ্ক বিজ্ঞ লোকজন দিয়েছেন। তার পরও যারা ধর্মানুরাগী তারা ধর্ম ছাড়তে নারাজ কেন? কারণ ওই ভয়। কি জানি কি হয়। এই অনুভূতির কি কোন বিকল্প আছে, আমি আপনাদের আর আপনারা সবাই আমার, এ এক অভূতপূর্ব ভালবাসার অনুভূতি। লতায় পাতায় জড়ান একই পরিবার ভুক্ত হওয়ার অনুভূতি। যার বাস্তব প্রতিফলন হয় ধর্মে। কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝেও এই অনুভূতিরই জয়।
অমর আত্মা সম্পর্কে বারট্রান্ড রাসেলের উক্তি গুলোও বেশ সরস, তিনি বলেছেন “অধিবিদ্যা বিদরা আত্মা যে অবশ্যই অমর তা প্রমাণ করতে বহু যুক্তি প্রদান করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। একটি সরল পরীক্ষা দ্বারা এই সমস্ত যুক্তি গুলোকে নস্যাৎ করা যেতে পারে। সমস্ত অধিবিদ্যা বিদরা সমানভাবে প্রমাণ করেছেন যে আত্মা সমগ্র অনন্ত জুড়ে ব্যাপ্ত রয়েছে। অনেক দিন বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যেমন মোটা হতে হবে এমন কোন আগ্রহ থাকে না, সেই রকমই কোন অধিবিদ্যা বিদরা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে তাদের যুক্তিগুলোকে প্রয়োগ করার দিকে লক্ষ্য করেন না। এটা অন্ধ হয়ে থাকার আকাঙ্ক্ষার এক আশ্চর্য ক্ষমতা যা অতি সমর্থ মানুষকেও ভুল যুক্তির পথে পরিচালিত করে থাকে যেটা না হলে সবকিছুই সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যেতো। যদি আমরা মৃত্যুকে ভয় না পেতাম, তাহলে আমি বিশ্বাস করি না যে কখনও অমরত্বের ধারণা গড়ে উঠতে পারত। ধর্মীয় মতের ভিত্তি হল ভয়, যা মানবজীবনে রাজত্ব করে চলেছে”। একই বই এর ৬৬ পৃষ্ঠায় তিনি আরো বলেছেন “ভয়াবহতাই ধর্মের মূল উৎস। সে কিছু কিছু ধরণের ভীতিকে মর্যাদা প্রদান করেছে এবং মানুষকে তাদের সম্পর্কে অশ্রদ্ধা করতে কখনও শেখায়নি। এই পথেই সে মানুষের জন্য সব থেকে বড় অকাজটি করেছে। সমস্ত রকম ভীতিই খারাপ (all fear is bad)। আমি বিশ্বাস করি যখন আমি মরবো তখন আমি পচব এবং আমার কোন রকম অহংকারই বেঁচে থাকবে না। আমি যুবক নই, এবং আমি জীবনকে ভালবাসি। কিন্তু মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ভয়ে কাঁপাটাকে আমার অবশ্যই ঘৃণা করা উচিত।”
তথ্য সূত্রঃ
১। কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই –বারট্রান্ড রাসেল, ভাষান্তর অরিন ভাদুড়ী, প্রকাশ কাল ফেব্রুয়ারী ২০২২।
২। লক্ষ্য ও পথ –আলডাস হাক্সলী, অনুবাদ মুহাম্মদ হাবীকুর রশিদ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫।
২। সেপিয়েন্স – মানুষের ইতিহাস মূলঃ ইউভাল নোয়া হারারি, ভাষান্তরঃ সুফিয়ান লতিফ, শুভ্র সরকার, রাগিব আহসান, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
৩। সত্যের সন্ধানে মানুষ – দেবপ্রিসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারী ২০১৬।
৪। বিশ্বাস ধর্ম যুক্তি – হাসান নাসির, প্রথম প্রকাশ একুশে বইমেলা ২০১৩।
৫। মিথের শক্তি – জোসেফ ক্যাম্পবেল, অনুবাদ খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, প্রথম বাংলা সংস্করণ ১৯৯৫, ঢাকা।
এডিট ও আপডেট হিস্ট্রিঃ ০১ফেব্রুয়ারী২০২৩>১৭ফেব্রুয়ারী২০২৩> ২৩মার্চ২০২৩> ৩০মার্চ২০২৩ > ৫এপ্রিল২০২৩> ১৮এপ্রিল২৩>১৭মে২৩> ২২মে২৩> ১৪জুন২৩> ০৫ডিসেম্বর২০২৩>
No comments:
Post a Comment