আমার এক কলিগের বিয়ের কার্ডে তার বাড়ি মুন্সিগঞ্জ যা আমার দেশের বাড়ি জানতে পেরে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম মুন্সিগঞ্জ এর কোথায়? সে বললো ঘোড় দৌড়, শুনে খুব অবাক লাগলো, এই নামে মুন্সিগঞ্জে গ্রামও আছে? আশ্চর্য। অবশ্য মুন্সিগঞ্জের গ্রামের নাম পয়সা বা পয়সা গাও এরকমও আছে। ঘোড় দৌর বা হর্স রেস নামে নামকরণ করা আছে আমার জীবনের স্মরণীয় এক দাবা খেলার। আমি ছোটবেলায় একা একা বড় হয়েছি, মাঠের খেলা তেমন একটা খেলার সুযোগ পাই নাই কিন্তু দাবা খেলা সেই শৈশব থেকেই আমাকে দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করত। তখন গ্র্যান্ড মাস্টার রানি হামিদ আর নিয়াজ মোরশেদের কথা প্রায়ই পত্রিকাতে আসতো আর এই দাবা খেলার প্রতি আমার আগ্রহও তখন প্রচুর ছিল। দাবা খেলায় একটা আশ্চুর্য় ঘটনা টিভির খবরে দেখিয়েছিল সেই সময় যেখানে গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ মোরশেদ চোখে কাপড় বেধে পর পর ৮ জনের সাথে একনাগাড়ে দাবা খেলে গেছেন। এটা দেখে আমি যার পর নাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন মালিবাগের নানীর বাসায় আমাকে একা রেখে মা চলে গিয়েছিলেন লিবিয়ায় বাবার কাছে। আমি তখন ছোট মামা বা রাঙ্গা মামা আর মেঝ মামা, আমার লাল মামার সাথে দাবা খেলতাম। লাল মামা সৌন্য আগে বাড়িয়ে ছাতার মত করে বলতো এই দেখ বুহ রচনা করেছি। আর ছোট মামা নির্দিষ্ট করে বলে দিয়ে খেলতো, বলতো তোমাকে আমি ওই জায়গায় আসতে বাধ্য করব তার পর ওই পনটি বা পিসটি তোমাকে হারাতেই হবে, তা তিনি করেও দেখাতেন। দাবা খেলার উপর রানি হামিদের লেখা বইও কিনেছিলাম যা থেকে কিভাবে দাবা খেলা লিখে রাখা যায় তা শিখেছিলাম। আমার কৈশোরের একটা মাত্র একটা দাবা খেলা আমার জন্য চরম একটা অভিজ্ঞতা দিয়েছিল যার কথা এখানে আমি বলবো তার আগে বলে নেই আমি দাবা খেলা যে খুব ভাল খেলতাম তা নয়, তবে প্রচুর খেলতাম তা বলা যায়। দাবা খেলা প্রচুর সময় সাপেক্ষ হলেও তা পুরটাই মনস্তাত্ত্বিক ও বেশ চেলেঞ্জিংও বটে। ছোট বেলায় যখন লিবিয়ায় ছিলাম, তবরুখ শহরে বাবার অফিসে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল দুইবার। বাবা তবরুকের পাওয়ার প্ল্যান্টে চাকুরী করতেন। ওখানে উনি তার কলিগদের সাথে অবসরে দাবা খেলতেন। ওখানেই প্রথম পকেট দাবা দেখি। এক বুলগেরিয়ান আংকেল বাবাকে একটা পকেট চেস গিফ্ট করেছিল, ওই ছোট্ট দাবাটি আমি বহুকাল সংরক্ষণ করেছিলাম। তার কয়েকটা গুটি হারায়ে যাওয়ার পরও অন্য একটা পকেট দাবা’র গুটি দিয়ে ওই দাবার সেটটি পূর্ণ করে তা দিয়ে দাবা খেলেছি।
আমাদের দোতালা বাসার পাশে একতালা বাসায় থাকতেন জনতা ব্যাংকের ম্যানেজার অলি আহমেদের পরিবার তার তিন ছেলেমেয়ে সহ। ইরানা আপু, নকভী ভাই আর রিজভী। আমি পড়াশুনায় বেশ ভাল রকমের ফাঁকিবাজ ছিলাম। দুই দিকে পড়ার বই এর পাহার রেখে মাঝখানে পকেট দাবার বোর্ড রেখে খেলতাম যখন সামনে পড়ার বই খোলা থাকতো। একদিন মা’র কাছে ধরা পড়ে গেলাম। মা চিৎকার করে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলছিল “দেখ দেখ তোমার ছেলে বই এর নিচে দাবা রেখে খেলছে।” ওইদিন রাতে ইরানা আপু একা একা হাঁটছিল পাশের ছাদে, ছাদটা আমার পড়ার ঘরের পাশে, উনি এই কথা শুনে নাকি অনেক হেসেছিলেন। পরে জানতে পারি সেই কথা। ইরানা আপু বুঝতে পারেন নাই যে বই এর নিচে দাবা রেখে কি ভাবে খেলা যায়। মা যত আমাকে বকা ঝকা করত আমার জেদ তত বেড়ে যেত, আমি এর পর কাগজের দাবা বানিয়েছিলাম, মানে হলো দাবার বোর্ড কাগজের আর বোড়ে আর পিস গুলোও দ্বিমাত্রিক কাগজের, তা দিয়ে খেলার চেষ্টা করেছিলাম। তবে এ সবই ঘটেছিল সেই ক্লাস ৫ কি ৬ এ পড়ার সময়। শ্যাওড়াপাড়ায় থাকাকালীন এলাকার অনেককে নিয়ে দুই বার দাবা টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছি। দাবা খেলা গুলো লিখে রাখার ব্যবস্থাও করেছিলাম সেই সময়। একটা বিষয় দেখতাম অনেকের সাথে দাবাতে আমি জিততে পারলেও কার কার সাথে আমি কখনই পারতাম না। যাদের সাথে পারতাম না ও’রা যে পড়াশুনায় চৌকশ তা’ও নয় তবে দাবা খেলায় তারা দারুণ দুর্দান্ত। একবার সংসদ ভবনে গিয়েছিলাম বন্ধদের সাথে বেড়াতে, তখন সংসদ ভবনটার চত্বরগুলো উন্মুক্ত ছিল সবার জন্য, তাই আমরা প্রচুর যেতাম ওখানে, সাইকেল নিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রচুর গিয়েছি লুইস আই কান এর নির্মিত মাস্টারপিস আর্কিটেকচার আমাদের সংসদ ভবনের চত্বর গুলোতে। একদিন দেখলাম দু জন দাবা খেলছে তো আমি বসে গেলাম একজনের সাথে। ওই খেলাতে আমার খেলার ঘোড়ার চালগুলো দিয়ে আমিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। অতি দ্রুত বিপক্ষকে হারায়ে দিয়েছিলাম সেদিন। মঠের খেলা গুলো মানুষকে অনেক কিছু শেখায় তবে ইনডোর গেইম গুলোও কম যায় না। দাবার একেকটা বোর্ড একেকটা স্ট্রেটিজিক পজিশনিং। যুদ্ধক্ষেত্রে ঠিক এরকম অবস্থারই সৃষ্টি হয়। যদিও এখনকার যুদ্ধগুলো ত্রিমাত্রিক যুদ্ধ আর অনেক জটিল কিন্তু ক্ষমতার টানাপড়েনে ঠিক দাবার মতই হয়। যারা দাবা খেলে তদের স্ট্রেটেজি সম্পর্কে ও পরিস্থিতির সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা হয়। এটা বাস্তব জীবনে কাজে আসে অবশ্যই।
১৯৯০ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি পড়ার সুযোগ হয় আমার। ওই সময় টিফিন টাইমে অনেকেই ভলি বল খেলতো, ছোটবেলায় কেউ আমাকে ভলি বল খেলা শিখায় নাই বা আমি ওদের সাথে যোগ দিতে দ্বিধা বোধ করতাম। দু এক বার যে চেষ্টা করেছি তা নয়, তবে ভাল পারতাম না। তাই দুরে মাঠে যেয়ে বসে থাকতাম। ওখানে আরেকজন বন্ধুও জুটে গেল যে দাবা খেলে। তবে সে আয়াসের সাথে খেলতো, মানে হলো আমি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আর সে শুয়ে শুয়ে আয়েস করে খেলতো। আমি প্রথম কয় দিন ওর কাছে হেরে গেলাম। হারার কারণটা আমি তৃতীয় দিন বুঝে গেলাম, ও যে কোন ভাবেই হোক আমার চেয়ে এক পয়েন্ট মানে হলো একটা বড়ে আগায়ে যেত তার পর সমান সমান পিস গুলো বাদ করে দিলে ও’র জিতা ঠেকায় কার সাধ্য। এই কৌশলটা বুঝতে পেরে আমি পরের দিন আর ও’কে সেই সুযোগ দিলাম না আর খেলায় জিতে গেলাম আর বললাম যে তোমার কৌশলটা আমি ধরে ফেলেছি তাই এর পর থেকে আমাকে আর অত সহজে হারাতে পারবা না। এই কথা শুনে সে উঠে বসলো, দারুণ ভাবে তার আত্মসম্মানে তা আঘাত করেছে বুঝা গেল। সে আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো। আমি বললাম ঠিক আছে বেট যদি লাগতেই হয় তবে কি নিয়ে হবে। ও বলল একটা কোকাকোলা খাওয়াবে যে জিতবে। আমি রাজি। শুরু হলো সেই দুর্দান্ত দাবা যুদ্ধ। এবার দুজনেই প্রচণ্ড গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে খেলাটাকে। খেলার মাঠ থেকে খেলাটা ক্যান্টিনে নিয়ে যাই অর্ধের খেলার পর ওখানে অনেকের ভিড় হয়ে যায় আমাদের মধ্যে গুরুত্বের আতিশয্য দেখে। এর মধ্যে আমার এক বন্ধু আসে যে আমার সাথে প্রায়ই হেরে যেত। সে যখন শুনলো এটা একটা চ্যালেঞ্জ গেম তখন সে বিপক্ষকে আমাকে দেখিয়ে বলেছিল ও যখন বলছে তবে তুমি নিশ্চয়ই হারবে। এটা শুনে রাসেলের বন্ধু ক্ষেপে গিয়ে কয়েকটা চাল পর পর দিয়ে খেলার মোড়টাই এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেল যে পুর খেলাটা য়েন্ড গেমে চলে গেল আর তার পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেল। খেলার সময় রাসেলও তার বন্ধুর পাশে এসে বসেছিল, এরকম ভরা মজলিশে হেরে যেয়ে যার পর নাই অপমানিত ও দুঃখিত হয়েছিল রাসেলের সেই বন্ধুটি। এতটাই যে আমাকে কোক দেয়ার কথা ভুলেই গেল। আমিও জিতে বেশ বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম তার কিছুক্ষণ পর রাসেল ও তার বন্ধ আমার জন্য কোকাকোলা নিয়ে আসে। আমি নিতে অস্বীকার করার পর নিয়েই নিলাম। টান টান উত্তেজনায় পুর খেলাটা হয়েছিল। খেলাটা আমার মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে, চারদিন মাথার মধ্যে ঘুরেছিল ওই খেলা, চতুর্থ দিন খেলাটা লিখে রাখি। লেখা থাকার কারণে আজ ৩৩ বছর পরও খেলাটা খেলা যাচ্ছে। খেলাটায় আমার ঘোড়ার চাল গুলো খুব মারাত্মক ছিল বলে এর নাম ঘোর দৌর বা হর্স রেস দিয়েছিলাম। নিচে খেলাটা উল্লেখ করে তার কয়েকটা বোর্ড সংক্ষেপে আলোচনা করবো। অনেকই গান গাইতে পারে না কিন্তু তারা ঠিকই গান শুনে মজা পায়। যারা গান গায় তারা পুর মজাটা নেয় ঠিকই কিন্তু যারা শুনে তারাও কম মজা পায় না। তেমনি অনেকেই হয়তো দাবা খেলতে পারেন না কিংবা দাবা খেলায় মজা পান না কারণ তারা দাবা খেলার মজাটা নিতে জানেন না। তাই আমি এমন ভাবে বর্ণনা করবো যাতে সবাই দাবা খেলাটা উপভোগ করতে পারেন।
১৬ মে ১৯৯০ আমি কালো আর রাসেলের বন্ধু সাদা
1.c4 e6 2. Nc3 Na6 3. d4 Nf6 4. Nf3 Bb4 5. Bd2 0-0 6. a3 Ba5 7. e3 c6 8. Bd3 d5 9. c5 Nb8 10. 0-0 Nh5 11. Qc2 g6 12. b4 Bc7 13. b5 Nd7
|
14. Rb1 e5 15. b6 aXb 16. cXb Bb6 17. Na4 e4 @ 18.NXBb6 Nb6 19. Be4 dXe4 20. Qe4 Ra3 21. Bb4 Bf5 22. Qe7 Nd5 23. Qd8 Rd8 24. Ba3 Bb1 25. Rb1 Ra8 26. Bd6 b5
|
27. H3 Nc3 28. Rb2 Nf6 29. Kh2 KNe4 30. Bb4 Nd1 31. Rc2 Ndf2 32. Rc6 Ra1 33. RC8+ Kg7 34. Bf8+ Kf6 35. Rc6+ Kf5 36. Nh4+ Kg5 37. Nf3+ Kh5 38. G4+ Ng4 39. Hg4+ Kg4
|
40. Kg2 Ra2+ 41. Kg1 Kf3 42. Rc1 Ng3 43.Rf1+ NXR 44. Kh1 Ng3+ 45. Kg1 Rg2++ (),!)
|
আমার যতদূর মনে পড়ে ৩৬ চালেই খেলাটার জয় পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়, তার পর রাসেলের বন্ধু রিজাইন করে। ৩৬ থেকে ৪৫ চালগুলো প্রায় নিশ্চিত ভাবে হতে বাধ্য তাই ওগুলোও লিখে রেখেছিলাম। ভরা মজলিশে এভাবে হেরে যেয়ে জানি না রাসেলের সেই বন্ধুর কেমন লেগেছিল কিন্তু চ্যালেঞ্জ করে খেলে জিতে আমার আত্মবিশ্বাস কেউকারাডং বা তাজিং ডং সম উচ্চে উঠে গিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য।
ওপেনিং অবস্থায় ১০ম চালের বোর্ড
আমি কাল নিয়ে খেলছিলাম দেখে বোর্ডটা উল্টো করে বসান। দু জনই সিরিয়াস তাই দেখেন কি অবস্থা ওপেনিংটাই হয়েছিল দারুণ ব্যতিক্রম। দু জনই কেসলিং করে যার যার ডিফেন্স পাকা পোক্ত করেছে। আমার তো ও’র কৌশল জানা ছিল তাই আমি খেয়াল রাখছিলাম ও যেন কোন ভাবেই এক পয়েন্টও আগে যেতে না পারে। আমি অনেকটা ডিফেন্সিভ মোডে খেলেছি আর ও এ্যাটাকিং মোডে। সি কলামে ও বোড়ে পঞ্চম রো পর্যন্ত নিয়ে গছে আমি বাধা দেই নাই। কারণ খেলা তো সবে শুরু। ও’র দুটো ঘোরাই সামনে বাড়ান, হাতি দুটাও কার্যকরী ভাবে সক্রিয় হয়ে গেছে। এদিকে আমার একটা হাতি আর ঘোড়া সামনে বাড়ান। ওপেনিং অবস্থায় দুজন পাকা পোক্ত ভাবে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। অবস্থাটা মুখোমুখি কেউ কার পিস বা পন এখনও হারায়নি।
এর পরই শুরু হবে সংঘর্ষ সেটাই মধ্য গেইম বা মিড গেইম আর এই মিড গেইমেই জয় পরাজয় প্রয় নিশ্চিত হয়ে যায় বেশির ভাগ খেলাতে। এন্ড গেইমে কম খেলাই যায় আর যেগুলো যায় সেগুলো দেখার মত হয়। নিচে ১৭ তম চালের বোর্ড আর তখনও মিড গেইম শেষ হয় নাই তবে আক্রমণ চলেছে। খেয়াল করলে দেখবেন আমি ই কলাম রো ৪ এ মানে ই৪ বোড়ে দিয়ে ও’র হাতিকে আক্রমণ করেছি আর ও ও’র ঘোড়া দিয়ে আমার কলাম-বি–রো-৬ এর হাতিকে আক্রমণ করেছে। মানে হলো আমি যদি বোড়ে দিয়ে ও’র হাতি খাই তবে ও ও’র ঘোড়া দিয়ে আমার হাতি খেয়ে দিবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমার মন্ত্রী আবার তার ঘোড়াকে খেতে পারবে আবার আমার ডি৭ এর ঘোড়াও ও’র ঘোড়াকে খেতে পারবে। তখন যদি বি১ এর নৌকা দিয়ে ও আমার ঘোড়া খেয়ে দেয় তবে মন্ত্রী দিয়ে আমি ওর নৌকা খেয়ে দিব আর তা হলে ওর ক্ষতি বেশি হবে।
মিড গেইম অবস্থায় ১৭ তম চালের বোর্ড
আমার কাল ঘরের হাতিকে ও নৌকা দিয়ে আর ঘোড়া দিয়ে আক্রমণ করেছে অথচ হাতিটাকে সাপোর্ট দিচ্ছি আমি ঘোড়া আর রানি দিয়ে বা যাকে বাংলায় মন্ত্রী বলে। ও যদি ঘোড়া দিয়ে আমার হাতি খায় আর আমি যদি মন্ত্রী দিয়ে ও’র ঘোড়া খাই তবে ও অনায়াসে ও’র নৌকা দিয়ে আমার মন্ত্রী খেয়ে ফেলবে। নৌকার পয়েন্ট হলো ৫ আর মন্ত্রীর হলো ৯ আমি ৪ পয়েন্ট পিছায়ে যাবে। যেখানে এক পয়েন্ট এদিক ওদিক হলেই জয় পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায় সেখানে এই রিস্ক নেয়াটা চরম বোকামি। তাই ঘোড়া দিয়ে আমিও হাতির সাপোর্ট বাড়িয়েছি যাতে যদি খাওয়া খাওয়ি হয় তবে সমান সমান ক্ষতি হবে দুজনের। দাবা খেলায় ঘোড়ার চাল গুলো সব থেকে মারাত্মক। একসাতে আট জায়গায় ছোবল মারে ঘোড়া। বসে থাকে এক জায়গায় কিন্তু এক দুই আড়াই ঘরে সে যেখানে সেখান থেকে চারদিকে আক্রমণ করে। তাই ঘোড়ার চাল গুলো বুঝা দাবা খেলায় গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।
এই বোর্ড থেকেই ও’র কৌশল ভেস্তে যায়। ও আমার বি৬ এ থাকা কাল ঘরের হাতিটা ঘোড়া দিয়ে খেয়ে দেয় আমিও ও’র ঘোড়াটা আমার ডি৭ এ থাকা ঘোড়া দিয়ে খাই। এর পর ও আমার বোড়ে দিয়ে আক্রান্ত ডি৩ এর হাতিটা দিয়ে আমার বোড়ে খেয়ে দেয় আর আমি বোড়ে দিয়ে ওর হাতিটা খাই, ও তখন মন্ত্রী দিয়ে আমার বোড়েটা খায় এতে করে আমি ১ পয়েন্ট আগায়ে যাই। তার পরের চালে আমি নৌকা দিয়ে ও’র এ৩ এর বড়েটা খাই ও আরো ১ পয়েন্ট আগায়ে যাই। ও ও’র কাল ঘরের হাতি দিয়ে আমার দুই নৌকাকেই আক্রমণ করে আর আমি আমার সাদা ঘরের হাতি এফ৫ এ নিয়ে গিয়ে ওর মন্ত্রীকে আক্রমণ করি। বিষয়টা পাল্টা পালটি। যদি আমার নৌকা খাও তো তোমার মন্ত্রী খেয়ে দিব অবস্থা। আর যদি মন্ত্রী সরাও তবে কোনাকোনি ঘরে ওর নৌকা খেয়ে দিব। মনে হলো হাতির চাল দিয়ে আমি ওকে অল্টারনেট অবস্থায় ফেলে দিয়েছি বা নৌকাটাকে পিন করেছি। এভাবেই নিচের ২১ তম চালের বোর্ড এর অবস্থার সৃষ্টি হয়। ওর হাতির চালটাকে আমি আমার ভাষায় বলতাম অল্টারনেট, একই সাথে উচ্চতর দুটি পিসকে আক্রমণ করা। হয় এটা দাও না হয় ওটা এমন অবস্থা। আর পিন করা মানে হলো কোন পিস বা পন সরালে বড় কোন পিসকে বাধ্যতামূলক হারাণর পরিস্থিতি। এই দুটো কৌশল আমি সেই সময় বুঝতে পারতাম। আমি দুই পয়েন্ট আগায়ে গেছি ঠিকই কিন্তু হাতি দিয়ে ও অল্টারনেট করায় হাতির ৩ আর নৌকার ৫ পয়েন্ট হওয়াতে ও আমার নৌকা খেয়ে দিলে ওর সেই হারান দুই পয়েন্ট ফেরত পাবে।
মিড গেইম অবস্থায় ২১ তম চালের বোর্ড
আমি হাতি দিয়ে মন্ত্রী আক্রমণ করায় অবস্থাটা এমন যে তাকে অবশ্য অবশ্যই মন্ত্রীকে সরাতে হবে না হলে আমি তিন পয়েন্টের হাতি দিয়ে ওর নয় পয়েন্টের মন্ত্রী খেয়ে দিব। আর যেহেতু বি১ এর ওর নৌকা পিন করা আছে মন্ত্রী সরালে আমি ওর নৌকা খেয়ে আর দুই পয়েন্ট আগায়ে যাব। ও যা করলো তা হলো মন্ত্রীটা ই৭ ঘরে নাময়ে নিয়ে আমার মন্ত্রীকে আক্রমণ করল পাশাপাশি হাতি দিয়ে যে আমার দুই নৌকাকে অল্টারনেট আক্রমণ করেছিল সেই রাস্তায় হাতির সাপোর্টে আমর দুই নৌকাকে আরো বিপদে ফেলে দিল। এখন ও যদি আমার মন্ত্রী খায় তবে নৌকা দিয়ে ওর মন্ত্রীকে খেতে হবে আর সেক্ষেত্রে আমার নৌকা ও হাতি দিয়ে খেয়ে দুই পয়েন্ট পুনরুদ্ধার করবে। আমি যদি ওর মন্ত্রী খাই তবে ও হাতি দিয়ে আমার মন্ত্রী খাবে আর তার পরও আমি আমার দুই নৌকার অল্টারনেট অবস্থাটা থেকে মুক্তি পাব না। আমি যা করলাম তা হলো আমার বি৬ এর ঘোড়াটা ডি৫ এ নিয়ে ওর মন্ত্রী আর হাতিকে অল্টারনেটে ফেলে দিলাম। এই চালটার কারণেই মনে হয় আমি পুরো খেলাটার নাম দিয়েছিলাম হর্স রেস। কারণ ঘোড়াটা ওই ঘরে দেয়ায় ও’র মন্ত্রী আর হাতি অল্টারনেটে পরে গেল। এই অবস্থায় ও কি করবে তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছিল।
ও বাধ্য হয়ে আমার মন্ত্রীকে খেয়ে দেয় আর আমি রাজার পাশের নৌকা দিয়ে ওর মন্ত্রীকে খাই। তার পর ও হাতি দিয়ে আমার এ৩ এ থাকা নৌকাকে খেয়ে দুই পয়েন্ট পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু এফ৫ থাকা আমার সাদা ঘরের হাতি দিয়ে আমি ওর বি১ ঘরের নৌকা খেয়ে দিয়ে আবারও দুই পয়েন্ট আগায়ে যাই। ও রাজার পাশের নৌকা দিয়ে আমার হাতি খেলেও হাতির পয়েন্ট ৩ আর নৌকার পয়েন্ট ৫ তাই আমি দুই পয়েন্ট আবারও আগায়ে গেলাম। এর কয়েক চাল পর থেকেই আমার দুই ঘোরার দারুণ সব চাল শুরু হয়। যেমন ২৯ তম বোর্ড এর অবস্থাটা নিম্নরূপ।
য়েন্ড গেইম অবস্থায় ২৯ তম চালের বোর্ড
য়েন্ড গেইম বা শেষ খেলায় দুটো হাতি কিংবা দুটো ঘোরা অনেক শক্তিশালী তবে ব্যবহার করাটা জানতে হবে। এই খেলায় আমার দুই ঘোড়ার চাল গুলো ছিল দুর্দান্ত। ৩০ তম চালে আমি সি৩ এ থাকা আমার ঘোড়াটা ডি১ এ নিয়ে একদিকে ওর নৌকা আর আরেক দিকে এফ২ তে থাকা বড়ে কে অল্টারনেট করি। এফ২র বোড়ে টা আমার আরেক ঘোড়া যা ই৪ এ আছে তা দিয়ে আক্রমণ করা আছে। ও নৌকাটা কে সি২ তে নিয়ে এসে আমার সি৬ এর বড়ে কে আক্রমণ করে আর আমি ওর এফ২ বড়ে খেয়ে দেই, যদিও তা ও নৌকা দিয়ে খেয়ে দিতে পারে সেক্ষেত্রে আমার আরেক ঘোড়া ওর নৌকাকে খেয়ে দিবে। এভাবে আমি আরো ১ পয়েন্ট আগায়ে গেলাম। ও নৌকা দিয়ে আমার সি৬ এর বড়ে খেয়ে ফেলে আর আমি আমার নৌকা এ১ ঘরে নিয়ে যাই উদ্দেশ্য এর পরের চালে বাজি মাত করা। কারণ এফ২ তে থাকা আমার ঘোড়া আর ই৪ এ থাকা ঘোড়া বিপক্ষ রাজার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে আর আমি যদি আমার নৌকাটা এইচ৮ ঘরে নিয়ে চেক দিতে পারি তবে চেক মেট বা বাজি মাত হয়ে যাবে ও আমি জিতে যাব। মানে হলো মাত্র একটা চাল বাকি। এই অবস্থায় ও ওর নৌকা দিয়ে আমার রাজকে চেক দেয়। আমি রাজা উঠায়ে নিয়ে যাই জি৭ ঘরে। ও ওর হাতি এফ৮ ঘরে এনে চেক দেয় আবার। আমি রাজা সরায়ে নেই এফ৬ ঘরে। ও নৌকা সি৬ ঘরে নিয়ে আমার রাজাকে চেক দেয়। আমি এফ৫ ঘরে নিয়ে যাই আমার রাজাকে। ও ওর ঘোড়া এইচ৪ ঘরে এনে আমার রাজাকে চেক দেয়। আমি রাজাকে জি৫ ঘরে নিয়ে যেয়ে ওর ঘোড়াকে আক্রমণ করি। এই ৩৬ তম বোর্ডটি অত্যন্ত ট্রিকি। একটা চাল এদিক ওদিক হলে হয় আমি জিতব না হয় ও।
এই অবস্থায় আমার মাত্র একটা চাল দরকার, নৌকাটা এইচ৮ এ নিতে পারলেই ও হেরে যাবে। কিন্তু এদিকে ও ঘোড়াটা এফ৩তে নিয়ে চেক দেয় আর আমি বাধ্য হই রাজাকে এইচ৫ এ নিতে। এর পর ও যদি নৌকাটা সি৫ এ নিয়ে চেক দিতে পারে তবে ও আমাকে চেক মেট করে বাজি মাত করে দিবে কিন্তু ওই যে আমর ঘোড়া আছে ই৪ এ, ও যদি ওর নৌকা সি৫ এ দেয় তবে আমি আমার ই৪ এর ঘোড়া দিয়ে ওর নৌকা খেয়ে দিব। এই ঘোড়াটার কারণেই আমি জিতে যাই।ও ক্রমাগত চেক দিয়ে আমাকে চেকমেট করতে না পারলে ও হেরে যাবে। একটা চাল চেক ছাড়া দিলেই আমি নৌকা এইচ৮ এ নিয়ে বাজি মাত বা চেক মেট করে জিতে যাব। এই অবস্থায় ও হার স্বীকার করে নেয়। বাকি চাল গুলো অনুমান করে নেয়া যায় যে, ওর হার নিশ্চিত ছিল কারণ দু এক চাল পরই আমি ফাকা একটা চাল পেতাম আর ওর রাজাকে নৌকা দিয়ে ঘায়েল করে দিতে পারতাম।
৩৩ বছর পর দাবা খেলাটা পুনরায় খেলতে পেরে আমি যার পর নাই আনন্দিত। সেই ১৬ মে ১৯৯০ থেকে আমার আত্মবিশ্বাস যে বেড়েছে তার পর আর কমে নাই। এই ৩৩ বছর দাবা খেলাও তেমন একটা হয় নাই। ইদানীং দাবা খেলার কথা খুব একটা শুনা যায় না। আগে পত্র পত্রিকায় গ্র্যান্ড মাস্টার গ্যারি কেসপারভ আর কারপভের খেলা ফলাও করে প্রচার করা হতো। এখন তাদের নাম ডাক আর শুনি না। ভাবতাম ইদানীং হয়তো মানুষ দাবা খেলা তেমন একটা খেলে না। ভাল করে ইন্টারনেটে খোজ নিয়ে দেখলাম, ওরেব্বাবা, ইদানীং দাবা খেলার গতিও বেড়েছে আর অনলাইনে হরদম দাবা খেলা চলছে। কম্পিউটারে দুটা দাবার এ্যাপও ডাউন লোড করলাম। মাঝে মাঝে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাথে দাবা খেলা যাবে এই উদ্দেশ্যে। খেলছিও ইদানীং তবে এআই এর সাথে পারি না, খালি হেরে যাই তবে খেলা গুলো পরে আবার খেলে দেখি কোথায় ভুল করলাম। হয়তো একদিন এআইকেও হারায়ে দিবে সেই আত্মবিশ্বাস এখনও আছে । আগে দাবা খেলা ছিল ধীর স্থির মনোনিবেশ করে খেলা আর ইদানীং দেখি সবাই হুট হাট চাল দিচ্ছে, একটা চাল দেয়ার পর অপর জন কত দ্রুত চাল দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা যেন। দাবা খেলার ধরণ ধারণই পাল্টে গেছে এখন। সময়ের সাথে সবই বদলায়, আমাদেরকেও তাই বদলাতে হবে।
১৬মে১৯৯০> ২০এপ্রিল২০২৩> ২৫ জুন২০২৩> ২৮ জুন ২০২৩>