আমরা যখন নিয়ম কানুনের কথা বলি তখন কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে আমি এখানে রাজনীতি কিংবা আইন শাস্ত্র নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। রাজনীতি কিংবা আইন এই আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। আমি বরং আমার একটি চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা শেয়ার করব, যা আমাকে ২০০০ সালে চাকুরী জীবনের শুরুতে একটি অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছিল। যদিও একটি ছোট অভিজ্ঞতা কিন্তু এটি একটি বড় প্রভাব তৈরি করেছিল আমার মনে এবং আমার চিন্তাভাবনাকে এর পরবর্তী স্তরে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা সবাই জানি শেখার শেষ নেই, মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় বিখ্যাত লেখক ও চলচিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় বলে গেছেন, ”মুহূর্তটি একটা চরম ক্লাইম্যাক্স”। আমার পেশাদার জীবনের গুরু, দেভজিৎ সরকার তার কম্পিউটার প্রিন্ট আউট কার্ড এ লিখে দিতেন "প্রতিটি দিন যেন নতুন কিছু শেখার অভিজ্ঞতা হয়ে উঠে"। আমার স্পষ্ট মনে আছে তার কথা আর আমি এখানে যে ঘটনাটি বলতে যাচ্ছি তা সেই শিক্ষা গুরুর সংস্পর্শের সাথে সম্পর্কিত।
চাকুরী জীবনের শুরুর দিকে, ভারতীয় দেভজিৎ সরকার মহোদয় আমার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন, শুধু তিনি নন তৎকালের এনআইআইটি’র (ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি বা NIIT) ভারতীয় আরও দুই জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তথা, তাপস রয় ওরফে ট্রয় (কান্ট্রি ডিরেক্টর), ইন্দ্রনীল মুখার্জি ওরফে আই-এম সকলকেই আমার চমৎকার ইংরেজিতে সাবলীল কথা বলা দ্বারা সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলাম। তবে দেভজিৎ সরকার মনে হয় আমার গাণিতিক দক্ষতার প্রতি অধিক সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যেহেতু লিখিত পরীক্ষায় আমি কেবল গাণিতিক অংশটাই সফলতার সাথে উত্তর প্রদান করেছিলাম। তিনি আমার সংষ্কৃতিক দিকটাও যাচাই করে নেন যেমন আমি কি ধরনের বই পড়তে ভালবাসি, কি ধরনের গান শুনতে পছন্দ করি ইত্যাদি। তাই দেশীয় কিছু নেতৃস্থানীয় লোক অনিচ্ছুক থাকা সত্যেও দেভজিৎ সরকার আমাকে ঢাকা’র মিরপুর সেন্টারে ট্রেনিং দিয়ে নিয়ে গেছে সিলেট এনআইআইটি-তে যেখানে আমি কম্পিউটার প্রশিক্ষক বা ফ্যাকাল্টি হিসেবে সফলতার সাথে কাজ করেছি দীর্ঘ এক বছর, মানে পুর ২০০০ সালটা। সে যাই হোক আমার ভাগ্যই বলতে হবে যে একটা ভেকান্সি তৈরি হয়েছিল সিলেট সেন্টারে আর আমি সেই শূন্যস্থানটা যথাযথভাবে পূরণ করার উপযোগীও ছিলাম ওই সময়টাতে। এখন থেকে পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় যেন আমার জন্যই তৈরি হয়েছিল ওই শূন্যস্থানটি। ঢাকা থেকে ভিন্ন এক শহরে নতুন এক চাকুরীতে দুজন বন্ধু/সহকর্মীর সক্রিয় সমর্থন কখনই ভোলা যায় না, তারা আর কেউ নন মার্কেটিং এর সাহেদ আহমেদ আর ওনিসিমাস চৌধুরী। গল্পটা সাহেদ ভাই বা অনিকে নিয়েও নয়। সিলেট এনআইআইটিতে আমার সময়টা আমার পরিবারের কাছে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল এটা প্রমাণ করা যে আমি পরিবারের কোন সমর্থন বা সাহায্য ছাড়াই একা থাকতে পারি, সেই দিক থেকে আমি নিজেকে সফল প্রমাণ করেছি। সিলেটে থাকাটা কতটা উপভোগ করেছি তা এখনো মনে আছে। ওখানকার দারুণ আবহাওয়া, ভাল মনের মানুষজন, রাস্তার রিকশা জ্যাম সবই উপভোগ্য ছিল। আর ছিলেন উদার হৃদয় সাহেদ ভাই, তার সহৃদয় উপস্থিতি এবং ব্যস্ত ক্যারিসম্যাটিক ব্যক্তিত্ব এখনও আমার মনে একটি অনন্য উদাহরণ। বর্তমানে সাহেদ ভাই অস্ট্রেলিয়ার মেলবর্ণে সপরিবারে বসবাস করছেন।
NIIT-তে চাকরি কালীন সময়ে আমি কয়েকটি ছোটখাটো সাংগঠনিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম, আমি তাদের প্রত্যেকটি উপভোগ করেছি, এরকম একটি ছিল সিলেটে প্রথম সফ্টওয়্যার এক্সপো। সেখানে একজন ভারতীয় তরুণ পাল সাহেব এসেছিলেন যিনি কেডিএস কোম্পানির অর্থায়নে পরিচালিত মাদার কনসার্ন চিটাগাং-এনআইআইটি-র ইভেন্ট ম্যানেজার হিসাবে এক্সপোর ব্যবস্থাপনা তদারকি করতে এসেছিলেন, তাঁর সাথে দুজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞও এসেছিলেন। সিলেটে প্রথম একটি উন্নত মানের সফ্টওয়্যার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল এবং তারা সেখানে সক্রিয় সহায়তা কর্মী হিসেবে এসেছিলেন। আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম, তারা সিলেট কেন্দ্রটির তত্ত্বাবধান করতে এবং কেন্দ্রের সামগ্রিক অবস্থা দেভজিৎ সরকারকে রিপোর্ট করার জন্য সেখানে ছিল। তরুণ ভারতীয় পাল, যিনি অত্যন্ত ক্যারিসম্যাটিক ছিলেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষও ছিলেন। আমাদের অনেক ভুল দেখিয়েছিলেন এবং বিকল্প পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরকম একটি উদাহরণে তিনি আচমকা একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যা আমাকে চমকে দেয় এমন একটি বিষয় উপলব্ধি করতে যা আমি কখনই ভুলব না। এটা নয় যে আমি তাকে অত্যন্ত দক্ষ কর্মী হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম। এটি হল, তার অডিট পরিচালনা করার পদ্ধতি এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা যা আমাকে দেখিয়েছে যে সময়মতো পরিস্থিতির সাপেক্ষে আমাদের নির্দিষ্ট মেজাজে কাজ করতে হয়। অন্য কার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কেন তিনি তখন এত চিৎকার করে কথা বলছিলেন তা আমি ভুলে গেছি কিন্তু আমার মনে আছে শুধুমাত্র সেই অংশটি যা আমার চিন্তায় আঘাত করেছিল, "আপনি কি জানেন যে পৃথিবীতে মাত্র দুটি নিয়ম আছে?" আমি কিছুই না বুঝে জিজ্ঞেস করলাম সেগুলো কি, সে বলল প্রথম নিয়মটা হল “আমাকে অনুসরণ করুন” (Follow me) , আমি সেই অংশটা বুঝলাম, এখন দ্বিতীয় নিয়মটা কি, আমি উত্তর শোনার অপেক্ষায় ছিলাম, কিন্তু সে একটু বিরতি দিল এবং কোন কথা না বলায় তাকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম দ্বিতীয় নিয়ম কি? …….. উত্তর নেই!! তিনি বিরতিতে ছিলেন, কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন "প্রথম নিয়মটি অনুসরণ করুন" (Follow the first rule) !! আমি হতবাক!! ভাল বলেছেন তো, হ্যাঁ, তৃতীয় কোন নিয়ম কখনো হবে না, কারণ মূলত একটাই নিয়ম আছে যেটা হল আমাকে অনুসরণ করুন এবং কেবল আমাকেই অনুসরণ করুন।
এ যেন সফল নেতার গভীর মনের এক গুপ্ত রহস্য। এটা মানব মনের নেতৃত্বের অহংবোধ, তাদের মূল মনের সত্ত্বাধিকারী। আমি দেখেছি যে অনেক লোক তাদের আবেগকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, " দেখ আমি এটি তৈরি করেছি" বা দেখ আমার জীবনে আমি কি কি অর্জন করেছি কিংবা দেখ আমার সন্তানেরা কত বড় বড় জায়গায় পৌঁছে গেছে যেন অন্যরা তাতে অবাক হয়ে যাবে এবং তাকে বাহবা দিবে। তারা এটা ভেবে দেখে না যে, তার কৃতিত্ব সমূহ অন্য অনেকের সাথে একই রকম হতে পারে এবং অন্যদের গুলিও বিস্ময়কর এবং সমানভাবে উল্লেখযোগ্য বটে। আর তা না হলে এই কথাগুলো যাকে বা যাদের উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে তাদের মনে হিংসাত্মক অনুভূতির জন্ম দেয়া ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।
নিজের অর্জনগুলোকে গভীর ভাবাবেগের সাথে প্রকাশ করার প্রবল প্রবণতা রয়েছে মানুষের। সে অন্যদের কাছ থেকে প্রশংসা প্রার্থনা করে যেন এটি প্রমাণ করতে চায় এই জড় জগতে এই কাজগুলোই তার করার কথা ছিল। আমি অনেক লোককে পেয়েছি যারা আবেগ ছাড়া তাদের কৃতিত্ব প্রকাশকে সারসংক্ষেপ করতে পারে না। বিপুল আবেগের সাথে তারা আপ্লুত হয়ে যায় এবং এর পিছনের সত্য দেখতে ব্যর্থ হয়। এমন কিছু লোক আছে যারা আবেগকে ব্যবহার করে একটি চূড়ান্ত রায়ে পৌঁছানোর জন্য, অথচ তাদের রায় অন্য আবেগের সাগরে হাবুডুবু খায় এবং কখনই উপযোগের কেন্দ্রে স্থির হয় না। আমি এটি তৈরি করেছি, আমি এটি করতে পারি, আমিই একমাত্র নইলে এটি কখনই সমাধান হত না, দেখুন আমি কতটা দুর্দান্ত হতে পারি, এবং আমিই অনন্য। আপনি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে সেরা হিসাবে পাবেন না। এগুলো তাদের প্রাণশক্তির সাধারণ বহিঃপ্রকাশ। তাই যে নিয়মটি বলে যে আমাকে অনুসরণ করুন এবং কেবল আমাকেই অনুসরণ করুন তা কিছু পরিমাণে আদিম এবং আমাদের প্রকৃতিতে অন্তর্নির্মিত। ছোটবেলায় আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, এক ভাই ও তার ছোট বোন। ভাইটি খুব চঞ্চল ছিল এবং সে আমার উপর আধিপত্য করত। যেমন আমার কাছে একটি লোগোর খেলনা ছিল এবং সে আমাকে ওটা দিয়ে না খেলতে শাসন করত, এমনকি আমি যদি তার কথায় রাজি হতাম, তখনও সে নিশ্চিত করত আমি এটি ফেলে দিয়েছি কিনা। ঠিক এই জায়গায় আমি নিয়মটির সাথে দ্বিমত পোষণ করি, যখন এটা অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তারের গভীর দাবীতে পরিণত হয়, তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় বা তাকে এমন কিছুতে ঠেলে দেওয়া হয় যা করতে সে রাজি নয়। এটি নিপীড়নের প্রকৃতি এবং অবশ্যই আত্মার প্রতি অত্যাচার।
এটা স্বাভাবিক যে একটি মন সর্বোপরি সর্বোত্তম হওয়ার চেষ্টা করবে এবং প্রশংসার জন্য জিজ্ঞাসা করবে (আমাকে অনুসরণ করুন এবং কেবল আমাকেই অনুসরণ করুন) তবে একটি সংস্কৃতিমনা মন, তার প্রজ্ঞা সহ একটি লালিত মন জানবে, আমি যতই ভাল হতে পারি না কেন অন্য একজন আরো বড় হতেই পারে এবং এটা ভাবা অনেক বেশি উপযুক্ত যে আমরা সবার সেরা এবং আমরা আমাদের মধ্যে অনন্য শ্রেষ্ঠত্ব ভাগ করে নেই। পৃথিবীতে কি তবে সবসময় মাত্র দুটি নিয়মই থাকবে আর তৃতীয় কোন নিয়ম কি তবে কখনোই আসবে না?
Edit and update history: 10dec2018 Translated into Bangali on 23mar23> 31mar23
No comments:
Post a Comment