Wednesday, October 11, 2023

প্রায়োগিক বিদ্যাই প্রজ্ঞা (Applied knowledge is wisdom)

 

বিদ্যা, বুদ্ধি আর প্রজ্ঞা এক জিনিস না, অনেককেই দেখেছি এর ভেদ করতে পারেন না। আমিও পারতাম না যদি না শেখ তাকিউদ্দিন নাভায়ানীর “থট” বইটা পড়তাম। পুরটা পড়া হয় নাই কিন্তু যে টুকু পড়েছি তাতে বুদ্ধি কাকে বলা হয় তা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি। প্রজ্ঞা বা উইসডম তো সবাই জানে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আর বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে তার প্রয়োগ ক্ষমতা। তা হলে বুদ্ধি টা কি? শেখ তাকিউদ্দিন নাভায়ানী যে উদাহরণ দিয়েছেন তার থট বইয়ে তা এরকম, আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন কোন পাহাড়ি অঞ্চলে এবং দুরে দেখলেন পনির মত কিছু একটা রাস্তায় আছে। ভাবলেন ও আরে এমনকি, পানি তো থাকতেই পারে তাই স্বাভাবিক গতিতেই গাড়িটা চালিয়ে গেলেন কিন্তু ওটা আসলে পানি ছিল না ছিল তেল যার ফলে আপনার গাড়ি স্কিড করে খাদে পড়ে গেল। আপনি যদি সজাগ থাকতেন তবে গাড়ির গতি কমায়ে ওই জায়গাটা ধীরে পার হতেন। তার উদাহারনে এটাই হলো বুদ্ধি। তার মানে হলো আপনি সজাগ ছিলেন না, অবহেলা করেছিলেন। এই এলার্টনেস বা সজাগ থাকাই হলো বুদ্ধি। জ্ঞান (বিদ্যা) বা নলেজ হলো সাধারণ ভাবে Know how বা জানা। একজন দরজি সেলাই করতে জানে আপনি জানেন না তার মানে ওই দরজির সেলাই এর জ্ঞান বা বিদ্যা আছে, যা আপনার নাই। একজন কম্পিউটার চালাতে জানে আপনি জানেন না তার মানে আপনার কম্পিউটারের জ্ঞান নাই। দক্ষতা আবার ভিন্ন জিনিস। সেলাই মেশিন চালাতে চালাতে কার দক্ষতা মানে ওই মেশিন চালানর পারদর্শিতা বৃদ্ধি পাবেই আর তা পাবে তার অভিজ্ঞতার জন্যই আর সেটাই তার দক্ষতা। সুতরাং জ্ঞান ও দক্ষতার মধ্যে পার্থক্য হলো অর্জিত জ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে তাতে পারদর্শী হওয়া। এখানেই অভিজ্ঞতার মূল্য যা মানুষকে দক্ষ করে তুলে। অভিজ্ঞতাই মানুষকে অর্জিত জ্ঞানে দক্ষ করে তোলে কিন্তু অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান মানে বুদ্ধি নয় মোটেও। বরং বুদ্ধি হলো সজাগ থেকে অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করার সামর্থ্য। গুগল মামা বললেন অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে আছে the ability to acquire and apply knowledge and skills is intelligence, তাহলে তো বুদ্ধি আর প্রজ্ঞা একই হয়ে গেলে। প্রজ্ঞার সাথে বুদ্ধির ধারনার কোন সংযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। প্রজ্ঞার সঞ্জা হলো অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা। আর বুদ্ধি হলো সাধারণ ভাবে সজাগ থাকা যাতে পরিস্থিতির সাপেক্ষে সময় মত প্রজ্ঞাকে বাস্তবে প্রয়োগ করা যায়। আপনার প্রজ্ঞা কোন কাজেই আসবে না যদি না আপনি সজাগ বা সচেতন থাকেন। আমাদের শিক্ষকগণ এই সকল ধারণাগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে আমাদের শিক্ষা দেন নাই। তারা সবগুলোকে প্রায় সমার্থক ভাবে শিক্ষা দেয়াতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতা কে আলাদা আলাদা ভাবে সনাক্ত করতে পারেন বলে আমার মনে হয় না। এই সব ধারণাগত বিশৃঙ্খলাই পরবর্তীতে আমাদের প্রায়োগীক জীবনে মতভেদ ও ঝগড়া বিবাদের সৃষ্টি করে বলে আমার ধারণা। আমাদের স্কুল গুলোতে শারীরিক শিক্ষার একটা স্থান আছে কিন্তু মানুষিক শিক্ষার কোন জায়গা নাই। পুঁথিগত বিদ্যাগুলো ছাত্রদেরকে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করে থাকে অর্থাৎ Know how প্রদান করে কিন্তু বাস্তবে তা কি ভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা শিখায় না। আমাদের সময় বিজ্ঞানের বই এর বিভিন্ন জায়গায় ”এসো নিজে করি” বলে একাধিক বক্স থাকতো যেখানে এই প্রায়োগিক বিষয়গুলোর প্রতি শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করা হতো কিন্তু শিক্ষক গন তা গুরুত্ব সহকারে পড়াতেন না। পড়াতেন না কারণ তা পরীক্ষায় আসতো না। আজকালকার কারিকুলামে সৃজনশীল ব্যবস্থাটি মূলত মুখস্থ বিদ্যা থেকে ছাত্রদেরকে অধিকতর জ্ঞান অর্জনের দিকে নেয়ার উদ্দেশ্যে করা কিন্তু সেই প্রায়োগিক এসো নিজে করি বিষয়টি কিন্তু অন্তরালেই রয়ে যাচ্ছে। শুধু মুখস্থ বিদ্যা থেকে সরায়ে আনলে তার জ্ঞান বাড়তে পারে কিন্তু প্রজ্ঞা বাড়বে না। তার পাণ্ডিত্য বাড়বে কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা বা দক্ষতা বাড়বে বলে মনে হয় না। 

শৈশব থেকে কৈশোরে মানুষের মনের মধ্যে যে ভাব বৈচিত্রের ক্রিয়া কলাপ চলমান থাকে তা সম্পর্কেও স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে তাদের তেমন কিছুই শেখান হয় না। বিশেষ করে কৈশোরে যে পরিবর্তন গুলো আসে মানুষের মনে তার জন্য যে তাদের সাম্যক জ্ঞান প্রয়োজন তা যেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভুলে গেছে। তাই দেখা যায় স্কুল ড্রেস পড়া অনেকেই স্কুল ফাঁকি দেয়ে বিভিন্ন রেস্তোরায় বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এখন আসা যাক শিক্ষা বিষয়টি কিরকম। আমার চাকুরী জীবনের শুরু শিক্ষকতার ট্রেনিং দিয়ে। ওই ট্রেনিং এর সময়ই আমি দেখেছি যে আমার মধ্যে শিক্ষা প্রদানের একটা স্বাভাবিক ও সাবলীল দক্ষতা আছে যা আমার সাথে যারা ট্রেনিং এ ছিল তাদের মধ্যে অবর্তমান। আমি যেটা তিন বছর শিক্ষকতা জীবনে বুঝতে পেরেছি তা হলো শিক্ষক তার চিন্তাধারায় ছাত্রদের টেনে নিয়ে আসে, শিক্ষকের চিন্তাধারায় ছাত্ররা আবিষ্ট হয়ে যায় ও তার কাছ থেকে জ্ঞানের ধারার একটা ট্রান্সমিশন ঘটে আর এভাবে একজন শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান ছাত্রদের মনে প্রবাহিত হয়। শিক্ষককে তাই নজর রাখতে হয়ে যাতে তার বক্তব্য ছাত্রদের আকৃষ্ট করে। শিক্ষা প্রদানের টেকনিক্যাল না না কৌশল আমি ১৯৯৯ সালে এনআইআইটির শিক্ষক প্রশিক্ষণে শিখেছিলাম যার জন্য কৈশিক দা’র কাছে আমি ঋণী। ২০০২ তে যখন কমনওয়েলথ এমবিএ করলাম যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরগন ক্লাস নিতেন তখন দেখলাম তারা ওই সব টেকনিক ফলো করেন না। সোনালী ব্যাংকের ওরিয়েন্টেশন কোর্সে স্টাফ কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার আমাদের শিখিয়েছিলেন Learning/Training is function of ASK or L or T=f(ASK) where A=Attitude, S=Skill, and K=Knowledge । রাজার বাগের সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে যারা পড়াতেন তারা সিনিয়র ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিলেন।  কেউ কেউ ক্লাসে এসেই ৪৫ মিনিট নন স্টপ হ্যামারিং করে যেতেন, তিনি ওই বিসয়ে যা জানেন তা নন স্টপ বলে যেতেন আবার কামাল স্যারও ছিলেন যিনি গল্প করার ছলে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন। কবিতা কল্পনা লতা আপা ছিলেন একদম পারফেক্ট টিচার, অত্যন্ত ধীরে ছাত্রদের মন বুঝে তিনি পড়াতেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক প্রশিক্ষণে এত বিচিত্রতা প্রমাণ করে যে, এই ক্ষেত্রটাতে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে। শিক্ষক যত ভাল হবে জাতির পরবর্তী প্রজন্ম তত উন্নত ভাবে শিক্ষিত হবে।

আমার ভার্সিটি জীবনের এক বন্ধুর কথা বলি, সে নামাজী সেই তখন থেকেই আবার যখন সে পদার্থ বিদ্যায় পিএইচডি করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে তখন সে কেবল নামাজীই না বরং চরম রকম ধার্মিক। এমন ধার্মিক যে ফেইসবুকে কোন মেয়ের দেয়া পোস্টে লাইক দেওয়াও তার জন্য পাপ। সে ধার্মিক বটে কিন্তু দাড়ি রাখে নাই বিয়েও করে নাই। পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক কিন্তু পদার্থ বিদ্যা দর্শনে যে বিপুল প্রভাব ফেলেছে সে বিষয়ে সে একেবারে অজ্ঞ বা তা বুঝতে অসমর্থ। এরা পুথি গত বিদ্যায় পারদর্শী কিন্তু জীবন দর্শনে ক অক্ষর গো মাংস। নর্থ সাউথ ইউনিভারসিটির একদল তরুণ এক উপজাতীয় সংগীতের ফিউশন করে নতুন গান গাচ্ছে ছেলে মেয়ে সিঁড়িতে বসে, গানের এক পর্যায়ে একমাত্র ছেলেটা বাংলায় সেই উপজাতিয় ভাষার বাংলা অনুবাদটা একই গানের ছন্দে দারুণ ভাবে উপস্থাপন করলো। এই ভাইরাল ভিডিও দেখে আমার সেই প্রাক্তন বন্ধুর মন্তব্য ছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় নাকি অশ্লীলতার বিভাগ খুলেছে। পদার্থ বিদ্যায় পিএইচডি করা লোক যদি জীবন বিদ্যায় এতটা অজ্ঞ হয় তবে কি করে বলি তার প্রজ্ঞা আছে। জাফর ইকবালের মত প্রসিদ্ধ লেখক ও বিজ্ঞ ব্যক্তি সম্পর্কে তার রয়েছে মারাত্মক নিকৃষ্ট ধারণা। নিজেকে সে মহা পণ্ডিত মনে করে। এসব লোক শিক্ষিত হতে পারে কিন্তু তারা সমাজের বা তার নিজের জীবনেও তার বিদ্যাকে প্রয়োগ করতে অক্ষম। ওই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন না ”যথাসাধ্য ভালো বলে ওগো আরো ভালো কার স্বর্গ পুরি করে তুমি থাকো আলো? আরো ভালো কেঁদে বলে আমি থাকি হায় অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়।” এই সব লোকেরা অকর্মণ্য দাম্ভিক বটে। আমি যখন বলিউডের নায়িকা দীপিকা পাদুকনের থ্রি এল (লিভ, লাফ, লাভ) ফাউন্ডেশনের পত্রিকার সংবাদ কাটিং হোয়াটস এ্যাপ গ্রুপে পোস্ট করলাম তখন সে এডমিন মডারেটর হওয়ায় তা মুছে দিল তখন বুঝলাম ও মনুষ্যত্বই অর্জন করে নাই। থ্রি এল ফাউন্ডেশন ইন্ডিয়ার বিভিন্ন স্থানে লোকজনদের মানুষিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। মানুষের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে যেখানে শিক্ষাবিদরা কিছুই ভাবেন না সেখানে এঁরা উন্নত মানুষিক শিক্ষা প্রচারে প্রয়াস নিয়েছেন। এই মহৎ উদ্দেশ্যকে যে মানুষ দেখতে পায় না সে পিএইচডি করুক আর যাই করুক তার বাস্তব জ্ঞান শূন্যের কোঠায়। আমি তাকে কয়েকটা কটু কথা শুনায়ে গ্রুপ থেকে সরে আসি। ওকে বলেছি সে মানুষ হতে পারে নাই, আর মনুষত্বহীন দের গ্রুপে আমি থাকবো না। 

 অনেক আগে একটা মুভি দেখেছিলাম, নামটা বোধ হয় ছিল “দ্যা ল’স অব থারমোডাইনামিক্স” এক জটিল মুভি ছিল সেটা, পাত্র পাত্রীদের অভিনীত এক প্রেম কাহিনীর মধ্য দিয়ে থারমোডাইনামিক্সের সকল সূত্র সহ ফিজিক্সের মৌলিক সূত্রগুলোও বলে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে ডকুমেন্টারির মত তথ্যচিত্র ভাষ্যও আছে তাতে। এটা দেখে মনে হচ্ছিল একাধারে ডকুমেন্টারি, ড্রামা ও পদার্থবিদ্যার সকল সূত্রের এক ছন্দবদ্ধ উপস্থাপনা। জগত বিখ্যাত পদার্থবিদ মিচিও কাকুর ডকুমেন্টারি দেখে মনে হয়েছিল পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলো নতুন ভাবে জানলাম, আগে যা জানতাম তার থেকে উনার সরলীকৃত উপস্থাপনা গুলো মনোমুগ্ধকর তো বটেই তার চেয়েও বড় কথা তা মারাত্মক রকম অর্থবহ। তার ব্যাখ্যাগুলো পদার্থবিদ্যার অনেক জটিল বিষয় অত্যন্ত সহজ করে বুঝতে সহায্য করেছে তাও কিনা মাত্র ৪৫ মিনিটের ডকুমেন্টারিতেই। উনি স্ট্রিং থিউরির উপর বেশ কিছু সূত্ররও প্রবর্তন করেছেন। একবার আমি খুব ধাঁধাঁয় পরে গিয়েছিলাম বল, শক্তির পার্থক্য নিয়ে মানে হলো এনার্জি আর ফোর্স এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারছিলাম না। আমাদের ক্লাস সিক্সের বই এ কার্য, শক্তি, ক্ষমতা নিয়ে একটা অধ্যায় ছিল, ওই অধ্যায়টার কথা মনে করে মাথাটা আরো গোলায়ে গেলো। আমার বার বার মনে হচ্ছিল বল আর শক্তি বুঝি একই। শক্তির নিত্যতা তো আমরা পড়েছি, যা বলে শক্তি এক অবস্থা হতে ভিন্ন অবস্থায় রূপান্তরিত হলেও মোট শক্তি একই থাকে, তা হলে বল বা ফোর্স বলতে আমরা কি বুঝি আর শক্তি বলতে মূলত কোন বিষয়টিকে বলা হয়? এই ধাঁধাঁটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তো আমার সেই গ্রন্থ গর্ধব বন্ধুটি তখন কর্জন হলে পিএইচডি করছে আর তার সাথে ঘটনা ক্রমে আমার দেখা হয়ে যায়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করায় সে হেসে বললো এগুলো তো ক্লাস সিক্সের বই এই আছে। কিন্তু আমার চিন্তার জট ছুটানোর মত কিছুই বললো না। এই ঘটনার বহু বছর পর আজ যখন অ লিটিল বুক অব স্ট্রিং থিওরি, স্টিভেন স্কট গাবসার অনুবাদঃ আবুল বাসার বইটা পড়ছি তখন হটাতই জটটা খুলে গেল। আরে আমরা তো ফোর্স কি তা জানি, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রই তো তা বলে দেয় বল=ভরবেগ ও ত্বরণের গুণফল (F=ma) আর শক্তির সূত্র তো আইনস্টাইনের ই=এমসি স্কোয়ার (E=mc2) এই বলা আছে। শক্তি হলো কোন ভরের আলোর বর্গ গতিতে সরণ আর ভর হলো বস্তুর মধ্যে সকল প্রোটন সংখ্যার ভরের সমান। বস্তুর স্থানান্তর কিংবা সরণ বা ত্বরণ হলো তার মধ্যস্থিত স্থিতিশক্তিকে গতিশক্তিতে রূপান্তর প্রক্রিয়া। আর বল হলো ভরের সরণ আর ত্বরণের গুণফল। প্রকৃতিতে যে চারটি বল আছে তা কেন আছে কেউ জানে না কিন্তু তা আছে, যথা ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক বল, মহাকর্ষ বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল আর সবল নিউক্লিয় বল। নিউটনের প্রথম গতির সূত্রই বলে দিচ্ছে কোন বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন হয় না বা তার গতিবেগের পরিবর্তন হয় না যতক্ষণ না তাতে কোন একটা বল প্রযুক্ত হয় বা কার্যকর হয়। আমার বন্ধুটি আজ শিক্ষকতা করে ও আমাকে সেদিন এই কথা গুলো কেন বললো না? ও যদি সহজ মনের হতো তবে একটা খালি কাগজ নিয়ে উপরের দুটো সূত্র লিখে একটা পেন পিকচার একে আমাকে সব বুঝায়ে দিতে পারতো। তা না করে সে হাসলো আর বললো এটা কোন বিষয়ই না। ওর জায়গায় মিচিও কাকু হলে তিনি উপরের চারটা লাইনে আমার মনের জটটা খুলে দিতেন যা ও করে নাই। ও যে শিক্ষকতা করে তাও কি এভাবেই করে? মানে ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তরে বলে দেয়, ও ওটা? সেটা তো ক্লাস সিক্সের বই এই আছে, ওটা দেখে নিও। আমার চাকুরী জীবনের শুরু শিক্ষকতা দিয়ে আগেই বলেছি, আমি জানি শিক্ষকতার কৌশলগুলো। আমার প্রথম চাকুরীদাতা দেভজিত সরকার সিলেটে কম্পিউটার ট্রেনার হিসেবে আমাকে পাঠানোর আগে শুধু একটা কথা কানে কানে বলে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন যদি কোন ছাত্র এমন একটা প্রশ্ন করে যা আপনি জানেন না তবে সরাসরি জানি না বলবেন না, বরং বলবেন বিষয়টা আমি একটু ভেবে নিয়ে তোমাকে কালকে জানাচ্ছি। উনার সেই পরামর্শ আজো আমি অনুসরণ করি যখন ব্যাংকিং সম্পর্কে কেউ কিছু জানতে চায় আমার কাছে। একজন শিক্ষক কখনই ছাত্রকে বা যে জানতে চাচ্ছে তাকে বলতে পারে না, ও এটা জানতে চাচ্ছো, ওটা তো ক্লাস টেন এর বইতেই আছে। এই সব প্রফেসর নামধারী গর্ধবেরা সেই সকল কৌশল না শিখেই শিক্ষকতা করছে দেখে শত শত গাধা টাইপ গ্র্যাজুয়েট পয়দা হচ্ছে আমাদের দেশে। মিচিও কাকু দের দেখলে বুঝা যায় তারা কতটা জ্ঞানী, তাদের বক্তব্য কতটা সরল ও বাস্তব সম্মত। স্টিভেন স্কট গাবসার তার অ লিটিল বুক অব স্ট্রিং থিওরি তে কত সহজ উদাহারণ ব্যবহার করে পদার্থবিদ্যার জটিল বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেছেন সাধারণের বুঝার উপযোগী করে অথচ আমার সেই বন্ধু যাকে আমি ত্যাজ্য করেছি সে তার দাম্ভিকতাতেই বাচে না। এরূপ বন্ধু থাকার চেয়ে না থাকা ভালো, এরকম গ্রন্থ গর্ধবরা যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে সেই সকল বিশ্ববিদ্যালয় থাকার চেয়ে না থাক আরো ভালো। ওই যে বলে না দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো, বিষয়টা ওই রকম।

আমার জীবনে বিদ্যার প্রয়োগের কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি, হতে পারে তা অতি সামান্য কিন্তু তা বিদ্যা ও বুদ্ধির প্রয়োগ বটে। (১) ৫০০ মিলি পানির বোতলঃ আমি যখন সোনালী ব্যাংকের এমডিস স্কোয়াডে কর্মরত তখন আমার টেবিলে ৫০০ মিলি পনির বোতল দেখে আমার স্বাস্থ্যর অবস্থা বুঝার চেষ্টা করতাম। মানে হলো যেদিন শরীরটা খারাপ সেদিন দেখতাম বোতলটা দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে আর যেদিন দেখতাম খালি হতে সময় নিচ্ছে বুঝে নিতাম শরীর পানি ধরে রাখতে পারছে আর আমি অপেক্ষাকৃত সুস্থ আছি। (২) ইয়ার প্লাগ ফোনে সাউন্ড ভলিউম এর উঠানামাও একটা ইনডিকেটর বটে। যে সময় অনেক উচ্চ ভলিউম লাগে গানটা মনে প্রবেশ করাতে তার মানে মন অনেকটাই বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে আর যখন মনটা শান্ত তখন কম ভলিউমেও গানটা ঠিকই মন ছুঁয়ে যায়। বিষয়গুলো আমার ধারণা কিন্তু এই ধারণা গুলো আমার বিদ্যা ও বুদ্ধির প্রয়োগের ফলে প্রাপ্ত ধারণা। তাই এগুলোকে প্রজ্ঞা বলা যায়। আরেকটা মজার কাজ করতাম এমডিস স্কোয়াডের কম্পিউটার সেলে, যেহেতু আমি কম্পিউটার ইনচার্জ ছিলাম তাই ঠিক সম্মুখভাগটায় বসতাম আর গান শোনার নামে কানে ইয়ার প্লাগ লাগায়ে গান না শুনে কারা কি বলছে শুনতাম, যদি কেউ আমার সম্পর্কে কিছু বলে এই ভেবে যে আমি তো কান বন্ধ করে গান শুনছি, আসলে আমি ইয়ার প্লাগ করেও তাদের কথা শুনতে পেতাম। এবার আমার জীবন রক্ষাকারী একটা প্রজ্ঞার কথা বলবো। ঘটনাটা ছিল ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কোন এক শিতের রাতে অফিস শেষে বাসায় ফিরে খাওয়ার পরে ভোর ৩ টার দিকে ভীষণ পেটে ব্যথা ও বুকে ব্যথা অনুভব করলাম। সাধারণত এন্টাসিড সিরাপ খেলে এরকম ব্যথা চলে যায় কিন্তু তা যাচ্ছিল না, বরং ঘাম হচ্ছিল। মাকে ডেকে উঠালাম, মা আমার ডাক্তার বড় মামাকে ফোন করতে বললো, মামা শুনে বললো হৃদরোগ হাসপাতালে যা আমার শ্যাওড়াপাড়া বাসা থেকে কাছে ওখানে যেয়ে একটা ইসিজি করাতে। সাথে সাথে আমি বিষয়টা ধরতে পারলাম। মামা ইসিজি করতে বলছে কারণ কয়েক দিন আগে মেঝ মামার এ রকম হয়েছিল আর তার পর ইসিজি করার পর ধরা পরে তার একটা ভাল রকম হার্ট এটাক হয়ে গেছে। আমার মনে পড়লো আমার বাবা ৪৮ বছর বয়সে হার্ট এটাকে মারা যান, তার বাম হাতে চিড়িক দেয় উঠতো তাও আমি সেই ছোট বেলা থেকেই তা দেখেছি। আমার বুকের ব্যথাটা বাম হাতে ছাড়ায়ে গিয়েছিল। আমি মাকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ হার্ট ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমি মাকে নিয়ে ওখানে আগেও গিয়েছি তাই জানতাম হৃদরোগের চেয়ে ওখানের ইমারজেন্সিটা অনেক প্রম্পট চেকআপ করে আর রুগী হার্টের না হলে ভর্তি নেয় না। ভোর রাতের রাস্তায় একটা মাত্র রিক্সা তাতে মাকে নিয়ে উঠে রওনা হলাম হার্ট ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্যে। আমি বুকের ব্যথাটার পিন পয়েন্ট ও বাম হাতে ছড়ায়ে যাওয়ায় বুঝতে পারছিলাম এটা আমার পারিবারিক হার্ট সমস্যা। দ্রুত হার্ট ফাউন্ডেশনের ইমারজেন্সিতে গিয়ে ইসিজি করালাম, ওখানকার ডাক্তার গুরুত্ব দিচ্ছিল না আর উপর থেকে ইসিজি করাতে কিছুই ধরা পরে নাই। আমি বললাম আমার বুকের ব্যথা যায় নাই, তখন তারা আমার পিঠের দিক থেকে আরেকবার ইসিজি করলো, ওটা করার পর পরই তাদের কন্ঠ পরিবর্তন হয়ে গেল বললো আমরা আপনাকে ভর্তি নিচ্ছি। এর পর ওরা আমাকে সোজা আইসিইউতে নিয়ে যায় ও জীবন রক্ষাকারী ইনজেকশনটা দেয়। ওই ইনজেকশন দেয়ার পর পরই আমি টের পাই আমার বুকের বাম দিকের ও বাম হাতের ব্যথাটা বুকের মাঝখানে আসলো তার পর তা ডান হাতের দিকে ছড়ায়ে গিয়ে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল। তার পর আমি ঘুমায়ে যাই। এই পুরো ঘটনায় আমার অভিজ্ঞতা, জ্ঞান বা বিদ্যা, ও বুদ্ধি সবই আমি প্রয়োগ করেছি। আমার প্রজ্ঞাই আমাকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে চালিত করেছে। বিশেষ মুহূর্তে মানুষের সব কটি ইন্দ্রিয় এভাবে সজাগ হয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধির পরিচায়ক। তৎপরতাই বুদ্ধি আর বাস্তবতার সমস্যা সমাধানে বিদ্যার প্রয়োগই প্রজ্ঞা।

বিদ্যার প্রয়োগ সম্পর্কে ছোটবেলায় শোনা বায়েজিদ বোস্তামীর বা ইমাম গাজ্জালীর সেই গল্পটা মনে পড়ে যায়। মা কাপড়ে সেলাই করে টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন আর সে কয়েকটা বই সব সময় বুকে জড়ায়ে রাখতো তো যখন ডাকাত দল ট্রেন আক্রমণ করলো তখন সে সেলাই করা গোপন জায়গা থেকে টাকা বের করে দেয়ায় ডাকাত সরদার তার সততায় মুগ্ধ হয়ে তার টাকা ফেরত দিয়ে দেয় আর তার বুকে ধরে রাখা বইগুলো নিয়ে নিয়ে বলে যে, বই বুকে নয় বরং এর বিদ্যা মাথার মধ্যে রাখতে হবে যা কেউ শত চেষ্টা করেও কেড়ে নিতে পারবে না। আমাদের দেশের শিক্ষা নীতির উদ্দেশ্য তাই হওয়া উচিত বিদ্যা অর্জন নয় বরং প্রজ্ঞা অর্জন। যে বিদ্যা বাস্তবে প্রয়োগ করা যায় না সেই বিদ্যা শিক্ষার কোন দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। তাই বলছিলাম প্রায়োগিক বিদ্যাই প্রজ্ঞা যাকে ইংরেজিতে বলা যায় Applied knowledge is wisdom, but applied where? in the real life context. সংক্ষেপে তাই বলা যায় “বাস্তবতার সমস্যায় প্রয়োগকৃত জ্ঞানই প্রজ্ঞা”।

আমার লেখা গুলো আসলে কি ধরনের তা নিয়ে আমিও চিন্তা করেছি বেশ, আমার মনে হয়েছে এগুলো আমার ব্রেইন স্টরমিং টাইপের আত্মকথা। সেই ছোট বেলা থেকেই আমি নিজের সাথে কথা বলি, নিজেকে দুই পক্ষ করে কথা বলে চিন্তা করার অভ্যাসটা মূলত কোন বিষয়ে ভালো করে বুঝে দেখার একটা মানবিক প্রক্রিয়া বা কৌশল মাত্র। সেই আত্মকথা গুলো আমি এক সময় লিখে রাখতাম। তবে সেগুলো এতই অগোছালো ছিল যে কারো কাছে প্রকাশ যোগ্য ছিল না। সংকোচ বোধও ছিল অনেক। এখনকার লেখাগুলো গোছালো ও অপরকে পড়তে দেয়ার মত পরিচ্ছন্ন। যখন অপরকেও আমার কথাগুলো পড়তে দেয়া হবে এই মনোভাব নিয়ে লেখা হয় তখন তা পরিচ্ছন্ন না করে উপায় থাকে না। তাতে চিন্তার গাঁথুনিও মজবুত হওয়া লাগে। যারা পড়ে তারা উপক্রিত হয় কিনা জানি না কিন্তু আমার চিন্তার স্বচ্ছতা আরো স্পষ্ট হয়। তাই আমার লেখা পড়া মানে আমার মনোজগতে আপনাকে স্বাগতম।

এডিট ও আপডেট হিস্ট্রিঃ ০২অক্টবর২০২৩> ০৬অক্টবর২০২৩> ০৮অক্টবর২০২৩ > ১১অক্টবর২০২৩> ২৫অক্টবর২০২৪>

No comments:

Post a Comment