Wednesday, June 28, 2023

দাবার ঘোড় দৌড় ও আমার আত্ম বিশ্বাস

 

আমার এক কলিগের বিয়ের কার্ডে তার বাড়ি মুন্সিগঞ্জ যা আমার দেশের বাড়ি জানতে পেরে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম মুন্সিগঞ্জ এর কোথায়? সে বললো ঘোড় দৌড়, শুনে খুব অবাক লাগলো, এই নামে মুন্সিগঞ্জে গ্রামও আছে? আশ্চর্য। অবশ্য মুন্সিগঞ্জের গ্রামের নাম পয়সা বা পয়সা গাও এরকমও আছে। ঘোড় দৌর বা হর্স রেস নামে নামকরণ করা আছে আমার জীবনের স্মরণীয় এক দাবা খেলার। আমি ছোটবেলায় একা একা বড় হয়েছি, মাঠের খেলা তেমন একটা খেলার সুযোগ পাই নাই কিন্তু দাবা খেলা সেই শৈশব থেকেই আমাকে দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করত। তখন গ্র্যান্ড মাস্টার রানি হামিদ আর নিয়াজ মোরশেদের কথা প্রায়ই পত্রিকাতে আসতো আর এই দাবা খেলার প্রতি আমার আগ্রহও তখন প্রচুর ছিল। দাবা খেলায় একটা আশ্চুর্য় ঘটনা টিভির খবরে দেখিয়েছিল সেই সময় যেখানে গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ মোরশেদ চোখে কাপড় বেধে পর পর ৮ জনের সাথে একনাগাড়ে দাবা খেলে গেছেন। এটা দেখে আমি যার পর নাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যখন ক্লাস  ফাইভে পড়ি তখন মালিবাগের নানীর বাসায় আমাকে একা রেখে মা চলে গিয়েছিলেন লিবিয়ায় বাবার কাছে। আমি তখন ছোট মামা বা রাঙ্গা মামা আর মেঝ মামা, আমার লাল মামার সাথে দাবা খেলতাম।  লাল মামা সৌন্য আগে বাড়িয়ে ছাতার মত করে বলতো এই দেখ বুহ রচনা করেছি। আর ছোট মামা নির্দিষ্ট করে বলে দিয়ে খেলতো, বলতো তোমাকে আমি ওই জায়গায় আসতে বাধ্য করব তার পর ওই পনটি বা পিসটি তোমাকে হারাতেই হবে, তা তিনি করেও দেখাতেন। দাবা খেলার উপর রানি হামিদের লেখা বইও কিনেছিলাম যা থেকে কিভাবে দাবা খেলা লিখে রাখা যায় তা শিখেছিলাম। আমার কৈশোরের একটা মাত্র একটা দাবা খেলা আমার জন্য চরম একটা অভিজ্ঞতা দিয়েছিল যার কথা এখানে আমি বলবো তার আগে বলে নেই আমি দাবা খেলা যে খুব ভাল খেলতাম তা নয়, তবে প্রচুর খেলতাম তা বলা যায়। দাবা খেলা প্রচুর সময় সাপেক্ষ হলেও তা পুরটাই মনস্তাত্ত্বিক ও বেশ চেলেঞ্জিংও বটে। ছোট বেলায় যখন লিবিয়ায় ছিলাম, তবরুখ শহরে বাবার অফিসে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল দুইবার। বাবা তবরুকের পাওয়ার প্ল্যান্টে চাকুরী করতেন। ওখানে উনি তার কলিগদের সাথে অবসরে দাবা খেলতেন। ওখানেই প্রথম পকেট দাবা দেখি। এক বুলগেরিয়ান আংকেল বাবাকে একটা পকেট চেস গিফ্ট করেছিল, ওই ছোট্ট দাবাটি আমি বহুকাল সংরক্ষণ করেছিলাম। তার কয়েকটা গুটি হারায়ে যাওয়ার পরও অন্য একটা পকেট দাবা’র গুটি দিয়ে ওই দাবার সেটটি পূর্ণ করে তা দিয়ে দাবা খেলেছি।  

আমাদের দোতালা বাসার পাশে একতালা বাসায় থাকতেন জনতা ব্যাংকের ম্যানেজার অলি আহমেদের পরিবার তার তিন ছেলেমেয়ে সহ। ইরানা আপু, নকভী ভাই আর রিজভী। আমি পড়াশুনায় বেশ ভাল রকমের ফাঁকিবাজ ছিলাম। দুই দিকে পড়ার বই এর পাহার রেখে মাঝখানে পকেট দাবার বোর্ড রেখে খেলতাম যখন সামনে পড়ার বই খোলা থাকতো। একদিন মা’র কাছে ধরা পড়ে গেলাম। মা চিৎকার করে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলছিল “দেখ দেখ তোমার ছেলে বই এর নিচে দাবা রেখে খেলছে।” ওইদিন রাতে ইরানা আপু একা একা হাঁটছিল পাশের ছাদে, ছাদটা আমার পড়ার ঘরের পাশে, উনি এই কথা শুনে নাকি অনেক হেসেছিলেন। পরে জানতে পারি সেই কথা। ইরানা আপু বুঝতে পারেন নাই যে বই এর নিচে দাবা রেখে কি ভাবে খেলা যায়। মা যত আমাকে বকা ঝকা করত আমার জেদ তত বেড়ে যেত, আমি এর পর কাগজের দাবা বানিয়েছিলাম, মানে হলো দাবার বোর্ড কাগজের আর বোড়ে আর পিস গুলোও দ্বিমাত্রিক কাগজের, তা দিয়ে খেলার চেষ্টা করেছিলাম। তবে এ সবই ঘটেছিল সেই ক্লাস ৫ কি ৬ এ পড়ার সময়। শ্যাওড়াপাড়ায় থাকাকালীন এলাকার অনেককে নিয়ে দুই বার দাবা টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছি। দাবা খেলা গুলো লিখে রাখার ব্যবস্থাও করেছিলাম সেই সময়। একটা বিষয় দেখতাম অনেকের সাথে দাবাতে আমি জিততে পারলেও কার কার সাথে আমি কখনই পারতাম না। যাদের সাথে পারতাম না ও’রা যে পড়াশুনায় চৌকশ তা’ও নয় তবে দাবা খেলায় তারা দারুণ দুর্দান্ত। একবার সংসদ ভবনে গিয়েছিলাম বন্ধদের সাথে বেড়াতে, তখন সংসদ ভবনটার চত্বরগুলো উন্মুক্ত ছিল সবার জন্য, তাই আমরা প্রচুর যেতাম ওখানে, সাইকেল নিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রচুর গিয়েছি লুইস আই কান এর নির্মিত মাস্টারপিস আর্কিটেকচার আমাদের সংসদ ভবনের চত্বর গুলোতে। একদিন দেখলাম দু জন দাবা খেলছে তো আমি বসে গেলাম একজনের সাথে। ওই খেলাতে আমার খেলার ঘোড়ার চালগুলো দিয়ে আমিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। অতি দ্রুত বিপক্ষকে হারায়ে দিয়েছিলাম সেদিন। মঠের খেলা গুলো মানুষকে অনেক কিছু শেখায় তবে ইনডোর গেইম গুলোও কম যায় না। দাবার একেকটা বোর্ড একেকটা স্ট্রেটিজিক পজিশনিং। যুদ্ধক্ষেত্রে ঠিক এরকম অবস্থারই সৃষ্টি হয়। যদিও এখনকার যুদ্ধগুলো ত্রিমাত্রিক যুদ্ধ আর অনেক জটিল কিন্তু ক্ষমতার টানাপড়েনে ঠিক দাবার মতই হয়। যারা দাবা খেলে তদের স্ট্রেটেজি সম্পর্কে ও পরিস্থিতির সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা হয়। এটা বাস্তব জীবনে কাজে আসে অবশ্যই। 

১৯৯০ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি পড়ার সুযোগ হয় আমার। ওই সময় টিফিন টাইমে অনেকেই ভলি বল খেলতো, ছোটবেলায় কেউ আমাকে ভলি বল খেলা শিখায় নাই বা আমি ওদের সাথে যোগ দিতে দ্বিধা বোধ করতাম। দু এক বার যে চেষ্টা করেছি তা নয়, তবে ভাল পারতাম না। তাই দুরে মাঠে যেয়ে বসে থাকতাম। ওখানে আরেকজন বন্ধুও জুটে গেল যে দাবা খেলে। তবে সে আয়াসের সাথে খেলতো, মানে হলো আমি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আর সে শুয়ে শুয়ে আয়েস করে খেলতো। আমি প্রথম কয় দিন ওর কাছে হেরে গেলাম। হারার কারণটা আমি তৃতীয় দিন বুঝে গেলাম, ও যে কোন ভাবেই হোক আমার চেয়ে এক পয়েন্ট মানে হলো একটা বড়ে আগায়ে যেত তার পর সমান সমান পিস গুলো বাদ করে দিলে ও’র জিতা ঠেকায় কার সাধ্য। এই কৌশলটা বুঝতে পেরে আমি পরের দিন আর ও’কে সেই সুযোগ দিলাম না আর খেলায় জিতে গেলাম আর বললাম যে তোমার কৌশলটা আমি ধরে ফেলেছি তাই এর পর থেকে আমাকে আর অত সহজে হারাতে পারবা না। এই কথা শুনে সে উঠে বসলো, দারুণ ভাবে তার আত্মসম্মানে তা আঘাত করেছে বুঝা গেল। সে আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো। আমি বললাম ঠিক আছে বেট যদি লাগতেই হয় তবে কি নিয়ে হবে। ও বলল একটা কোকাকোলা খাওয়াবে যে জিতবে। আমি রাজি। শুরু হলো সেই দুর্দান্ত দাবা যুদ্ধ। এবার দুজনেই প্রচণ্ড গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে খেলাটাকে। খেলার মাঠ থেকে খেলাটা ক্যান্টিনে নিয়ে যাই অর্ধের খেলার পর ওখানে অনেকের ভিড় হয়ে যায় আমাদের মধ্যে গুরুত্বের আতিশয্য দেখে। এর মধ্যে আমার এক বন্ধু আসে যে আমার সাথে প্রায়ই হেরে যেত। সে যখন শুনলো এটা একটা চ্যালেঞ্জ গেম তখন সে বিপক্ষকে আমাকে দেখিয়ে বলেছিল ও যখন বলছে তবে তুমি নিশ্চয়ই হারবে। এটা শুনে রাসেলের বন্ধু ক্ষেপে গিয়ে কয়েকটা চাল পর পর দিয়ে খেলার মোড়টাই এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেল যে পুর খেলাটা য়েন্ড গেমে চলে গেল আর তার পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেল। খেলার সময় রাসেলও তার বন্ধুর পাশে এসে বসেছিল, এরকম ভরা মজলিশে হেরে যেয়ে যার পর নাই অপমানিত ও দুঃখিত হয়েছিল রাসেলের সেই বন্ধুটি। এতটাই যে আমাকে কোক দেয়ার কথা ভুলেই গেল। আমিও জিতে বেশ বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম তার কিছুক্ষণ পর রাসেল ও তার বন্ধ আমার জন্য কোকাকোলা নিয়ে আসে। আমি নিতে অস্বীকার করার পর নিয়েই নিলাম। টান টান উত্তেজনায় পুর খেলাটা হয়েছিল। খেলাটা আমার মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে, চারদিন মাথার মধ্যে ঘুরেছিল ওই খেলা, চতুর্থ দিন খেলাটা লিখে রাখি। লেখা থাকার কারণে আজ ৩৩ বছর পরও খেলাটা খেলা যাচ্ছে। খেলাটায় আমার ঘোড়ার চাল গুলো খুব মারাত্মক ছিল বলে এর নাম ঘোর দৌর বা হর্স রেস দিয়েছিলাম। নিচে খেলাটা উল্লেখ করে তার কয়েকটা বোর্ড সংক্ষেপে আলোচনা করবো। অনেকই গান গাইতে পারে না কিন্তু তারা ঠিকই গান শুনে মজা পায়। যারা গান গায় তারা পুর মজাটা নেয় ঠিকই কিন্তু যারা শুনে তারাও কম মজা পায় না। তেমনি অনেকেই হয়তো দাবা খেলতে পারেন না কিংবা দাবা খেলায় মজা পান না কারণ তারা দাবা খেলার মজাটা নিতে জানেন না। তাই আমি এমন ভাবে বর্ণনা করবো যাতে সবাই দাবা খেলাটা উপভোগ করতে পারেন। 

১৬ মে ১৯৯০ আমি কালো আর রাসেলের বন্ধু সাদা

1.c4  e6

2. Nc3   Na6

3. d4      Nf6

4. Nf3    Bb4

5. Bd2    0-0

6. a3       Ba5

7. e3       c6

8. Bd3    d5

9. c5      Nb8

10. 0-0   Nh5

11. Qc2  g6

12. b4     Bc7

13. b5     Nd7

 

14. Rb1   e5

15. b6      aXb

16. cXb    Bb6

17. Na4    e4 @

18.NXBb6 Nb6

19. Be4    dXe4

20. Qe4   Ra3

21. Bb4   Bf5

22. Qe7  Nd5

23. Qd8   Rd8

24. Ba3   Bb1

25. Rb1   Ra8

26. Bd6   b5

 

27. H3   Nc3

28. Rb2  Nf6

29. Kh2  KNe4

30. Bb4   Nd1

31. Rc2   Ndf2

32. Rc6    Ra1

33. RC8+ Kg7

34. Bf8+  Kf6

35. Rc6+  Kf5

36. Nh4+  Kg5

37. Nf3+   Kh5

38. G4+     Ng4

39. Hg4+   Kg4

 

40. Kg2    Ra2+

41. Kg1   Kf3

42. Rc1   Ng3

43.Rf1+   NXR

44. Kh1   Ng3+

45. Kg1   Rg2++

(),!)

 

 

আমার যতদূর মনে পড়ে ৩৬ চালেই খেলাটার জয় পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়, তার পর রাসেলের বন্ধু রিজাইন করে। ৩৬ থেকে ৪৫ চালগুলো প্রায় নিশ্চিত ভাবে হতে বাধ্য তাই ওগুলোও লিখে রেখেছিলাম। ভরা মজলিশে এভাবে হেরে যেয়ে জানি না রাসেলের সেই বন্ধুর কেমন লেগেছিল কিন্তু চ্যালেঞ্জ করে খেলে জিতে আমার আত্মবিশ্বাস কেউকারাডং বা তাজিং ডং সম উচ্চে উঠে গিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। 

ওপেনিং অবস্থায়  ১০ম চালের বোর্ড

আমি কাল নিয়ে খেলছিলাম দেখে বোর্ডটা উল্টো করে বসান। দু জনই সিরিয়াস তাই দেখেন কি অবস্থা ওপেনিংটাই হয়েছিল দারুণ ব্যতিক্রম। দু জনই কেসলিং করে যার যার ডিফেন্স পাকা পোক্ত করেছে। আমার তো ও’র কৌশল জানা ছিল তাই আমি খেয়াল রাখছিলাম ও যেন কোন ভাবেই এক পয়েন্টও আগে যেতে না পারে। আমি অনেকটা ডিফেন্সিভ মোডে খেলেছি আর ও এ্যাটাকিং মোডে। সি কলামে ও বোড়ে পঞ্চম রো পর্যন্ত নিয়ে গছে আমি বাধা দেই নাই। কারণ খেলা তো সবে শুরু। ও’র দুটো ঘোরাই সামনে বাড়ান, হাতি দুটাও কার্যকরী ভাবে সক্রিয় হয়ে গেছে। এদিকে আমার একটা হাতি আর ঘোড়া সামনে বাড়ান। ওপেনিং অবস্থায় দুজন পাকা পোক্ত ভাবে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। অবস্থাটা মুখোমুখি কেউ কার পিস বা পন এখনও হারায়নি।

এর পরই শুরু হবে সংঘর্ষ সেটাই মধ্য গেইম বা মিড গেইম আর এই মিড গেইমেই জয় পরাজয় প্রয় নিশ্চিত হয়ে যায় বেশির ভাগ খেলাতে। এন্ড গেইমে কম খেলাই যায় আর যেগুলো যায় সেগুলো দেখার মত হয়। নিচে ১৭ তম চালের বোর্ড আর তখনও মিড গেইম শেষ হয় নাই তবে আক্রমণ চলেছে। খেয়াল করলে দেখবেন আমি ই কলাম রো ৪ এ মানে ই৪ বোড়ে দিয়ে ও’র হাতিকে আক্রমণ করেছি আর ও ও’র ঘোড়া দিয়ে আমার কলাম-বি–রো-৬ এর হাতিকে আক্রমণ করেছে। মানে হলো আমি যদি বোড়ে দিয়ে ও’র হাতি খাই তবে ও ও’র ঘোড়া দিয়ে আমার হাতি খেয়ে দিবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমার মন্ত্রী আবার তার ঘোড়াকে খেতে পারবে আবার আমার ডি৭ এর ঘোড়াও ও’র ঘোড়াকে খেতে পারবে। তখন যদি বি১ এর নৌকা দিয়ে ও আমার ঘোড়া খেয়ে দেয় তবে মন্ত্রী দিয়ে আমি ওর নৌকা খেয়ে দিব আর তা হলে ওর ক্ষতি বেশি হবে। 

মিড গেইম অবস্থায়  ১৭ তম চালের বোর্ড

আমার কাল ঘরের হাতিকে ও নৌকা দিয়ে আর ঘোড়া দিয়ে আক্রমণ করেছে অথচ হাতিটাকে সাপোর্ট দিচ্ছি আমি ঘোড়া আর রানি দিয়ে বা যাকে বাংলায় মন্ত্রী বলে। ও যদি ঘোড়া দিয়ে আমার হাতি খায় আর আমি যদি মন্ত্রী দিয়ে ও’র ঘোড়া খাই তবে ও অনায়াসে ও’র নৌকা দিয়ে আমার মন্ত্রী খেয়ে ফেলবে। নৌকার পয়েন্ট হলো ৫ আর মন্ত্রীর হলো ৯ আমি ৪ পয়েন্ট পিছায়ে যাবে। যেখানে এক পয়েন্ট এদিক ওদিক হলেই জয় পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায় সেখানে এই রিস্ক নেয়াটা চরম বোকামি। তাই ঘোড়া দিয়ে আমিও হাতির সাপোর্ট বাড়িয়েছি যাতে যদি খাওয়া খাওয়ি হয় তবে সমান সমান ক্ষতি হবে দুজনের। দাবা খেলায় ঘোড়ার চাল গুলো সব থেকে মারাত্মক। একসাতে আট জায়গায় ছোবল মারে ঘোড়া। বসে থাকে এক জায়গায় কিন্তু এক দুই আড়াই ঘরে সে যেখানে সেখান থেকে চারদিকে আক্রমণ করে। তাই ঘোড়ার চাল গুলো বুঝা দাবা খেলায় গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। 

এই বোর্ড থেকেই ও’র কৌশল ভেস্তে যায়। ও আমার বি৬ এ থাকা কাল ঘরের হাতিটা ঘোড়া দিয়ে খেয়ে দেয় আমিও ও’র ঘোড়াটা আমার ডি৭ এ থাকা ঘোড়া দিয়ে খাই। এর পর ও আমার বোড়ে দিয়ে আক্রান্ত ডি৩ এর হাতিটা দিয়ে আমার বোড়ে খেয়ে দেয় আর আমি বোড়ে দিয়ে ওর হাতিটা খাই, ও তখন মন্ত্রী দিয়ে আমার বোড়েটা খায় এতে করে আমি ১ পয়েন্ট আগায়ে যাই। তার পরের চালে আমি নৌকা দিয়ে ও’র এ৩ এর বড়েটা খাই ও আরো ১ পয়েন্ট আগায়ে যাই। ও ও’র কাল ঘরের হাতি দিয়ে আমার দুই নৌকাকেই আক্রমণ করে আর আমি আমার সাদা ঘরের হাতি এফ৫ এ নিয়ে গিয়ে ওর মন্ত্রীকে আক্রমণ করি। বিষয়টা পাল্টা পালটি। যদি আমার নৌকা খাও তো তোমার মন্ত্রী খেয়ে দিব অবস্থা। আর যদি মন্ত্রী সরাও তবে কোনাকোনি ঘরে ওর নৌকা খেয়ে দিব। মনে হলো হাতির চাল দিয়ে আমি ওকে অল্টারনেট অবস্থায় ফেলে দিয়েছি বা নৌকাটাকে পিন করেছি। এভাবেই নিচের ২১ তম চালের বোর্ড এর অবস্থার সৃষ্টি হয়। ওর হাতির চালটাকে আমি আমার ভাষায় বলতাম অল্টারনেট, একই সাথে উচ্চতর দুটি পিসকে আক্রমণ করা। হয় এটা দাও না হয় ওটা এমন অবস্থা। আর পিন করা মানে হলো কোন পিস বা পন সরালে বড় কোন পিসকে বাধ্যতামূলক হারাণর পরিস্থিতি। এই দুটো কৌশল আমি সেই সময় বুঝতে পারতাম। আমি দুই পয়েন্ট আগায়ে গেছি ঠিকই কিন্তু হাতি দিয়ে ও অল্টারনেট করায় হাতির ৩ আর নৌকার ৫ পয়েন্ট হওয়াতে ও আমার নৌকা খেয়ে দিলে ওর সেই হারান দুই পয়েন্ট ফেরত পাবে। 

মিড গেইম অবস্থায়  ২১ তম চালের বোর্ড

আমি হাতি দিয়ে মন্ত্রী আক্রমণ করায় অবস্থাটা এমন যে তাকে অবশ্য অবশ্যই মন্ত্রীকে সরাতে হবে না হলে আমি তিন পয়েন্টের হাতি দিয়ে ওর নয় পয়েন্টের মন্ত্রী খেয়ে দিব। আর যেহেতু বি১ এর ওর নৌকা পিন করা আছে মন্ত্রী সরালে আমি ওর নৌকা খেয়ে আর দুই পয়েন্ট আগায়ে যাব। ও যা করলো তা হলো মন্ত্রীটা ই৭ ঘরে নাময়ে নিয়ে আমার মন্ত্রীকে আক্রমণ করল পাশাপাশি হাতি দিয়ে যে আমার দুই নৌকাকে অল্টারনেট আক্রমণ করেছিল সেই রাস্তায় হাতির সাপোর্টে আমর দুই নৌকাকে আরো বিপদে ফেলে দিল। এখন ও যদি আমার মন্ত্রী খায় তবে নৌকা দিয়ে ওর মন্ত্রীকে খেতে হবে আর সেক্ষেত্রে আমার নৌকা ও হাতি দিয়ে খেয়ে দুই পয়েন্ট পুনরুদ্ধার করবে। আমি যদি ওর মন্ত্রী খাই তবে ও হাতি দিয়ে আমার মন্ত্রী খাবে আর তার পরও আমি আমার দুই নৌকার অল্টারনেট অবস্থাটা থেকে মুক্তি পাব না। আমি যা করলাম তা হলো আমার বি৬ এর ঘোড়াটা ডি৫ এ নিয়ে ওর মন্ত্রী আর হাতিকে অল্টারনেটে ফেলে দিলাম। এই চালটার কারণেই মনে হয় আমি পুরো খেলাটার নাম দিয়েছিলাম হর্স রেস। কারণ ঘোড়াটা ওই ঘরে দেয়ায় ও’র মন্ত্রী আর হাতি অল্টারনেটে পরে গেল। এই অবস্থায় ও কি করবে তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছিল।

ও বাধ্য হয়ে আমার মন্ত্রীকে খেয়ে দেয় আর আমি রাজার পাশের নৌকা দিয়ে ওর মন্ত্রীকে খাই। তার পর ও হাতি দিয়ে আমার এ৩ এ থাকা নৌকাকে খেয়ে দুই পয়েন্ট পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু এফ৫ থাকা আমার সাদা ঘরের হাতি দিয়ে আমি ওর বি১ ঘরের নৌকা খেয়ে দিয়ে আবারও দুই পয়েন্ট আগায়ে যাই। ও রাজার পাশের নৌকা দিয়ে আমার হাতি খেলেও হাতির পয়েন্ট ৩ আর নৌকার পয়েন্ট ৫ তাই আমি দুই পয়েন্ট আবারও আগায়ে গেলাম। এর কয়েক চাল পর থেকেই আমার দুই ঘোরার দারুণ সব চাল শুরু হয়। যেমন ২৯ তম বোর্ড এর অবস্থাটা নিম্নরূপ।

য়েন্ড গেইম অবস্থায়  ২৯ তম চালের বোর্ড

য়েন্ড গেইম বা শেষ খেলায় দুটো হাতি কিংবা দুটো ঘোরা অনেক শক্তিশালী তবে ব্যবহার করাটা জানতে হবে। এই খেলায় আমার দুই ঘোড়ার চাল গুলো ছিল দুর্দান্ত। ৩০ তম চালে আমি সি৩ এ থাকা আমার ঘোড়াটা ডি১ এ নিয়ে একদিকে ওর নৌকা আর আরেক দিকে এফ২ তে থাকা বড়ে কে অল্টারনেট করি। এফ২র বোড়ে টা আমার আরেক ঘোড়া যা ই৪ এ আছে তা দিয়ে আক্রমণ করা আছে। ও নৌকাটা কে সি২ তে নিয়ে এসে আমার সি৬ এর বড়ে কে আক্রমণ করে আর আমি ওর এফ২ বড়ে খেয়ে দেই, যদিও তা ও নৌকা দিয়ে খেয়ে দিতে পারে সেক্ষেত্রে আমার আরেক ঘোড়া ওর নৌকাকে খেয়ে দিবে। এভাবে আমি আরো ১ পয়েন্ট আগায়ে গেলাম। ও নৌকা দিয়ে আমার সি৬ এর বড়ে খেয়ে ফেলে আর আমি আমার নৌকা এ১ ঘরে নিয়ে যাই উদ্দেশ্য এর পরের চালে বাজি মাত করা। কারণ এফ২ তে থাকা আমার ঘোড়া আর ই৪ এ থাকা ঘোড়া বিপক্ষ রাজার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে আর আমি যদি আমার নৌকাটা এইচ৮ ঘরে নিয়ে চেক দিতে পারি তবে চেক মেট বা বাজি মাত হয়ে যাবে ও আমি জিতে যাব। মানে হলো মাত্র একটা চাল বাকি। এই অবস্থায় ও ওর নৌকা দিয়ে আমার রাজকে চেক দেয়। আমি রাজা উঠায়ে নিয়ে যাই জি৭ ঘরে। ও ওর হাতি এফ৮ ঘরে এনে চেক দেয় আবার। আমি রাজা সরায়ে নেই এফ৬ ঘরে। ও নৌকা সি৬ ঘরে নিয়ে আমার রাজাকে চেক দেয়। আমি এফ৫ ঘরে নিয়ে যাই আমার রাজাকে। ও ওর ঘোড়া এইচ৪ ঘরে এনে আমার রাজাকে চেক দেয়। আমি রাজাকে জি৫ ঘরে নিয়ে যেয়ে ওর ঘোড়াকে আক্রমণ করি। এই ৩৬ তম বোর্ডটি অত্যন্ত ট্রিকি। একটা চাল এদিক ওদিক হলে হয় আমি জিতব না হয় ও।

য়েন্ড গেইম অবস্থায়  ৩৬ তম চালের বোর্ড

এই অবস্থায় আমার মাত্র একটা চাল দরকার, নৌকাটা এইচ৮ এ নিতে পারলেই ও হেরে যাবে। কিন্তু এদিকে ও ঘোড়াটা এফ৩তে নিয়ে চেক দেয় আর আমি বাধ্য হই রাজাকে এইচ৫ এ নিতে। এর পর ও যদি নৌকাটা সি৫ এ নিয়ে চেক দিতে পারে তবে ও আমাকে চেক মেট করে বাজি মাত করে দিবে কিন্তু ওই যে আমর ঘোড়া আছে ই৪ এ, ও যদি ওর নৌকা সি৫ এ দেয় তবে আমি আমার ই৪ এর ঘোড়া দিয়ে ওর নৌকা খেয়ে দিব। এই ঘোড়াটার কারণেই আমি জিতে যাই।ও ক্রমাগত চেক দিয়ে আমাকে চেকমেট করতে না পারলে ও হেরে যাবে। একটা চাল চেক ছাড়া দিলেই আমি নৌকা এইচ৮ এ নিয়ে বাজি মাত বা চেক মেট করে জিতে যাব। এই অবস্থায় ও হার স্বীকার করে নেয়। বাকি চাল গুলো অনুমান করে নেয়া যায় যে, ওর হার নিশ্চিত ছিল কারণ দু এক চাল পরই আমি ফাকা একটা চাল পেতাম আর ওর রাজাকে নৌকা দিয়ে ঘায়েল করে দিতে পারতাম।

৩৩ বছর পর দাবা খেলাটা পুনরায় খেলতে পেরে আমি যার পর নাই আনন্দিত। সেই ১৬ মে ১৯৯০ থেকে আমার আত্মবিশ্বাস যে বেড়েছে তার পর আর কমে নাই। এই ৩৩ বছর দাবা খেলাও তেমন একটা হয় নাই। ইদানীং দাবা খেলার কথা খুব একটা শুনা যায় না। আগে পত্র পত্রিকায় গ্র্যান্ড মাস্টার গ্যারি কেসপারভ আর কারপভের খেলা ফলাও করে প্রচার করা হতো। এখন তাদের নাম ডাক আর শুনি না। ভাবতাম ইদানীং হয়তো মানুষ দাবা খেলা তেমন একটা খেলে না। ভাল করে ইন্টারনেটে খোজ নিয়ে দেখলাম, ওরেব্বাবা, ইদানীং দাবা খেলার গতিও বেড়েছে আর অনলাইনে হরদম দাবা খেলা চলছে। কম্পিউটারে দুটা দাবার এ্যাপও ডাউন লোড করলাম। মাঝে মাঝে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাথে দাবা খেলা যাবে এই উদ্দেশ্যে। খেলছিও ইদানীং তবে এআই এর সাথে পারি না, খালি হেরে যাই তবে খেলা  গুলো পরে আবার খেলে দেখি কোথায় ভুল করলাম। হয়তো একদিন এআইকেও হারায়ে দিবে সেই আত্মবিশ্বাস এখনও আছে । আগে দাবা খেলা ছিল ধীর স্থির মনোনিবেশ করে খেলা আর ইদানীং দেখি সবাই হুট হাট চাল দিচ্ছে, একটা চাল দেয়ার পর অপর জন কত দ্রুত চাল দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা যেন। দাবা খেলার ধরণ ধারণই পাল্টে গেছে এখন। সময়ের সাথে সবই বদলায়, আমাদেরকেও তাই বদলাতে হবে।

১৬মে১৯৯০> ২০এপ্রিল২০২৩> ২৫ জুন২০২৩> ২৮ জুন ২০২৩>

Saturday, June 24, 2023

উন্নয়ন কখনই তার বিকাশ বন্ধ করে না

 আজকের এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়েও অনেক যত্ন ও পরিশ্রম করে গড়া একটি চূড়ান্ত পণ্য বা বিষয় যাকে আপনি আজ নিখুঁত বলে মনে করছেন তা অচিরেই বা অতি দ্রুত অপ্রচলিত বা পুরাতন হয়ে যাচ্ছে। যদি আপনি তা অনুভব করতে না পারেন তা হলে বুঝতে হবে আপনার নিজের বিকাশই বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্যা হল, এই অপ্রচলিত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বা এর আরো উন্নয়নকে অগ্রসরমানতা হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নাকি এটি একটি বৃত্তাকার পথে অন্ধভাবে ঘুরতে থাকা বা সর্পিলাকারে অবস্থার উত্তরণ বুঝাবে। আরেকটি সমস্যা হলো ঠিক কখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের আগের নিখুঁত পণ্যটি নতুনভাবে বিকশিত করা যেতে পারে। কে আমাদের এটা আপগ্রেড করতে বলে বা পথ দেখায়। ঠিক কি নিশ্চিত করে যে সময় এসেছে এটিকে আলাদা করার বা পুরাতন অবস্থা থেকে নতুন করে তুলে আনার।  

গত বছর আমি ভেবেছিলাম আমি যথার্থতার মানদণ্ডর উপর একটি বই লিখব, চিন্তাটি মাথায় এসেছিল কারণ আমি বুঝতে পারতাম যে লোকেরা তাদের আলোচনায় কিংবা বিচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বিবেচনা করেন না। কোনটি যথার্থতার মানদণ্ডে উপযুক্ত এবং উপযুক্ত হওয়ার মানদণ্ডটি কি হওয়া উচিত তা কোন লেনদেন করার আগে বিচার করে নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কোনো না কোনো ভাবে এই প্রাথমিক বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করা হয় এবং এটি সব ধরনের বিতর্কিত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়। যদি এই বিচার মানদণ্ডের একটি নির্দিষ্টতা থাকত তবে কোন প্রকারের লেনদেনের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব কখনই সৃষ্টি হতে পারতো না। এখন আমি মনে করি এই যথার্থতার মানদণ্ড ফ্যাক্টরটি সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে একটি পরিবর্তনশীল বিষয় বা ভেরিয়েবল। সময়ের সাথে উপযুক্ততার এই ধারণাটি পরিবর্তিত হয় এবং এর পরিসীমা সময়ে সময়ে পৃথক হয়। প্রশ্ন হলো এই পরিবর্তনটি কিসের ভিত্তিতে হয়? বিকাশ নিজেই একটি শব্দ যা পরিবর্তনশীল বা প্রগতিশীল, এর কখনও শেষ নেই। যা বলা যায় তা হলো, আজকের উন্নয়ন একটি অতীত ঘটনা যখন আমরা অতীত থেকে আজকের ভবিষ্যতের দিকে ফিরে তাকাই। এখনকার বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে আমরা একই জিনিসটিকে এমন ভাবে সংস্কার করতে চাই যেন এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে এটি আমরা আগে যেটি বিবেচনা করেছিলাম তার চেয়ে একটি উন্নত রূপে পরিবর্তিত হয়। সোশিয়ালিস্ট ব্লক থিংক ট্যাঙ্কগুলি আপনাকে বলবে যে এটি খুবই স্বাভাবিক এবং তারা এই ঘটনাটিকে উপরের দিকে ক্রমবর্ধমান একটি সর্পিল সিঁড়ি কেস বলে। এবং আপনাকে আরও স্পষ্টভাবে বলতে এবং আপনি যদি পুরো সিঁড়ির কেসটি দেখেন তবে আপনি দেখতে পাবেন যে এটি নিজেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে সঞ্চালিত হচ্ছে এবং সর্পিল বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি এই অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক মানব সভ্যতার জন্য একটি গোলকধাঁধা তৈরি করেছে। তারা এটাকে বলে পরিমাণগত পরিবর্তন গুনগত রূপান্তর ঘটায় আর তার পর হয় নেগেশন অব নেগেশন বা প্রতিষেধের প্রতিষেধ। প্রকৃতির অন্যান্য আন্তলীন বৈশিষ্ট্যের মত এটাও আরেকটি বৈশিষ্ট্য  বলে তারা মনে করে।

আমার আগের লেখাতেও উল্লেখ করেছি, “কোন কিছুর মূল্য নাই যতক্ষণ না আমরা তাতে মূল্য আরোপ করি”। এতদিন ভাবতাম এই বচনটি আমার একার উদ্ভাবিত একটি ধারনা যা আমি আমার নিজের চিন্তা ভাবনা দিয়ে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু গতকাল বারট্রান্ড রাসেলের লেকচার বই “আমি কেন ধর্ম বিশ্বাসী নই” এর ৬৮ পৃষ্ঠায় ঠিক এই কথাটাই পড়ে আমি অবাক হলাম, তিনিও ঠিক একই কথা বলে গেছেন, তাও আবার ৬০ কি ৭০ বছর আগে। আর যাই হোক আমার অনুধাবনটি ভুল নয়, অন্তত তা প্রমাণ হলো। তিনি বলেছেন “মূল্যের জগতে প্রকৃতি নিজেই নিরপেক্ষ। সে ভালও নয়, খারাপও নয়, সে প্রশংসারও যোগ্য নয়, নিন্দারও যোগ্য নয়। আমরাই মূল্য সৃষ্টি করি এবং সেই ধরণের আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করি যা মূল্য প্রদান করে থাকে। এই রাজত্বে আমরা রাজা এবং আমরা তখন আমাদের রাজত্বকে নিকৃষ্ট করে তুলি যখন আমরা প্রকৃতির কাছে অবনত হই। আমাদের জন্যই মঙ্গলময় জীবনকে নির্ধারণ করতে হবে, প্রকৃতির জন্য নয় – এমনকি সেই প্রকৃতির জন্যও নয় যাকে আমরা ঈশ্বরে পরিণত করেছি।“ আমার ও তার দুই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, বস্তুর নিজস্ব কোন মূল্য নেই যতক্ষণ না আমরা তাকে মূল্যায়িত করি। উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান বিকাশ যা এখনকার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে আরো উন্নয়নের অবকাশ রাখে তা মূলত মানুষের বা সম্মিলিত মানুষের চিন্তা ভাবনার ফলশ্রুতি মাত্র। সামাজিক কনসেনসাস যাকে বলা হয় অর্থাৎ সমষ্টিগত মানুষের চিন্তাভাবনার ঐক্যমত্য। অনেকেই এই ঐকমত ধরতে পারে না আর তার অনুবর্তী হয়ে যান। এই ঐক্যমত্যে তারও যে মতামত দেয়ার অধিকার আছে তা সে হয়ত জানে না কিংবা মনে করে এটা তার উপর আপতিত একটা মতামত যা সবার উপরই আপতিত হয়। জিনসের প্যান্ট যত বেশি ছিঁড়া পড়া যায় তত বেশি আধুনিক হয় এই অধঃপতিত জনমতটি যে হাস্যকর সে বিষয়ে আপনার হাসার অধিকার আছে, তা মনে হয়ে অনেকেই জানেন না।

প্রযুক্তিগত দ্রুত উন্নয়নের এই যুগে এই আপগ্রেড হওয়ার গতি অত্যন্ত বেশি তাই ধরা যাচ্ছে না এই নতুন নতুন পরিবর্তন গুলো কতটা আমাদের উপকারে আর কতটা অপকার করছে। একটা কথা বলে রাখি প্রযুক্তির উন্নয়ন সব সময়ই ভালর দিকে গেছে। আগুনের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা একটা প্রযুক্তিগত বিপ্লব, এই আগুন দিয়ে রান্নাবান্না থেকে তরবারি পর্যন্ত বানানো গেল আবার এই আগুন কিন্তু ভুল ভাবে ব্যবহার করলে তা মানুষকে পুরিয়ে মারার কাজেও ব্যবহার করা যায়। প্রযুক্তি সব সময় নিরপেক্ষ, মানুষ তাকে তার উপকারে এবং অপকারে দু ভাবেই ব্যবহার করতে পারে। পারমানবিক শক্তি দিয়ে বোমাও বানানো যায় আবার স্বল্প খরচে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কোনটি করার সিদ্ধান্ত আপনি নিয়েছেন তার উপর প্রযুক্তির ব্যবহার নির্ভর করে। উন্নত প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই মানুষকে উন্নততর করে তোলে। ক্লোনিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল আমার এক ছোট ভাই এক সেমিনারে যেখানে বলা হচ্ছিল ক্লোনিং ইসলামে নিষেধ, সে প্রশ্ন করছিল যদি পুর মানুষের ক্লোনিং না করে অঙ্গ, প্রত্যঙ্গর ক্লোনিং করা হয় তাতে তো মানুষের উপকার হবে, বিকলাঙ্গ মানুষগুলোকে অঙ্গ দেয়া যাবে। সেমিনারের বক্তারা এর উত্তর দিতে পারে নাই। তথ্য প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির উন্নয়ন সব থেকে ভাল উদাহারণ উন্নয়ন কাকে বলে তা বুঝার জন্য। সেই মাত্রার বড় কম্পিউটার কিভাবে উন্নত হতে হতে হাতের মুঠায় চলে আসল তা বিচার করলেই এর দ্রুত ধাবমান উন্নয়ন চোখে পড়ে। মানব জাতি জন্ম থেকেই উন্নত হচ্ছে তার জ্ঞান বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে। কম্পিউটারের উন্নয়ন আমার অভিজ্ঞতায় যেভাবে ধরা পরেছে তা অনেকটা এরকম মাইক্রোসফট অপারেটিং সিস্টেম ডস, - উইন্ডোজ 4.11 (যা ডস এ বুট হয়ে তার পর ওপেন হতো) - উইন্ডোজ ৯৫ - উইন্ডোজ ৯৮ উইন্ডোজ মিলিনিয়াম -
উইন্ডোজ এনটি - উইন্ডোজ ২০০৩ - উইন্ডোজ 7 - উইন্ডোজ ১০ - চলমান। আর মাইক্রোসফট অফিসের ক্ষেত্রে অফিস 97 - অফিস 98 - অফিস 2007 - অফিস 2010 - অফিস 2013 - অফিস 2016 - চলমান। আর ইন্টেল প্রসেসর 3086 - 4086 -পেন্টিয়াম -পেন্টিয়াম 1 (এমএমএক্স) - সেলেরন প্রসেসর - এএমডি প্রসেসর - ডুয়েল কোর প্রসেসর - কোর আই 3 - কোর আই ৭ - চলমান। উল্লেখিত প্রতিটি পরিবর্তনের সাথে আমাকে অভিযোজিত হতে হয়েছে। মানে হলো প্রতিটা ধামে কম্পিউটারে আগের গতি প্রকৃতি বদলে গেছে যাতে আগের স্টাইলে কাজ করলে আর চলে নাই। আমাকেও এই ধাপ গুলোর সাথে আপগ্রেড হতে হয়েছে। যারা বাটন মোবাইল থেকে টাচ মোবাইলে আরোহণ করেছেন তারা বুঝবেন আপগ্রেড হতে কিছুটা হলেও বেগ পেতে হয়। প্রথম প্রথম আন ইজি লাগে তার পর আর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে মন চায় না। নতুন অবস্থায় উত্তরণটা ততদিনে পছন্দ হয়ে গেছে। মিচিও কাকু যিনি হকিং মহোদয়ের মৃত্যুর পরে সব থেকে জনপ্রিয় পদার্থবিজ্ঞানী তার বই প্যরালাল ওয়ার্ল্ডস এর ২১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা। এটা হলো পরবর্তী প্রজন্মের কম্পিউটার। বর্তমানের কম্পিউটার গুলো বিট ও বাইটে কাজ করে মানে হলো 0 বা 1 এই বাইনারি সিস্টেমে সে গণনা করে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিউবিটে (শূন্য থেকে ১ এর মাঝখানে যে কোন কিছু) নিয়ে কাজ করবে। যার ফলে সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে  ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটার। তবে তার জন্য হয়ত আমাদের কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হতে পারে। কারণ এই কম্পিউটার গুলো কোয়ান্টাম টেকনোলজির মাধ্যমে চলবে যা পদার্থবিদ্যার শেষ অধ্যায় এবং এখনও বিকাশমান। মিচিও কাকু লিখেছেন “যেমন একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ভিত নড়িয়ে দিতে পারে। বর্তমানে বড় ব্যাংক, বহুজাতিক কর্পোরেশন ও শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের গোপনীয়তা রাখে জটিল কম্পিউটার অ্যালগরিদম দিয়ে। অনেক গোপন কোডের ভিত্তি হলো বড় বড় সংখ্যার ফ্যাক্টর। ১০০ অংকের একটা সংখ্যা ফ্যাক্টর ভাংতে একটা সাধারণ কম্পিউটারের কয়েক শতাব্দী লাগতে পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাছে তা জলভাত। এ রকম গণনা অনায়াসে করতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এগুলো দিয়ে যে কোন দেশের গোপন কোড সহজেই ভাঙ্গা সম্ভব।” এর মানে হলো আমার নাতি যখন কম্পিউটিং করবে তখন তারা কোয়ান্টাম কম্পিউটারে কাজ করবে যার ক্ষমতা হবে বর্তমানের কম্পিউটারের চেয়ে কয়েক হাজার গুন বেশী। ১৯৯৮ এ কেনা আমার প্রথম কম্পিউটারের হার্ড ডিক্স ছিল ২ জিবি আর রেম ছিল ১৬ মেগা বাইট, প্রসেসর ছিল ইন্টেল ৫৫০ মেগাহার্টজ। আর আজকে এই কথা শুনলে সাধারণ লোকজনই হাসবেন। প্রথম পেন ড্রাইভ আমি যেটা হাতে পেয়েছিলাম তার স্টোরেজ কেপাসিটি ছিল 5 জিবি। মাত্র কয়েকদিন আগের কথা আর এখন এই সব কথা শুনলে নতুন প্রজন্ম অবাক হবে। একটা বিষয় লক্ষণীয় তা হলো বাচ্চারা মোবাইল ফোনের প্রতি অতি মাত্রায় আকৃষ্ট হয়, এটা সব বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সমান ভাবে দেখা যায়। এই তীব্র আকর্ষণ আর কিছুই নয় প্রযুক্তির প্রতি মানুষে বুদ্ধিবৃত্তিক টান যা তাকে বুঝায় যে এই জিনিসটা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মারাত্মক একটা কৌশল দিবার ক্ষমতা রাখে। 

ইউভাল নোয়া হারারী তার বই সেপিয়েন্স এর শেষের দিকের একটা অধ্যায়ের শিরোনাম রেখেছেন, আমরা কি হতে চেয়েছিলাম? আমরা মানে হলো এই হিউমেন রেইস বা মানব সভ্যতা। যাকে বারট্রান্ড রাসেল মঙ্গলময় জীবন বলেছেন আমরা তো সেই মঙ্গলময় জীবনই চেয়েছিলাম যা জ্ঞানের দ্বারা চালিত ও প্রেমের দ্বারা উজ্জীবিত। আমার মনে হয় আমরা প্রকৃতির সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সুস্থ সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে চেয়েছিলাম ও এখনও চাচ্ছি। এর আরেক অর্থ করা যায় আমরা আরাম আয়েশের আর আলস্যের জীবন গঠন করতে চেয়েছিলাম। আজকের অধিক সম্পদে মানুষ হওয়া বড় লোকদের অতি আদরের নাদুস নুদুস ছেলে মেয়েদের দেখলে কথটার সত্যতা পাওয়া যাবে। নাৎসি বা জার্মান উগ্র জাতীয়তাবাদীদের একটা পোষ্টারে পাশাপাশি দুটো ছবি দেয়া ছিলো, যার একটাতে খেলোয়াড় সদ্রশ সুঠাম দেহী একজন মানুষ আর পাশেরটি স্থূলকায় গোবেচারা টাইপের মানুষ। জার্মানদের কাছে সুঠাম দেহী খেলোয়াড় সদ্রশ মানুষগুলো হলো উন্নত জার্মান জাতি আর পাশের স্থূলকায় গোবেচারারা হলো ইহুদিদের ক্রসব্রিড যার করানে তারা মনে করতো জার্মান জাতীকে শুদ্ধ করতে হলে ইহুদিদের মেরে ফেলতে হবে। পৃথিবীর শুভ চিন্তার মানুষের বিজয় হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যার ফলে আমরা সকল প্রজাতির মানুষ স্বাধীন ভাবে বেচে আছি। হিটলার জয়ী হলে উন্নত মানুষের  পৃথিবী বানানোর নামে না জানি আরো কত লক্ষ কোটি মানুষকে গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করতো।

আমার উপর্যুক্ত শিরোনামে লেখাটার উদ্দেশ্য ছিল এটা বুঝে দেখা, আমরা কেন ক্রমাগত উন্নয়নের কথা বলি এবং এর শেষ কোথায়। না কি এর কোন শেষ নাই, এটা ক্রমাগত উন্নতই হতে থাকে। এটা বুঝে দেখা যে, উন্নয়ন মানে কি আমাদের সম্মিলিত জনমতের ক্রমাগত উন্নত হওয়ার বাসনা নাকি ব্যক্তিগত উন্নয়ন এর ধারনা এর মূলে কাজ করে। আমার যা মনে হয় তা হলো মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে তত তার বৈষয়িক ভাবনার পরিবর্তন আসছে। সে আরো উন্নত জীবন যাপনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। আগে ছিল লেপা মাটির ঘরের ফ্লোর, তার পর আসল কনক্রিটের ফ্লোর, তারপর মোজাইক আর এখন টাইলস না হলে চলেই না। এটাকে প্রযুক্তিগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন বলাই সঠিক হবে। চারপাশের সোশ্যাল এস্কেলেশনের কারণে বাবার বানান শ্যাওড়াপাড়ার ৪ তলা বাড়িটা প্রাচীন কালের গুহার মত হয়ে গিয়েছিল, চারপাশের উঁচু উঁচু বিল্ডিং এর কারণে আকাশ তো দেখা যেতই না, কোন আলো বাতাসও আসতো না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধেশ্বরীর একটা এপার্টমেন্টের অষ্টম তলায় বাসা ভাড়া নিয়ে চলে আসলাম। জন্ম আমার ওই এলাকাতেই আর ওই এলাকার ক্রমবর্ধমান উন্নয়নও আমর ছোট বেলা থেকেই দেখা। তাই আমার ছোট মেয়েকে খেলনা ড্রোন চালনায় পরদর্শী হতে বলছিলাম এই বলে যে, “দেখ এই যে এত ১৫ তলা ২০ তলা এপার্টমেন্ট গুল এখন দেখছো, এখানে এক সময় সব টিনের ঘর ছিল। তার পর হলো ৪ তলা কি ৫ তলা ভবন, সেগুলোও ভেঙ্গে এখন হচ্ছে এত উঁচু উঁচু বিল্ডিং এর আর কিছুকাল পর দেখতে পাবা এগুলোও ভেঙ্গে ৩০ তলা ৪০ তলা বিল্ডিং হবে আর তখন ফুড পান্ডারা ড্রোনে করে খাবার ডেলিভারি দিবে। তখন হয়ত ড্রোন ডেলিভারি রিসিভ করার জন্য ড্রোণ ভেন্ট এর ব্যবস্থা থাকবে ওই স্কাই স্ক্রেপার বিল্ডিং গুলোতে আর তখন তোমরা চাকুরী আবেদন সিভিতে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করার প্রদর্শিতর কথাও উল্লেখ করতে পারবা যা জব মার্কেটে গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হবে।” আমার কথা শুনে ও হেসেই অস্থির। বিশ্বাসই করতে চায় না। আমি বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম এটা দূরদৃষ্টিতা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুমান কোন হাসির কথা নয়।

আপডেট ও এডিট হিস্ট্রিঃ- ৩১অক্টোঃ২০১৭> ২০ ডিসেম্বর ২০২০>  ১৫মে২০২৩> ২১ জুন ২০২৩ > ২৫জুন২০২৩ > ০৯জানুয়ারী২০২৪>
 

Friday, June 16, 2023

আমি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মর একজন

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক পরের বছরের শেষ দিকে ৫ই নভেম্বর ১৯৭২ এ আমার জন্ম। । স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মর একজন আমি । এই অর্থে আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। স্বাধীন দেশের খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিয়ে জন্মেছি । স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখতে হয়নি আমাকে। চিলড্রেন অব দি ওয়ার মুভি যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মাণ করা, ওটা দেখে সারা রাত কেঁদেছি। হাউমাউ করে কাদা নয়, রাত জেগে দেখছি আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। পরের সাত দিন ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছিল আমার সেই কান্নার পানিতে মুখ সারা রাত ভিজে থাকায়। ওই মুভির এক জায়গায় দেখান হয়, হানাদারদের ভয়ে জঙ্গলে পালায় এক পরিবার সাথে ছিল নবজাত এক শিশু, তার কান্না থামাতে তার মুখে হাত দিয়ে চেপে রাখে তার বাবা, যখন হানাদার বাহিনীরা চলে যায় তখন বাচ্চার মুখ থেকে হাত সরালে দেখা যায় সেই বাচ্চাটা আর বেচে নাই। এরকম আর অনেক করুন বীভৎস বেদনাময় কাহিনীতে পুর মুভিটা ভরা। মুভিটা না দেখলে সেই সময়কার ভয়াবহ জীবন সম্পর্কে এই প্রজন্মের কেউ বুঝতেই পারবে না সে সময় কি ভয়ংকর অবস্থা চলছিল।

একাত্তর সম্পর্কে আমাদের ধারণা বা অভিজ্ঞতা হলো মুক্তিযুদ্ধাদের কাছ থেকে শুনা গল্প গুলো। আমার ছোট চাচা রুহুল আমিন যুদ্ধে গিয়েছিলেন তার কিশোর বয়সে। আমার বাপ চাচাদের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে যাওয়াতে উনার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প খুব একটা শুনার সুযোগ হয় নাই। আমার বাবা মা যুদ্ধের সময় কুষ্টিয়া সুগার মিলে ছিলেন। বাবা ছিলেন ওই সুগার মিলের ইঞ্জিনিয়ার। আমার তখনো জন্ম হয়নি। মা’র কাছে শুনেছি ওই সময় তার পেটে ছিলাম আমি। উনাদের মুখ থেকে শুনেছি যুদ্ধের গল্প। বাবা মাকে নিয়ে সুগার মিল থেকে দূরবর্তী একটা গ্রামে চলে গিয়েছিলেন ও একটা ভাল গৃহস্থ পরিবারে আত্মগোপন করে ছিলেন। বাবার বন্ধু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মিলে ছিলেন যতক্ষণ না হানাদার বাহিনী মিলটা দখল করে নেয় তার আগ পর্যন্ত, তার পর উনিও সেই গ্রামে আত্মগোপন করতে চলে আসেন। গ্রামের কুকুরগুলো মানুষ মরা খেয়ে খেয়ে নাকি নেকড়ের মত হয়ে গিয়েছিল। আমার নানা হজ্জে গিয়েছিলেন জাহাজে করে, ফিরার পথে চট্টগ্রামে আটকা পরে যান যুদ্ধের কারণে। ওই সময় রাস্তায় রাস্তায় পাক সেনাদের পাহাড়া বসান ছিল। আমার নানীর বড় ভাইকে আমি বড় নানা ভাই ডাকতাম, উনি তখন আমার ছোট খালা ও মেঝ মামাকে নিয়ে টাঙ্গাইলে তাদের গ্রামের বাড়িতে যান, যাওয়ার পথে এক পাক বাহিনীর চেক পোষ্টে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় ছোট খালা দেখেছিলেন তাকে এক পাক সেনা থাপ্পড় মারল। আমার নানা এজিবি অফিসে চাকরি করতেন আর নানু ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা। ওই স্কুলে আমার মা, খালাও পড়েছেন। বাসা ছিল রাজার বাগের একদম কাছে মালিবাগে। রাজার বাগ পুলিশ লাইনে যখন হামলা হলো তখন শুনেছি মামা, খালারা খাটের নিচে লুকায়ে থাকত সাইরেন বাজলেই। মালিবাগের ওই জায়গায় আমার ছেলেবেলার কিছু সময় কাটে, আজ ওখানে তিন মামা’র ছয় তলা ফ্ল্যাট বাড়ি। যুদ্ধের সময় পুর পরিবারটা যত্র তত্র ছড়ায়ে পরেছিল। নানা ভাই চট্টগ্রামে আটকা, বাবা মা কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে, ছোট খালা ও মেঝ মামা টাংগাইলে বা সলিম নগরে বড় নানা ভাই এর সাথে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় বাবা মাকে ও মা এর একমাত্র ছোট বোন, আমার খালাকে আমাদের গ্রামের বাড়ী মুন্সিগঞ্জে তৎকালের বিক্রমপুরের মৌছা গ্রামে জলিল চাচার সাথে পাঠায়ে দেন। গ্রামের বাড়ির চারদিকে তখন থৈ থৈ পানি, পদ্মার পানি। মা ও খালাকে কে নিয়ে বাবার ছোট ভাই আলিম চাচা গ্রাম দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন নৌকায় করে। তা নিয়ে নাকি গ্রামের বাড়িতে নানা কথা উঠেছিল। যুদ্ধের সময় না গ্রাম না শহর কোথাও নিরাপত্তা ছিল বলে আমার মনে হয় না। গ্রাম তো হওয়ার কথা আর অনিরাপদ জায়গা। শুনেছি হানাদার বাহিনী আসছে শুনলে কিশোরী ও যুবতী মেয়েদের পুরুরে ডুব দিয়ে লুকায়ে রাখা হতো আর নিশ্বাস নেয়ার জন্য কচুরির ডগা ব্যবহার করত তারা। চিলড্রেন অফ দি ওয়ার মুভিটাতে দেখান হয়েছে কিভাবে নির্বিচারে যুবতী মেয়ে গুলকে অধিকৃত গ্রাম থেকে ধরে এনে ৪০ ঊর্ধ্ব নারীদের মেরে ফেলা হতো আর সন্তান জন্ম দিতে পারে এরকম মেয়েদের গন হারে ধর্ষণ করা হতো। তাদের অত্যাচারের কোন সীমা ছিলনা। কখনো কখনো সারা রাত দাড় করায়ে রাখত। গরু ছাগলের মত মনে করতো ও’রা আমাদের জনগণকে। ২০১০ কি ২০১১’র দিকে একবার বিআরটিসি’র ভলভো বাসে লোকজনে ঠাসাঠাসি অবস্থায় মিরপুর যাচ্ছিলাম। তখন বাসে নানা কথোপকথনে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় চিন আমাদের অনেক অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। আর ইন্ডিয়া সাহায্য করেছে অনেক ভাবে ও অনেক বেশী। এ রকম ছিটা ফোটা তথ্য থেকেই আমাকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হয়েছে। ও’রা ১১ জন সিনেমাটা দেখেছিলাম ছোটবেলায় যা মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মাণ করা। এখন তার কিছুই আর মনে নাই। পশ্চিমা বিশ্বের ২য় বিশ্বযুদ্ধের মুভি গুলোর মতো সুন্দর মুভি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর নাই। চিলড্রেন অব দি ওয়ার মুভিটাতে এডাল্ট কিছু সিন থাকাতে তা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখা যায় না। বহু নাটক, নভেল রচনা হয়েছে অবশ্যই কিন্তু রিয়েল টাইম মুভি আরো নির্মিত হলে আমাদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম গুলো উপক্রিত হতো। গ্রেনেড সিনেমাটা কিংবা নাসিরুদ্দিন ইউসুফ নির্মিত ও পিযুস বন্ধোপাধ্যায় অভিনিত “একাত্তুর এর যিশু” স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্রটিও ভাল কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পূর্নাঙ্গ চিত্রায়ন নয়। মজার ব্যাপার হলো চিলড্রেন অব দি ওয়ার মুভিটাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা একদম বাদ দেয়া হয়েছে। বুঝাই যায় পলিটিকাল কারণে তা করা হয়েছে। ইতিহাস বর্ণনায় তাই বই কিংবা সিনেমা থেকে সঠিক চিত্রটি পাওয়া দুষ্কর। তিন ভাবে ইতিহাস সময়ের মধ্যে দিয়ে চলমান থাকে যার একটি হলো জীবাশ্ম রেকর্ডস, দ্বিতীয়টি হলো বই, পুস্তক, চলচ্চিত্র আর তৃতীয়টি হলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্মৃতি কথন বা পালা গান। এর মধ্যে তৃতীয়টি হলো সব থেকে বিশ্বাস যোগ্য ধারা। আমার দাদা, আমার বাবাকে বলেছে, আমার বাবা আমাকে বলেছে আর আমি আমার ছেলেকে বলে গেছি, এই ধারাটিই সব থেকে নিরাপদ সত্য প্রবাহ। তাই মুক্তিযুদ্ধাদের কাছ থেকে শুনা গল্পগুলোই সব থেকে সত্যনিষ্ঠ তাতে কোন সন্দেহ থাকে না। সোনালী ব্যাংকে আমার চতুর্থ কর্মস্থল বেগম রোকেয়া সরণী শাখার ম্যানেজার সৈয়দ আনোয়ার হোসেন স্যারও ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা তার কাছ থেকে তেমন কিছু না জানলেও আমর প্রথম কর্মস্থল সোনালী ব্যাংকের এমডিস স্কোয়াডের মোফাজ্জল স্যার (জিএম হিসেবে রিটায়ারমেন্টে গেছেন) তার কাছ থেকে মুক্তি যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি আর তার লেখা বইও পরেছি। নারায়ণগঞ্জ এর আড়াই হাজার এলাকায় তিনি ও তার মুক্তি সেনা দল যে অপারেশন গুলো করেছেন তার বর্ণনা গুলো যেমন রোমহর্ষক ও তেমনি গৌরবউজ্জল স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্য কাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান আকাশচুম্বী তাতে কোন সন্দেহ নাই কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদানও অনেক। মেজর জিয়াউর রহমানের ওই সময়কার অবদানটি নেহায়েত ফেলে দেয়ার মতো তো নয়ই বরং তা যুদ্ধরত জাতিকে সর্বদা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল, কিংবা একটি ফুলের হাসির জন্য আমরা যুদ্ধ করি, শিকল পড়া ছল মোদের এই শিকল পরা ছল, এই শিকল দিয়েই তোদের মোরা করব রে বিকল এসব গান গুলো তখনকার মুক্তিকামী মানুষের মনে মুক্তির জন্য আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের জন্য মাঠে নামার বিষয়ে উদ্দীপনা, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সোনালী ব্যাংকের বিএমইবি মাদ্রাসা বোর্ড) শাখায় ২০১২ সালে যখন কর্মরত ছিলাম তখন নিজাম ভাই যুদ্ধের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে বলতেন তার একটা রেডিও ছিল তাতে লুকায়ে লুকায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতেন। মুক্তিযুদ্ধর উপর নির্মিত একটি চলচ্চিত্রে এই প্রসঙ্গটি একেবারে বাদ দিয়ে যাওয়াটা আমার মতে ঠিক হয় নাই। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিষয়গুলোও অতটা ভয়াবহ ভাবে চিত্রায়িত হয় নাই। ময়মনসিংহ অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধা যিনি স্ব প্রনোদিত হয়ে তার দলবল নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন সেই কাদের সিদ্দিকীর প্রসঙ্গটিও উক্ত সিনেমাতে স্থান পায় নাই। শহীদ সহরোয়ারদী, মওলানা ভাসানী কিংবা শের এ বাংলা একে ফজলুল হকের কথাও মুভিটাতে নাই। তার উপর বির শ্রেষ্ঠদের অবদানগুলোও ঘটনার বর্ণনায় বাদ পরে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর অবদানের কথাও বলা হয় নাই। এসব বাদে পুর মুভিটা মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার চিত্রটি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

আমরা যাও বা কিছু বুঝি স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে বর্তমানের প্রজন্মগুলোর অবস্থা বলাই বাহুল্য। তারা প্রযুক্তির ভয়ঙ্কর খপ্পরে পরে অতীত নিয়ে জানার আগ্রহই হারায়ে বসেছে বলে মনে হয়। তাদের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধর ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করলেও তা তারা অনুধাবন করতে পারে বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার ছেলে মেয়েদেরকে। ওরা এত ছোট যে তেমন কিছু বুঝার কথা না। ওখানে পাক বাহিনীর একটা ওয়্যারলেস রেডিও বার্তা আছে যাতে ঊর্ধ্বতন এক পাক অফিসার বলছে আজ কয়টা মুরগি শিকার করলা, আর যত জনকে পাক সেনারা মেরেছে তা শুনে বাহবা দিল অধস্তনদের। এই যাদুঘরেও দেখলাম মাত্র একটা স্টলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ছোট্ট একটা উল্লেখ রয়েছে, এর বেশি কিছু নয়। আজ যদি বিপক্ষ দল ক্ষমতায় থাকতো তা হলে আবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিষয়টাকে এতটাই প্রাধান্য দেয়া হতো যেন ওটাই পুর যুদ্ধটার সবকিছু হয়ে যেত যেটা আবার অতিরঞ্জন। এই পক্ষপাতিত্বর ভারসাম্য নাই বলেই নতুন প্রজন্ম দ্বিধায় পরে যায় প্রকৃত সত্যটা জানার ক্ষেত্রে। বাঙ্গালীদের মধ্যে পক্ষপাতিত্বের এই বাড়াবাড়িটা আসলেই সকল সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দেয়। সত্য যা, যেই সত্যের যতটুকু কৃতিত্ব যার তাকে ততটুকু গুরুত্ব দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া উচিত। এটা একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের জন্য।

পাশ্চাত্যর নির্মিত গান্ধি মুভিটা না দেখলে মোহনচাঁদ করমচাঁদ মাহত্মা গান্ধি সম্পর্কে আমার ধারণাই পূর্ণ হতো না। তাকে নিয়েও নানা কুট তর্ক আছে, তার মৃত্যুর জন্য যে উগ্র হিন্দুবাদীরা দায়ী তা নিয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে। আমার কথা হলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গুলো খণ্ডের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বই লেখা হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান নিয়েও প্রচুর বই বিভিন্ন গ্রন্থানালয়ে বা পাঠাগারে প্রেরণ করাও হয়েছে। গবেষণা পত্রও প্রকাশিত হয়েছে অনেক কিন্তু চলচ্চিত্র এমন একটা মাধ্যম যা সেই সময়কার বাস্তবতাকে সিমুলেট করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান তার পর ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ যে পর্যায়ক্রমে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ তা বর্তমান প্রজন্মের কয় জন জানে। একই ভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী বেশ কত গুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রবাহ যেমন খালেদ মোশারফের মুত্যু, কর্ণেল তাহের এর বিচার, শেখ পরিবারকে হত্যার জঘন্য ইতিহাস, চার নেতার জেল হত্যা, জিয়াউর রহমানের উত্থান ও পতন, এরশাদের উত্থান ও পতন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন ও তিন টার্ম পরে তা’র পরিবর্তন ইত্যাদি ঘটনা প্রবাহ সমূহ চলচিত্রের আকারে উঠে আসা উচিত। এখনকার প্রজন্মর অনেকে ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস না বিজয় দিবস এই বিষয়েই নিশ্চিত হতে দ্বিধায় পরে যাবে। এরা ২৬ খণ্ড না ৩২ খণ্ড স্বাধীনতার ইতিহাস পরার প্রজন্ম নয়। এরা প্রযুক্তিতে অনেক উন্নত, সব কিছু মাল্টিমিডিয়ার আদলে সংক্ষেপে ও দ্রুত দেখতে ও বুঝতে চায়। বাবার কষ্টার্জিত বিপুল সম্পদে বড় হওয়া সন্তানেরা যেমন সম্পদের মর্যাদা বুঝে না তেমনি এই প্রজন্ম জানে না কত সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা। এটা তাদের জানাতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। 

এডিট ও আপডেট হিস্ট্রিঃ ১৬জুন২০২৩

 

Wednesday, June 14, 2023

চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী

 

(সতর্কীকরণঃ যারা ধর্মনিরপেক্ষ নন কিংবা পরমত সহিষ্ণু নন তাদের জন্য লেখাটা পড়া কষ্টদায়ক হতে পারে, তাই তাদের না পড়াই ভাল। যদি উন্মুক্ত ভাবনা চিন্তাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন তবে পড়ে ভাল লাগতেও পারে।) 

মঙ্গলময় জীবনের উদ্দেশ্যে ধর্মের সেকাল, একাল আর আগামীকাল নিয়ে অনেক কথাই বলা যায় কিন্তু সবই যে গ্রহনযোগ্য হতে হবে তা’ও নয়। সবাই চায় তার জীবন মঙ্গলময় হোক কিন্তু লক্ষ্য জানা থাকলেও তাতে পৌছাতে নানা জন নানা পথের কথা বলে। এই লক্ষ্য ও পথ নিয়ে এলডাস হক্সলির (Aldous Huxley) বই “লক্ষ্য ও পথ” যথেষ্ট চমকপ্রদ। বইটার প্রথম কয়েকটা অধ্যায় এতই তথ্যবহুল আর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন যা যে না পড়েছে সে জানতে পারবে না। তবে শেষের অধ্যায়গুলো অতি দীর্ঘ যা পড়তে পড়তে মনে হতে পারে বছর শেষে হয়ে গেছে তার পরও বইটা পড়ে শেষ করা যাচ্ছে না। মঙ্গলময় জীবন নাকি আত্ম তৃপ্তি যাকে ইংরেজিতে ইনার পিস (Inner peace) বলা হয় সেই ভারসাম্যে মানুষের মন পৌছাতে চায় প্রগাড় মানুষিক পূর্ণতা বা শান্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমার মনে হয় এই আল্টিমেট ইনার পিসের সন্ধানেই মানুষ শেষ জীবনে হন্যে হয়ে যায়। মেসল’স হায়ারারকি অব হিউমেন নিড থিউরি অনুযায়ী মানুষের মানবিক চাহিদার সর্বশেষ স্তর যাকে বলা হয় সেল্ফ একচুয়ালাইজেশন বা সামগ্রিক পরিপূর্ণতা এটা তাই। মুসলিম সম্প্রদায়ে যারা শেষ জীবনে হজ্জ্বে যায় তারা মূলত এই শেষ ধাপটা পূরণ করতেই যায়। কেউ কেউ একাধিকবার হজ্জ্ব করেও তৃপ্তি পায় না আরো যেতে চায়। অনেকে হজ্জ করে এসে ৪০ দিন পার হওয়ার পর পূর্বে যে পাপ কাজ করছিল তা আবার করা শুরু করে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ যাত্রাও অনেকটা সেই একই প্রবৃত্তি থেকে আসে বলে আমার ধারণা।

"The good life is one inspired by love and guided by knowledge" মঙ্গলময় জীবন হল সেই জীবন যা প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত আর জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত। "Outside human desire there is no moral standard" মানবিক ইচ্ছার বাইরে কোন নৈতিক মান নাই। কথাগুলো বারট্রান্ড রাসেলের (Bertrand Russell) হলেও তার সম্পর্কে ক্রিটিক আছে যে, তিনি বর্ণচোরা ভাববাদী। যদিও তিনি কেন ধর্ম বিশ্বাসী নন বলে ভাষণ দিয়েছেন যা বই আকারে প্রকাশও হয়েছে। “আমি কেন ধর্ম বিশ্বাসী নই” বইয়ের পৃষ্ঠা-৩৬ এ বারট্রান্ড রাসেল বলেন “ধর্ম প্রধানত ভয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। ভয়টাই হলো আসল ভিত্তি- রহস্যের ভয়, পরাজয়ের ভয়, মৃত্যুর ভয়। ভয় হল নিষ্ঠুরতার জনক-জননী। ধর্ম ও নিষ্ঠুরতা পরস্পর হাত ধরে চলে। ঈশ্বর সম্পর্কে সমগ্র ধারণাটি জগৎজোড়া প্রাচীন স্বৈরাচারী কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মুক্ত মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের কল্পনা নিছক বাতুলতা মাত্র।”তিনি ও’র পরের পাতাতেই আরও বলেন “একটি মঙ্গলময় জগত সৃষ্টি করতে চাই জ্ঞান, দয়া এবং সাহস। ঘৃণ্য অতীতের ধ্বজা আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলে আর চলবে না।” তিনি এগুলো বলেছেন আজ থেকে ৬০ থেকে ৭০ বছর আগে আর আজও আমাদের বোধগম্যতায় সেই জ্ঞান আসে নাই বলেই মনে হয়। মঙ্গলময় সমাজ কাকে বলে তাই নিয়েই আমরা এখনো একমত হতে পারি নাই। দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলিম আর তাদের ধারনা দিন রাত আল্লাহ-বিল্লাহ করলেই মঙ্গলময় জীবন বিধাতার কৃপায় প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে যেখানে তার বা তাদের তেমন কিছুই করার নাই। এই প্রকার ধারণার ঘোর বিরোধী আমি কারণ বাস্তবতা বলে না যে ফেরেশতাদের দ্বারা সামাজিক কাঠামো চলমান থাকে। তাহলে ফেরাশতাদের দিয়েই সরকার, অর্থনীতি, সমাজনীতি পরিচালনা করার জন্য দোয়া দরুদ পরলেই চলত। প্রতি নামাজ শেষে যে দীর্ঘ দোয়ার আয়োজন করা হয় মসজিদে তার কতটা ফলে তা লক্ষ্য করার বিষয়। দোয়া ফলুক বা না ফলুক তাতে ধর্মের কিছুই যায় আসে না, ধর্মের ধ্বজা এমনি নরে।

নতুন করে বলার বিষয় নয় যে, মানুষ একক ভাবে অত্যন্ত অসহায়। কয়েক শত কোটি বছর আগের জীবাশ্ম রেকর্ডে মানব নির্মিত যন্ত্রের যে সব নজির পাওয়া যায় তা বড় হাড় থেকে মজ্জা বের করে আনার জন্য ব্যবহৃত হতো বলে দেখ গেছে। তখন মানুষ প্রকৃতির খাদ্য শৃঙ্খলের মাঝা মাঝি কোন স্তরে অবস্থান করত তাই সিংহ কিংবা বাঘের খেয়ে রেখে যাওয়া শিকারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে জীবন ধারণ করতো কিংবা যখন আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না তখন দাবানলে পুরে যাওয়া বন এর মধ্যে মরে যাওয়া বা রোস্ট হয়ে যাওয়া প্রাণীর মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করতো বলে ইউভাল নোয়া হারারী তার বই “হোমো সেপিয়েন্স দ্যা হিস্ট্রি অব মেন” বইতে উল্লেখ করেছেন। চিন্তাশীল মানবের আদিতে কি ছিল? দেবীপ্রসাদ ভট্টাচার্যর বই ”সত্যের সন্ধানে মানুষ” এ সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন কি ভাবে ধর্মের আগে যা ছিল। তার লেখা পড়লে বুঝা যায় তিনি বস্তুবাদী বা দ্বান্দিক বস্তুবাদী কিংবা বলা যায় সম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের ঘোর সমর্থক। তা যাই হোক না কেন তার বক্তব্য কতটা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তা’ই বিচার্য হওয়া উচিত। তিনি বলেছেন এখনো বর্তমান আদি সমাজগুলোতে দেখা যায় ব্রত পালন করা হয় মানে হলো প্রকৃতিকে জয় করার মহড়া। যা মোটেও ধর্ম নয়। ব্রত আর পূজায় তফাত আছে। তার বই সত্যের সন্ধানে মানুষ এর ৪৬ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন “ব্রতের ফুলের সঙ্গে পুঁজর ফুলের তফাত আছে। ধর্ম বিশ্বাস বলতে ঠিক কি বোঝায়? বোঝায় পৃথিবীর ঘটনাগুলো পৃথিবীর নিয়ম অনুসারে ঘটছে না; তার বদলে ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঘটছে। এই ঈশ্বরকে ফুল দিয়ে, নৈবেদ্য দিয়ে খুশি করা যায়, তাঁর ইচ্ছের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া যায় – ইত্যাদি। আদিম মানুষের হালচালটা ভালো করে পরীক্ষা করো। দেখবে, দেবতা মানে কি, ঈশ্বর মানে কি, ভগবান মানে কি- এ সব কথা ওরা কিছুই জানে না। ওরা জানে না পুজো করতে, প্রার্থনা করতে, ফুল নৈবেদ্য দিয়ে দেবতাকে খুশি করবার কল্পনা করতে। ওদের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাসের পরিচয় নেই। তার বদলে, পরিচয় শুধু জাদু বিশ্বাসের।“ ইসলাম ধর্মে কিংবা ইহুদী ধর্মে মুসা আঃ এর যে ঘটনা তাতেও দেখা যায় তাঁর হাতের লাঠি সাপ হয়ে তখনকার সকল জাদুকরের জাদু খেয়ে ফেলে। ধর্মের আগে জাদু বিশ্বাস যে মানব সম্প্রদায়ে ছিল এটা তার একটা বড় প্রমাণ বলা যায়।

ব্রত বা যজ্ঞ এক রকম মহড়া যা টোটেম বিশ্বাস থেকে আসে। জগতে জয় লাভের জন্য কোন প্রার্থনা কিংবা স্রষ্টার কাছে আকুতি কিংবা তাকে তুষ্ট করার জন্য কোন প্রাণী বলি এর চল নাই এতে। এটা নিতান্তই এক প্রকার উদ্দীপনা জাগানিয়া ও সমবেত শক্তির উচ্ছ্বাস জনিত একপ্রকার নৃত্য যা প্রকৃতিকে বা প্রকৃতির সাথে সংগ্রামের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করা। তখন সমাজে টোটেম বিশ্বাস ছিল, মানে হলো কোন গোত্রের সবাই মনে করতো তারা হরিণ থেকে হয়েছে তাই তারা হরিণের দল, হরিণ হলো তাদের টোটেম। কেউ ভাবতো তারা সূর্যমুখী ফুল থেকে হয়েছে তাই তাদের টোটেম ছিল সূর্যমুখী ফুল। সবার মধ্যে একই শক্তি ও প্রভাব, কেউ কার চেয়ে উন্নত বা অনুন্নত নয়, সবাই সমান। সেটা ছিল শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা যাতে কোন গোত্র প্রধান বলে কিছু থাকতো না বা থাকার প্রয়োজন পড়ত না। সবাই তাদের টোটেম থেকে হয়েছে তাই সবাই সমান। তখন হাতিয়ার ছিলো অনুন্নত আর শিকারের মাধ্যমে যা জুটত তাতে সবার কোন মতে খেয়ে পড়ে চলে যেত। বাড়তি উৎপাদন বা প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য সংরক্ষণ কাকে বলে ও কেন দরকার তা’ও বোধ হয় তাদের চিন্তায় বা বুদ্ধিতে ছিল না।

এর পর যখন মানুষ কৃষি কাজ শুরু করল বা সংঘবদ্ধ ভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে শিকার করা শিখল কিংবা বলা যায় প্রথম প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে শিকার ছেড়ে ভূমি কর্ষণ করে খাদ্য উৎপাদন করতে শিখল, লোহা বা শীশা গলায়ে অস্ত্র তৈর করতে পারল তখন তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারল আর তখনই শুরু হলো সঞ্চিত সম্পদের বণ্টন জনিত সমস্যা। আগে ছিল প্রকৃতির সাথে মানুষের সংগ্রাম এর পর শুরু হলো মানুষের সাথে মানুষের সম্পদ বণ্টনের সংগ্রাম। এ সময়টাতেই সমাজে শ্রেণীর আবির্ভাব অর্থাৎ শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীযুক্ত সমাজে উত্তরণ। শ্রেণী সমাজে গোত্র প্রধান, পুরোহিত, শ্রমজীবী মানুষ ইত্যাদির সমাহার আর তার সাথে সাথে সামাজিক নীতি নিয়ম ও ধর্মের উৎপত্তি। কিছু মানুষ অন্যর উৎপাদিত বা উপার্জিত সম্পদ বিনাশ্রমে অর্জনের সুযোগ করে নিলো আর ধর্মের ধ্বজা উড়ায়ে আকাশ কুসুম ভাববার সুযোগ পেল। এ সময়টাতে মন্ত্রশক্তি আর মন্ত্রগুপ্তির চল হয়েছিল বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন। এ সব পর্যায় উত্তরণ চট জলদি হয়নি বরং শত শত বছর বা শত কোটি বছরের বিবর্তন বা পরিবর্তনের ফসল এই শ্রেণী সমাজ। দেবীপ্রসাদ ভট্টাচার্যর অতি পুরাতন বেদ থেকে শ্লোকের উদাহারণ দিয়ে দেখিয়েছেন কখন শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণী সমাজের বিবর্তন হয়েছে যার প্রমাণ উনি বেদ বেদান্ত উপনিষদের বিভিন্ন পুথি’র নানান গল্পের মধ্যেও নজির পেয়েছেন। সমাজতান্ত্রিকদের বক্তব্য অনুসারে শ্রেণীযুক্ত সমাজ মূলত শোষক ও শাসিতের সমাজ যেখানে একদল শ্রমজীবী মানুষকে অপর একদল মানুষ শোষণ করে জীবন নির্বাহ করছে বা করে আসছে। বর্তমানের উদ্যোগতা ও ভোক্তা শ্রেণীকরণ এর সাথে এর পার্থক্য আছে। বর্তমানের সমাজ আমার মনে হয় বেশ জটিল তবে শোষক ও শাসিত ধারণাটি চলমান আছে, জটিল নগর জীবনের জট খুললে এই সরলীকরণ ফুটে উঠবে ঠিকই। ধর্ম বা ঈশ্বর বিশ্বাস শোষক বা শাসক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে জন্ম থেকেই কাজ করে আসছে। পুরাণ জমিদার বাড়িগুলোর কাছে বা একেবারে মধ্যখানে একটা মন্দির অবশ্য অবশ্যই পাবেন। ধার্মিকতার ধারণা অনুচ্ছেদের শেষে বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন, “এটি সম্ভবত সত্য যে মনুষ্য-জাতি স্বর্ণযুগের দোরগোড়ায়, কিন্তু যদি এটা সত্যই হয়, তবে প্রথম প্রয়োজন সেই ড্রাগনটিকে কেটে হত্যা করা যে দোরগোড়ায় পাহারা দিয়ে বসে আছে এবং এই ড্রাগনটি হল ধর্ম।”একই অনুচ্ছেদের শুরুর দিকে তিনি বলেছেন “ধার্মিকতার ধারণার সারবস্তুটি হল বিচারের নামে নিষ্ঠুরতার বোরখা পরা ধর্ষকামের বহির্গমন ( The Essence of the conception of righteousness, therefore, is to afford an outlet for sadism by cloaking cruelty as justice.)" ধর্ম নিয়ে মানুষের বাড়াবাড়ি দেখলেই বুঝা যায় তাদের আচরণগুলো যতটা ধর্মানুরাগের জন্য তার চেয়ে বেশী ধর্মটাকে নিজের মনে করার জন্য। আমি আগের লেখা গুলোয় উল্লেখ করেছি যে, ধর্ম মানুষকে এক ধরনের প্রগাড় প্রশান্তি দেয় যা তাকে জগতের সকল অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে এবং তাতে তার দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে উঠে। যখনই তাকে চ্যালেঞ্জ করা হয় তখন সে ক্ষেপে যায়। অন্য ধর্মের চেয়ে তার ধর্মটি সঠিকতার বিচারে শ্রেষ্ঠ এটা অনুধাবন করে সে মহা তৃপ্তি অনুভব করে। কেউ সেই কমফোর্ট জোন বা পাকা ধানে মই দিতে গেলেই সে হই হই করে তেড়ে আসে। আসাটাই স্বাভাবিক কারণ সে অত্যন্ত সহজে এই পুণ্যভূমি দখলদার তাকে তা থেকে উৎখাত করতে যে আসবে তার রক্ষা থাকার কথা না।

আমরা যখন কোন অশুভ আশংকা করি ধরা যাক একমাত্র পুত্র সন্তান অসুস্থ কিংবা মা অসুস্থ আর তার অসুখের কারণ ডাক্তারের অজানা। এ রকম অবস্থায় আমাদের মন একটা সহায় খুঁজে আর সাধারণের বক্তব্য হলো যার কেউ নাই তার বিধাতা আছে। অসুস্থ পুত্রর জন্য দাওয়া তো চায়ই সাথে দোয়াও চাওয়া জরুরী। মানুষ তখন খড় কুটা আঁকড়ে ধরতে চায়। বারট্রান্ড রাসেলের ফতোয়া যে ভয় থেকেই সকল ধর্মের উৎপত্তি তা সত্য বলেই মনে হয়। মানুষের না না রকমের ভয় সেই অনাদিকাল থেকেই তাকে আকৃতি দান করে আসছে। পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহ করতে না পারার ভয় বা আশংকা, অসুস্থতা হতে মুক্ত না হতে পারার ভয় বা আশংকা, একাকীত্বর ভয়, এরকম নানা প্রকারের ভয় তাকে আস্টে পৃষ্টে বেধে রেখেছে। ভয় তা হলো মানুষের সহজাত। ভয় কে জয় করার মাধ্যমে মানুষ উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়। মূলত বিভিন্ন ভয়কে জয় করে চলাই জীবন সংগ্রাম। ধর্ম এই ভয়কে জয় করতে সর্বত ভাবে সহায়তা করে। ধর্মের করাত দুদিকেই কাটে। যদি আশা পূর্ণ হয় তবে বিধাতা মহান আর না হলে বিধাতা যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন।

আমার এক স্কুলের বন্ধু নওশাদ মাঝে মাঝে আমাদের স্কুল বন্ধুদের ভাইবার গ্রুপে আচমকা কিছু তত্ত্ব কথা ছেড়ে দেয়, কেউ বুঝুক আর নাই বুঝুক ও এ রকম করবেই। একবার ওর লেখা গুল নিয়ে আমার ভিন্ন মতগুলো উল্লেখ করেছিলাম, তাতে কিছুই হয় নাই, ও পুরোপুরি নির্বাক ছিল। ০২ এপ্রিল, ২০২৩ এ ওর আরেকটা লেখা পেলাম যেখানে সেই ভয় এর কথাই ও বলেছে। ও’র কথাগুলো হুবহু তুলে দিচ্ছি “উপেক্ষা করা যায় না এমন একটি প্রবল পরাক্রমশালী সত্ত্বার উপস্থিতি যখন কেউ উপলব্ধি করতে পারে, তখন ভয় মাখানো এক বিস্ময় নিয়ে সে নতুন এক সচেতনতার মোড়কে নিজেকে আবৃত করে চারপাশের বাস্তবতাকে দেখতে পায়। এই ভয় মাখানো বিস্ময় [আরবিঃ তাক্কওয়া] জাগিয়ে রাখা আর স্রষ্টার বিশ্বাস করা এক নয়। বিশ্বাস যারা করতে পেরেছে তাদের তাক্কওয়া বা স্রষ্টার সচেতনাত ধরে রেখে সৎকর্মশীল হয়ে চলতে থাকার প্রশিক্ষণ হিসেবে রোজা রাখার উপদেশ দেয়া হয়েছে কোরআনে (২:১৮৩) । এই মানব সত্ত্বা এই সচেতনতা স্বেচ্ছায় তুলে ধরবে সুখে বিনয়ী থাকায়, কষ্টে অবিচল থাকায়, কঠিন হলেও সত্য বলার জন্য দাঁড়াতে – তবে সম্মানের সাথে তা করতে এবং কখনোবা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষয় সহনশীল হওয়াতে। নিজের মাঝে শালীনতা ও চরিত্রের শুদ্ধতা বজায় রাখায়, প্রকাশ্যে গোপনে দান করতে – তবে স্রষ্টাকে খুশি করার জন্য অন্য কারো অনুরাগ কামনায় নয়। এমনকি সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার প্রচেষ্টার মাঝেও, তার কাছে প্রত্যাশিত হয় যে, সে প্রকাশ্যে জাহির করার অভিপ্রায় এড়িয়ে যেতে তাক্কওয়া ধরে রাখবে। প্রতিটি রমাদান মাসই স্রষ্টায় সচেতনাতা গড়ার জন্য এবং পরবর্তী রমাদান পর্যন্ত ১১ মাসে এই তাক্কওয়া পরিচর্যা করার জন্য একটা বিশেষ মাইলফলক হয়ে ফিরে আসে।“ এই বক্তব্য থেকেই বুঝা যায় বর্তমান এই শহরের মানুষের মানুষিক অবস্থা কোন পর্যায়ের । তারা মারত্মক ভাবে ধর্মের প্রতি অনুরক্ত এবং নিজেরাই এর আচার বিচার করে বক্তব্য দিচ্ছেন। যখন তার ধর্মগ্রন্থেই বলা আছে কেন রোজা ফরজ করা হয়েছে সেখানে তার মানে আমার বন্ধুর মনে এত এত কারণ জন্ম নিলো কেন, কি কারণে সে এর উপকারিতা কিংবা এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে। ধর্মানুরাগীদের তাদের ধর্ম নিয়ে বার বার তাকে সত্য প্রমাণের চেষ্টা প্রমাণ করে যে তাদের মনের অত্যন্ত গভীরে সন্দেহের বীজ বপন করা আছে। এক রিক্সা চালক বৃদ্ধ বলছিলেন তপ্ত গরমে ক্লান্ত হয়ে এক দিন রিক্সা চালান নি, রেডিও খবরে শুনলেন তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নাই কিন্তু আসরের আজানের পরই হাওয়া ছাড়ল তখন রেডিও খবরে প্রচার করা হলো বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। তিনি বোঝাতে চাইলেন এমনকি বললেনও লোকে যে বলে কোরআন সত্য নয় এই দেখ তার প্রমাণ যে কোরআন সর্বত ভাবে সত্য। ইন্ডিয়ান আইডল এ দেখাচ্ছে এক কিশোরী গায়িকা তার গান গাচ্ছে, ঈশ্বর সত্য হে – শিবই ঈশ্বর হে – শিব সুন্দর হে – সত্যম-শীবম-সুন্দরম। খেয়াল করে দেখবেন এখানে ঈশ্বর কে শিব ও শিবকে সুন্দরের সাথে যুক্ত করে সেই সুন্দরের পূজা করা হচ্ছে। ও’রা তো শিব লিঙ্গরও পূজা করে থাকে, তার উপর কলশি কলশি দুধ ঢেলে আচার অনুষ্ঠান করে। তাদের এরূপ উদ্ভট আচরণের বিরোধিতা করায় এক বিশাল জনসভায় এক ভারতীয় মহিলাকে অপদস্থ হতে হয়েছিল। তার যুক্তি ছিল এত দুধ এভাবে অপচয় না করে যারা দরিদ্র শিশু খেতে পায় না সেই সব বাচ্চাদের দেয়া উচিত।

বারট্রান্ড রাসেলের কথায় ফিরে আসি তিনি বলেছেন “আমি এই রকম কোন ভান করতে চাই না যার দ্বারা বোঝাবে যে আমার প্রমাণ করবার সামর্থ্য আছে যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই। একই ভাবে আমি এটাও প্রমাণ করতে পারব না যে শয়তান মানেই হল কল্পিত কাহিনী। খ্রিষ্টীয় ঈশ্বর থাকতেই পারে এবং ঠিক একই ভাবে অলিম্পাসের ঈশ্বর, অথবা প্রাচীন ইজিপ্টের ঈশ্বর অথবা ব্যাবিলনের ঈশ্বর থাকতেই পারে। কিন্তু এদের মধ্যে কোন প্রকল্পই (hypothesis) একে অন্যের চেয়ে অধিক সম্ভাব্য নয় এমন কি এই সমস্ত প্রকল্পগুলি বা অনুমানগুলি সম্ভাব্য জ্ঞানের অঞ্চলের বাইরে অবস্থান করে থাকে। এই জন্যেই তাদের কোনটাকেই বিবেচনা করে দেখার কোন কারণ নেই। ” -বারট্রান্ড রাসেল, প্রকৃতি ও মানুষ অনুচ্ছেদ। আমার ৫১ বছর এর অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় যেন এত সব কিছুই উদ্ভট। মানব সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টা তাহলে স্রষ্টাকে সৃষ্টি করল কে? যদি বলি মানুষই সৃষ্টি করেছে স্রষ্টাকে তারপর তাকে হত্যা করেছে কোন দ্বিধা ছাড়াই তবে এই ইহলোকেই আমার জীবন নিপাত যাবে ওই যারা স্রষ্টাকে সৃষ্টি করেছে তাদের দ্বারা। স্রষ্টা নেই, কোন কালে ছিলোও না। মানুষই স্রষ্টাকে সৃষ্টি করেছে আর আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেদের প্রয়োজনে। এখন স্রষ্টার নাম নিয়ে ব্যবসা, রাজনীতি, সমাজনীতি সব করায়ত্ত করছে আর এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঘুম পাড়ায়ে রেখেছে। এই সহজ সরল সত্যটা বিশ্বাস করতে মানুষ ভয় পায় আর ভয় থেকে পালাতেই ধর্মের জন্ম, স্রষ্টার জন্ম, যে সকল কিছুর প্রতিপালক, ও সকল ভয়য়ের বিপরীতে আস্থা ও ভরসা প্রদানকারী। যারা বহু অতীতে বেদ রচনা করেছেন তারাও বলেছেন এটা দৈব বানি। বেদান্ত উপনিষদে তারই ব্যাখ্যার চলমান প্রবাহ। সেমেটিক ধর্মগুলোরও তো প্রচুর ধারা উপধারা। এত সব গাজাখুরি মানুষ কেন বিশ্বাস করে তার ব্যাখ্যাও তো বিজ্ঞ লোকজন মানে ভিন্ন মনষ্ক বিজ্ঞ লোকজন দিয়েছেন। তার পরও যারা ধর্মানুরাগী তারা ধর্ম ছাড়তে নারাজ কেন? কারণ ওই ভয়। কি জানি কি হয়। এই অনুভূতির কি কোন বিকল্প আছে, আমি আপনাদের আর আপনারা সবাই আমার, এ এক অভূতপূর্ব ভালবাসার অনুভূতি। লতায় পাতায় জড়ান একই পরিবার ভুক্ত হওয়ার অনুভূতি। যার বাস্তব প্রতিফলন হয় ধর্মে। কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝেও এই অনুভূতিরই জয়।

অমর আত্মা সম্পর্কে বারট্রান্ড রাসেলের উক্তি গুলোও বেশ সরস, তিনি বলেছেন “অধিবিদ্যা বিদরা আত্মা যে অবশ্যই অমর তা প্রমাণ করতে বহু যুক্তি প্রদান করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। একটি সরল পরীক্ষা দ্বারা এই সমস্ত যুক্তি গুলোকে নস্যাৎ করা যেতে পারে। সমস্ত অধিবিদ্যা বিদরা সমানভাবে প্রমাণ করেছেন যে আত্মা সমগ্র অনন্ত জুড়ে ব্যাপ্ত রয়েছে। অনেক দিন বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যেমন মোটা হতে হবে এমন কোন আগ্রহ থাকে না, সেই রকমই কোন অধিবিদ্যা বিদরা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে তাদের যুক্তিগুলোকে প্রয়োগ করার দিকে লক্ষ্য করেন না। এটা অন্ধ হয়ে থাকার আকাঙ্ক্ষার এক আশ্চর্য ক্ষমতা যা অতি সমর্থ মানুষকেও ভুল যুক্তির পথে পরিচালিত করে থাকে যেটা না হলে সবকিছুই সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যেতো। যদি আমরা মৃত্যুকে ভয় না পেতাম, তাহলে আমি বিশ্বাস করি না যে কখনও অমরত্বের ধারণা গড়ে উঠতে পারত। ধর্মীয় মতের ভিত্তি হল ভয়, যা মানবজীবনে রাজত্ব করে চলেছে”। একই বই এর ৬৬ পৃষ্ঠায় তিনি আরো বলেছেন “ভয়াবহতাই ধর্মের মূল উৎস। সে কিছু কিছু ধরণের ভীতিকে মর্যাদা প্রদান করেছে এবং মানুষকে তাদের সম্পর্কে অশ্রদ্ধা করতে কখনও শেখায়নি। এই পথেই সে মানুষের জন্য সব থেকে বড় অকাজটি করেছে। সমস্ত রকম ভীতিই খারাপ (all fear is bad)। আমি বিশ্বাস করি যখন আমি মরবো তখন আমি পচব এবং আমার কোন রকম অহংকারই বেঁচে থাকবে না। আমি যুবক নই, এবং আমি জীবনকে ভালবাসি। কিন্তু মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ভয়ে কাঁপাটাকে আমার অবশ্যই ঘৃণা করা উচিত।”  


সুইজারল্যান্ডের সার্ন বা CERN এর LHC লার্জ হেড্রন কোলাইডার যেই বিশাল কণা ত্বরক যন্ত্রের মাধ্যমে এই কিছুদিন আগে হিগস বোসন বা গডস পর্টিকেল আবিষ্কৃত হলো তার প্রবেশ পথের সামনে একাদশ শতাব্দীর দক্ষিণ ভারতের নটরাজ শিব বা নাচের রজা’র বিশাল মূর্তি যা ভাস্কর্য আকারে স্থাপন করা আছে। এই নটরাজ শিব এর নৃত্যরত মূর্তি সম্পর্কে এলডাস হাক্সলিও বক্তব্য দিয়েছেন যেন তা মহাবিশ্বর ভারসাম্যকে প্রকাশ করে। সেই অতীতে মনুষ্য জ্ঞান বুঝতে পেরেছিল এই মহাবিশ্বর একটি অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হলো ভারসাম্য। মিথের শক্তি বইটির শুরুতেও এই ছবি ও তার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে শিবের চুলে রয়েছে এক মুণ্ডু আর এক নবচাঁদ, একই সঙ্গে মৃত্যু ও পুনর্জন্ম। এই মুহূর্তটাই হয়ে ওঠার মুহূর্ত বা সৃষ্টির মুহূর্ত। এক হাতে ধরা ছোট্ট এক ঢোলক-ঢিপ ঢিপ করে বেজে চলে। ওটা হলো সময়ের ঢোলক—ওতে চিরায়ত জ্ঞান চাপা পড়ে। কিন্তু শিবের অন্য হাতে রয়েছে অগ্নিশিখা। এতে সময়ের পর্দা পুড়ে যায় এবং আমাদের মন খুলে যায় চিরায়তের দিকে। সৃষ্টি – প্রলয় –ধ্বংস আবার পুন সৃষ্টি এই চক্রে সারা মহাবিশ্ব চলমান বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করে। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে অনেক নিরাকার ঈশ্বর বিশ্বাসীকে হাস্য রস করতে শুনা যায় এই বলে যে, এরা এতটাই মূর্খ যে ভাবে মাটির পুতুল যা তারা নিজ হাতে নির্মাণ করেছে তাদেরকে স্রষ্টা হিসেবে পূজা করে। কিন্তু হিন্দু ধর্ম সনাতন ধর্ম আর তার মূল বহু অতীতে প্রথিত তা তারা জানে না বলেই একে হেলা ফেলা করে। কোন ধর্মকেই আসলে হেলা ফেলা করার আসলে কোন উপায় নাই। তবে সকল ধর্মকে মানব সভ্যতার এক বিশেষ পর্যায়ে উৎপন্ন হওয়াতে মনে হয় তা মানব বিবর্তনের একটা অংশ। ধর্ম সকল একটা বিশেষ সময়কাল ধরে উদ্ভূত হয়েছে। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ বছর থেকে ১০০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই সব ধর্মের উদ্ভব। মানব বিবর্তনের শত কোটি বছরের ক্যানভাসে তা কয়েক মিনিট মাত্র। আজকাল তো আর নতুন নতুন ধর্ম আবির্ভূত হচ্ছে না বা সারা বিশ্বের কোন প্রান্তে দৈব বানী প্রাপ্ত কোন দেবদূতের আগমন ঘটছে না। বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা করলেই এই চিন্তার জট খুলে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

হাসান নাসির তার বই বিশ্বাস ধর্ম যুক্তিতে প্রশ্ন করেছেন অনেক যার বেশির ভাগই ধর্মানুরাগীদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। তিনি যে আরজ আলী মাতব্বর এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন তা বুঝা যায়। তার একটা প্রশ্ন খুব চমৎকার আর সেটি হলো এক আদি পিতামাতা আদম ও হাওয়া হতে যদি সমগ্র মানব জাতির বিস্তার হয়ে খাকে তবে পৃথিবীতে এত শত সহস্র ভাষা কোথা থেকে আসল। সেমেটিক ধর্মগুলো মানে ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলিম রা বিশ্বাস করে দাজলা আর ফুরাত নদির উপত্তকা থেকে সারা পৃথিবীতে মানব সম্প্রদায় ছড়ায়ে গেছে, তাই যদি হতো তা হলে দূরবর্তী দীপ অণ্ট্রেলিয়া কিংবা এক সময়কার অজানা ভূখণ্ড উত্তর ও দক্ষিণ এমেরিকাতে মানুষ কোথা থেকে উদয় হলো? মিথের শক্তি বইটি মূলত জোসেফ ক্যাম্পবেল এর সাথে বিল মায়ার্সের কথোপকথন। জোসেফ ক্যাম্পবেল বলেছেন মিথ বা ধর্মসকল অত্যন্ত শক্তিশালী মানুষের ভাব অন্তর থেকে আসে যাকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। মানব সমাজে মিথের প্রভাব চিরকাল ছিল আর ভবিষ্যতেও থাকবে। এই বই গুলো পরে আমার মনের গভীরে যে ধর্মের ভিত্তি প্রস্তর ছিল তাতে বিশাল চিড় ধরে গেছে। ধর্ম সকল মানুষের কল্পনা প্রসূত তা বুঝতে আমার আর বাকি নাই। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এত গুলো ধর্মের উৎপত্তি কেন হলো আর তার সময়কাল বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে স্রষ্টা এক হলে এত ধর্মের উৎপত্তিই হতো না। একক ধর্মেই সবাইকে প্রোগ্রাম করে ছেড়ে দেয়া হতে পারত। যা হোক সেটা আমার অনুমান মাত্র, আর আমি অন্যকে আমার মত করে ভাবতেও বলি না। আমার চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে সেটাই আমি শুধু উল্লেখ করলাম। আমার ইদানীং কালের লেখা গুলো ধর্ম বিরোধী হওয়াতে হোয়াটস এ্যাপ গ্রুপের একজন বলে বসেছিল আমার কোন ইসলাম বিরোধী লং টার্ম এজেন্ডা আছে। বহু বাক বিতণ্ডার পর কিছুটা হলেও বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, আমার কোন দীর্ঘ মেয়াদী দুরভিসন্ধি নাই, নিজের চিন্তাভাবনা গুলো গুছায়ে লেখা ও অন্যের সাথে শেয়ার করা ছাড়া আমার তেমন কোন উদ্দেশ্যও নাই। আমার লেখা পড়ে বিরূপ মন্তব্য কিংবা কারো ভাল লাগার কথা শুনলে ভাল লাগে, সমালোচনা করলে পুরো লেখাটা আবারও পড়ে দেখি সমালোচনাটা সঠিক কিনা তা যাচাই করার জন্য। আমার নিজের মানসিক উন্নয়নই মূলত এত কিছু লেখার পিছনের কারণ বলে আমি মনে করি। তবে ইতিহাস সাক্ষী, Clash of civilization বা সভ্যতার সংঘাতে যারা হেরে গেছে তাদের নিয়ে কার মাথা ব্যথা নাই, যারা জয়ী হয়েছে তারাই এখন রুল বা রাজত্ব করছে। সময় কার জন্য থেমে থাকে না। সবাই আগায়ে যায়। মুণ্ড ছিন্ন আজগরের মত পরে থাকে পরাজিত সভ্যতা, এক সময় হারায় যায় তার সব সুন্দর দিক গুল, পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। 

তথ্য সূত্রঃ
১। কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই –বারট্রান্ড রাসেল, ভাষান্তর অরিন ভাদুড়ী, প্রকাশ কাল ফেব্রুয়ারী ২০২২।
২। লক্ষ্য ও পথ –আলডাস হাক্সলী, অনুবাদ মুহাম্মদ হাবীকুর রশিদ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫।
২। সেপিয়েন্স – মানুষের ইতিহাস মূলঃ ইউভাল নোয়া হারারি, ভাষান্তরঃ সুফিয়ান লতিফ, শুভ্র সরকার, রাগিব আহসান, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
৩। সত্যের সন্ধানে মানুষ – দেবপ্রিসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারী ২০১৬।
৪। বিশ্বাস ধর্ম যুক্তি – হাসান নাসির, প্রথম প্রকাশ একুশে বইমেলা ২০১৩।
৫। মিথের শক্তি – জোসেফ ক্যাম্পবেল, অনুবাদ খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, প্রথম বাংলা সংস্করণ ১৯৯৫, ঢাকা।


এডিট ও আপডেট হিস্ট্রিঃ ০১ফেব্রুয়ারী২০২৩>১৭ফেব্রুয়ারী২০২৩> ২৩মার্চ২০২৩> ৩০মার্চ২০২৩ > ৫এপ্রিল২০২৩> ১৮এপ্রিল২৩>১৭মে২৩> ২২মে২৩> ১৪জুন২৩>  ০৫ডিসেম্বর২০২৩>