আমার ছোটবেলার তিন টা বছর কাটে লিবিয়ার ইজিপশিয়ান বর্ডারে অবস্থিত পোর্ট সিটি তবরুক শহরে। ওখানে আমার বাবা পাওয়ার প্ল্যান্টে চাকরি করতেন। মা চাকরি নিয়েছিলেন তবরুকের একটা কলেজ “হাইয়ার পেট্রলিয়াম ইনিস্টিটিউট” এর লাইব্রেরিতে। সেই সুবাদে আমার পড়া লেখার শুরু ওই কলেজের স্টাফদের জন্য নির্মিত একটা অত্যন্ত সুন্দর কিন্তু ছোট তবে অক্সফোর্ড স্ট্যান্ডার্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে ছিল বাঙ্গালী, পাকিস্তানী, ইন্ডিয়ান, বুলগেরিয়ান, চাইনিজ আর তুরস্কের বাচ্চা সকল। বই পত্র সব আসত লন্ডন থেকে। অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট মিস শর্মা ছিলেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। দু জন বাঙ্গালীও ছিলেন শিক্ষিকাদের মধ্যে। অনেক ছোট বেলা থেকেই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমার অতীব আগ্রহ ছিল। সেই যখন ক্লাস দুই বা তিনে সোলার সিস্টেম নিয়ে ছবি আঁকতাম। ছাত্র জীবনে কলেজে পড়ার সময় বাংলাদেশ এস্ট্রোনোমিকাল এসোসিয়েশনেও যোগ দিয়েছিলাম। আজকাল দৈনিক পর্যবেক্ষণ পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে, এই পর্যবেক্ষণের রেফটি যে একটা টেলিস্কোপ তা অনেকেই বোধ হয় খেয়াল করেননি। এটা সেই ”বিএএ” বা বাংলাদেশ এস্ট্রোনোমিকাল এসোসিয়েশনের তৎকালের পাক্ষিক প্রকাশিত পত্রিকা ছিল। আমি ওই পত্রিকাতেও মহাবিশ্ব সম্পর্কিত সংবাদ সংক্ষেপের একটা কলাম সম্পাদনা করতাম। তাই যখন একুশে বই মেলায় বারট্রান্ড রাসেলের বাংলা একাডেমীর অনুবাদ কৃত বই “বহির্জগত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান” বইটা কিনেছিলাম ভেবেছিলাম যে তা মহাবিশ্ব সম্পর্কে লেখা। ওটা পড়তে গিয়ে দেখি তা মোটেও মহাবিশ্ব সম্পর্কিত নয় বরং আমাদের চির চেনা এই বাস্তব বিশ্ব নিয়ে লেখা। মানে হলো এই বাস্তবতা যা আমারা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করি তা নিয়ে লেখা। তখন বুঝতে পারলাম মহাবিশ্ব নয় বরং এই বাস্তব বিশ্বটাই অনেক রহস্যময় যা আমরা দেখি তা অত্যন্ত বিস্ময়করও বটে। আমাদের মস্তিষ্কের বাইরের এই বিশ্বজগত সম্পর্কে আমরা কত অল্পই না জানি। এই বইটা থেকেই বারট্রান্ড রাসেলের রচনা সমূহ পড়ার প্রতি আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পায় পাশাপাশি এই বাস্তবতার দিকে আমার মনোযোগ নিবিষ্ট হয়।
আমি মনে করি মানব জাতি এবং এর বুদ্ধিমত্তা এখন পর্যন্ত বহু কিছুই আবিষ্কার করেছে ঠিকই কিন্তু প্রাথমিক বা মৌলিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি এড়িয়ে গেছে। হতে পারে আমি ভুল বলছি বা হয়তে পারে সঠিক, আমার অনুমানটি সঠিক প্রমাণিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে আমার আলোচনা বিষয়টি স্পষ্ট করবে। বাস্তবতার একটি আন্তলীন গুণ হল, এটি সর্বদা সতেজ এবং কখনো পিছনে ফিরে তাকায় না “Reality is ever fresh and never looks back”। এই বিষয়টি কয়েক বছর আগে আমার মনে এসেছিল, সহজ ভাবে এটি যা বলে তা সবারই জানা। বাস্তবতার কখনও একরূপ পুনরাবৃত্তি হয় না যেমন প্রতিটি সকাল আগের সকালের মতোই সতেজ হলেও তা অনন্য হয়ে থাকে। এটি এমন একটি শর্ত যা বলে সকালকে অবক্ষয়ের মতো পরিমাপ করা যায় না। ঠিক আছে সহজ করে বলা যেতে পারে যে আমরা সময়কে পিছিয়ে রাখতে পারি না, তাই বাস্তবতাকে সময়ের উপর প্রক্ষেপ বা প্রজেক্ট করা হলে এটি সর্বদা কোন না কোন ভাবে এগিয়ে যাবেই। এখন যখন আমরা সময় নিয়ে কথা বলি, তখন তার নিজেরই স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। যখন আমরা বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করছি, আমাদেরও বুঝতে হবে যে সময় আমাদের কাছে ঠিক কি বোঝায়। সময়কে বিশ্লেষণ করার আগে, বাস্তবতার আরও কি কি বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী রয়েছে তা দেখা যাক।
বাস্তবতার আরেকটি বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হল এর অনিশ্চয়তার নীতি। আমরা খুঁজে পেয়েছি যে বাস্তবতা তার সমস্ত ঘটনা প্রবাহের সাথে সম্পূর্ণ সতেজতার সাথে এগিয়ে চলেছে এবং এটি কখনই তার পরবর্তী মুহূর্তটি কারও কাছে প্রকাশ করে না। এই বৈশিষ্ট্যটি বাস্তবতাকে আরও বেশি মোহনীয় করে তোলে, যদি এটি না থাকতো এবং সবকিছু নিশ্চিত করে দিত, তাহলে আপনি এমন কিছু পেয়ে অবাক বা আনন্দ কোথায় পেতেন? অনিশ্চয়তা ছাড়া বাস্তবতা হবে একটি মোহনীয় ইতিহাস বইয়ের মতো, যেটি আপনি বহুবার পড়েছেন এবং আবার পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে বাস্তবতা সুন্দর এবং আশ্চর্যজনক ভাবে বৈচিত্র্যময়। আর এ থেকেই আনন্দ-বেদনার উৎপত্তি। আনন্দের প্রকৃতিটি তবে কি? আমার উপলব্ধি অনুযায়ী আনন্দ একটি অনিশ্চিত কিন্তু সম্ভাব্যতা থেকে তার পছন্দসই ফলাফলে পৌঁছানোর জন্য উৎপন্ন হয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর সাথে সাথেই আনন্দের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। আপনি যদি ফলাফল সম্পর্কে আগে থেকেই নিশ্চিত হতেন, আমি মনে করি আনন্দের দরজা বন্ধ হয়ে যেত। ফুটবল খেলায় গোল হওয়ার বহু সম্ভাবনার মৃত্যুর পর যখন হঠাৎ সম্ভাব্যতাটা বাস্তবে পরিণত হয়, মানে গোল হয়ে যায় তখন মানুষের মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে। এটা ক্ষণিক আনন্দ মনের প্রগাড় প্রশান্তি নয়। শান্ত বাস্তবতায় মনে প্রশান্তি আসে আর বিশ্রিঙ্খল ঝড় ঝাপটা ময় অস্থির বাস্তবতায় মন বিচলিত হয় তা সবারই জানা। অতীতের ভুলের জন্য আক্ষেপ আর ভবিষ্যতের অনিশ্চিত আশংকায় মানুষের মনের শান্তি নষ্ট হয়। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাই কেবল আনন্দর উৎস নয় তা মনে দুশ্চিন্তারও জন্ম দেয়।
সময় বাস্তবতাকে বিস্ময়কর ভাবে উন্মোচন করে। এখন পর্যন্ত আমাদের আলোচনায় দুটি বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান, এবং আমরা হয়তো উপসংহারে পৌঁছেছি যে দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি না থাকলে বাস্তবতা এতটা বিস্ময়কর হতো না। এখন দেখা যাক বাস্তবতা আমাদের মনে কিভাবে অনুভূত হয়। আমাদের মন অন্য কথায় আমরা শুধুমাত্র যদি আমরা কিছু সময়ের জন্য আত্মার ধারণা সরায়ে রাখি। মনে করা যাক, আমাদের মনের পদার্থ আমরা নিজেরাই। আমাদের মন স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারে এবং একটি নির্দিষ্ট স্তরে ভবিষ্যতের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে তবে এটি সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারে না। আগে বলা এই অনিশ্চয়তা আনন্দের সুযোগ বজায় রাখে, অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে, সুযোগ উন্মুক্ত করে, এমনকি সেটা নেতিবাচক বা ইতিবাচক হলেও। দুঃখ, বেদনা, ব্যর্থতা, আনন্দ, কৃতিত্ব এবং এই সমস্ত শব্দের কোন মূল্য থাকবে না যদি সবকিছু সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হয়ে যেত। তাই এই অপ্রত্যাশিত সময়ের টানেলের উপস্থিতি এত বেশি প্রয়োজনীয়। এটি বাস্তবতা প্রকাশ করে এবং আমরা এতে বাস করি বা এর মধ্যে দিয়ে যাত্রা করি। বাস্তবতার ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে বোঝা যাবে না যদি আমরা বুঝতে না পারি যে সময় কীভাবে বাস্তবতাকে প্রকাশ করে; ধারণা সময় তাই বাস্তবতার ধারণা থেকে উচ্চতর।
বাস্তবতা বুঝা আসলেই কঠিন, আমি মনে করি সমস্ত বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্টিফেন হকিং এমন একজন ব্যক্তি যিনি তার স্তরের সর্বোত্তম চেষ্টা করেছিলেন বাস্তবতা বুঝতে। এমনকি তিনিও অবশেষে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেননি। তিনি তার বই "ব্ল্যাক হোল" য়ে যা লিখেছেন এবং আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হল, আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন যে সবকিছু পূর্বনির্ধারিত কিনা, আমার উত্তর হ্যাঁ কিন্তু আমি বলছি প্রশ্নের উত্তর না হওয়াও সম্ভব। যে ব্যক্তি বাস্তবতাকে গাণিতিকভাবে বোঝে, সে শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্তিতেই রয়ে গেছেন এবং সেটাই যদি হয় তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কীভাবে সঠিক উপলব্ধি নিয়ে আসতে পারে? আমি এর বৈশিষ্ট্যগুলি পর্যবেক্ষণ করে বাস্তবতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি, একটি বা দুটি পেয়েছি, আরেকটি যা আমি মিস করেছি তা হলো "ব্যালেন্স" বা ভারসাম্য । এখন পর্যন্ত যা পাওয়া গেল তা হলো বাস্তবতা সর্বদা সতেজ ও কখনো পিছন ফিরে তাকায় না। বাস্তবতা পুনরাবৃত্ত কিন্তু সর্বদা অনিশ্চিত। বাস্তবতায় ঘটমান সবকিছুর পূর্ব নির্ধারিত হওয়াটা আধাআধি সত্য হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। বাস্তবতা সর্বদা ভারসাম্যে পৌছাতে চায় ও এক সময় তা ভারসাম্য অবস্থায় স্থিত হয়। ভারসাম্যে পৌঁছানো বাস্তবতা মানুষের মনে প্রশান্তির জন্ম দেয়।
বাস্তবতা আমাদের ধোঁকা দেয় যা মহা একটা ধাঁধাঁ, আকাশ ঘন নীল কিন্তু বাস্তবে তা মোটেও না বরং ঘন কাল অন্ধকার। আমরা মনে করি স্থির ভূমিতে দাড়িয়ে আছি অথচ আমরা পৃথিবীর সাথে প্রতি সেকেন্ডে ১৮ কিলোমিটার বেগে ঘুরছি। যদিও মনে হয় সবকিছু স্থির কিন্তু বাস্তবে বাস্তবতা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, কোন কিছুই স্থির নাই সর্বত্রই পরিবর্তন হয়েই চলেছে। খালি চোখে আলোকে সাদা মনে হয় অথচ এর অভ্যন্তরে ৭টি রং মিলে মিশে আছে। আয়নায় প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব আমাদের চেহারার পেরটি সিফ্ট। কিট পতঙ্গদের দিকে ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যায় ওরা কিভাবে তাদের ভক্ষকদের ধোঁকা দেয়। বাস্তবতার এই ধোঁকা এত গভীর যে পৃথিবী সমতল না গোলক তা বুঝতেই মানুষের বহু বছর লেগেছে, তার চেয়েও বেশি সময় লেগেছে বুঝতে যে প্রকাণ্ড সূর্যটি একটি মধ্যম শ্রেণীর সাধারণ তারা মাত্র। বাস্তবতার ধাঁধাঁ গুলো খুব ধীরে ধীরে মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়েছে। প্রতিটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের সাথে সাথে মানুষের বিশ্ব বীক্ষণ তাই বদলে গেছে। পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্ব সেই টলেমীর আমলে এসে সূর্য কেন্দ্রিক হলো তার বহু বছর পর এই সূর্য সহস্র কোটি গ্যালাক্সির মধ্যে সাধারণ একটি গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়ের অতি সাধারণ একটি তারকা মাত্র তা প্রমাণ হয়েছে। এরও বহু বছর পর এই গ্যালাক্সিগুলো যে পরস্পর থেকে দুরে সরে যাচ্ছে তা’র প্রমাণ পাওয়া গেল। বেকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন থেকে প্রমাণ পাওয়া গেল এই মহাবিশ্বর একটা শুরু ছিল যাকে বিগ ব্যাং বলা হয়। যা আগে ছিল হাইপোথিসিস তার সত্যতার পক্ষে মানুষ যুক্তি প্রমাণ পেল। বস্তুর ক্ষুদ্রতম একক অণু থেকে পরমাণু পার হয়ে বহু ধরনের কণিকা ও তা সৃষ্টিকারী কোয়ার্ক পর্যন্ত মানুষের জ্ঞান প্রসারিত হয়েছে। বাস্তবতার ব্যাখ্যায় স্ট্রিং থিউরি সত্যতার পক্ষেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
অবারিত শক্তির উৎস এই বাস্তবতার খুব সামান্যই আমরা ব্যবহার করতে শিখেছি। সময় আসছে যখন আরো বেশী মাত্রায় এই অবারিত শক্তি ব্যবহারের উপায় আমরা শিখে যাব যা আমাদের বাস্তবতাকে ভিন্ন আঙ্গিকে চিনতে শিখাবে। গত কয়েক দশকে এই প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার করে কত নিত্য নতুন পরিবর্তন এসেছে আমাদের জীবনে আরো বহু পরিবর্তন ক্রমাগত যেন আসতেই থাকবে। যারা এর সাথে তাল মিলায়ে চলতে পারবে তারা আগায়ে যাবে আর বাকিরা পিছনে পরে থাকবে। বাস্তবতা আদি অন্তহীন যা সাধারণ পর্যবেক্ষণে মনে হয় কিন্তু এর প্রতিটি উপাদানেরই শুরু আর শেষ আছে। সীমা হীন বলে মনে হলেও সকল কিছুর সীমানা আছে। শুরু আছে আর শেষ বলেও একটা কিছু আছে। হকিং মহাশয় প্রমাণ করে গেছেন এই মহাবিশ্বর সীমানা আছে কিন্তু কিনারা নাই। যেমন পৃথিবীটা সীমাবদ্ধ কিন্তু আপনি যেদিকেই যান না কেন পরে যাবেন না। এই সীমাবদ্ধতার বৈশিষ্ট্য তাকে ক্রমাগত পরনির্ভরশীলতার দিকে নিয়ে যায়। বাস্তবতার প্রতিটি উপাদান সীমাবদ্ধ ও অপর কিছু না কিছুর উপর নির্ভর করে টিকে আছে। আমরা যে খাবার খাই তা আসে গাছপালা আর পশুপাখি থেকে কিন্তু এরা সেই খাবার তৈরি করে সূর্য থেকে বা সূর্য রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে। এই সূর্যও স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়, এরও জীবন মৃত্যু রয়েছে। এটিও মহাবিশ্বর মিল্কিওয়ে নামক গ্যালাক্সির একটি মাঝারি ধরনের তারা মাত্র। এই লক্ষ কোটি গ্যালাক্সির মহাবিশ্বটা কার উপর নির্ভর করে আছে তা মানব জ্ঞানে আজও আসে নাই তবে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। তাই মনে হয় বাস্তবতা যেন বদ্ধ এক একুরিয়ামের মত যত বস্তুর গভীরে যাওয়া যায় সেখানেও সীমাবদ্ধ যত বাহিরে যাওয়া যায় তাতেও সীমাবদ্ধতা।
বাস্তবতা একটা মায়া নাকি বাস্তবে অস্তিত্বশীল তা নিয়েও মত পার্থক্য আছে। অনেক আউলা বাউল বা বৈরাগী হয়ে গেছে বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে ভাবতে। প্রাচীন অধিবিদ্যা মতে এই বাস্তবতার পুরটাই মায়া, প্রকৃত বাস্তবতা কি তা ব্যাখ্যা না করেই একে মায়া হিসেবে ধরে নিয়ে অনেক কবি সাহিত্যিক বহু কিছু রচনা করে গেছেন। ভাববাদ পরবর্তী বস্তুবাদের জমানায় এসে এখন মানুষ বাস্তবতাকে বস্তুনিষ্ঠ ভাবতে শিখেছে। বাস্তবতা পর্যাবৃত্ত, বার বার ফিরে আসে তবে নতুন মাত্রায়, এ যেন চক্রাকারে উপরে বা নিচের কোন এক দিকে যাত্রার মত। এক মাত্র মানুষই বুঝতে পারে এই রিকারিং বাস্তবতার বিরক্তিকর একঘেয়েমি। কেননা কেবলমাত্র মানুষেরই রয়েছে একঘেয়েমি জনিত বিরক্তি বোধের সামর্থ্য। মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীর মনে হয় না এত বিচিত্র মনোভাবের প্রবণতা রয়েছে। তাই মানুষের মধ্যেই এই বাস্তবতার রহস্য উদঘাটনের বাসনা এতটা প্রবল। বাস্তবতার রয়েছে ঐক্যের মাঝে অনৈক্য কিংবা অনৈক্যের মাঝে ঐক্যের এক জাদুকর মায়া। সব আম গাছের পাতা একই আকৃতির হবে কিন্তু তা সবগুলো হুবহু সমান হবে না। আম গাছের পাতা কখনই কাঁঠাল গাছের পাতার মত হবে না। প্রত্যেক গাছের পাতা ও ফল ভিন্ন ভিন্ন তবে তাকে সাধারণ ভাবে গাছ শ্রেণীতে ফেলা যায়। ফ্র্যাকটাল জিওমেট্রি এই প্রাকৃতিক রহস্য গুলো বুঝার ক্ষেত্রে বেশ ফলপ্রসূ পথ দেখাচ্ছে। প্রকৃতিতে প্রতিটি কাঠামোর অভ্যন্তরে কাঠামোটাকে ভেঙ্গে দেয়ার কতগুলো বল কাজ করে আবার কাঠামোটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কতগুলো বল কাজ করে। এটা যেমন একটা পরমানুর অভ্যন্তরের নিউক্লিয়াসে আছে তেমনি নিউক্লিয়ার পরিবার বা কম্বাইন্ড পরিবার কিংবা যে কোন দলবদ্ধ লোকবল বা রাজনৈতিক দলের মধ্যেও আছে, যে কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। এটা একটা এট্রিবিউট অব রিয়েলিটি যা ইউনিভারসালি সত্য। যে সকল কাঠামো গুলো প্রকৃতিতে টিকে থাকে সেগুলোর আবদ্ধকারী বল তার অভ্যন্তরের ধ্বংশকারী বলের চেয়ে শক্তিশালি হয়। আমাদের পরিবারে দাদুর চলে যাওয়ার পর আবদ্ধকারী বলটা দুরবল হয়ে গেছে। তার জায়গাটা কেউ পূরন করতে পারে নাই। তা কখনও পুরন হবে না কিন্তু অন্যান্য আবদ্ধকারী ব্যক্তিগণকে আগায়ে এসে সেই গেপটা ফিল আপ না করলে কাঠামোটা ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। তাই কনফ্লিক্ট গুলোকে ভয় পেলে চলবে না। বরং বন্ধনকারী বলগুলো কিভাবে সৃষ্টি করা যায় সে দিকে সবার নজর দিতে হবে। আইনষ্টাইনের একটি বিখ্যাত উক্তি এই যে, “এটা বিস্ময়কর! এই মহাবিশ্বটা বুঝা যায়“। তা গাণিতিক নিয়ম ও পরিসংখ্যানিক প্যারামিটারের বাধ্যবাধকতায় বাধা। এক সময় না এক সময় এর সকল রহস্য উন্মোচিত হতে বাধ্য।
এক সময় ভাবা হতো আব-আতস-খাক-বাত (পানি-আগুন-মাটি-বাতাস) দিয়ে এই বিশ্ব প্রকৃতি সৃষ্টি হয়েছে। সেই প্রাচীন ভুল ধারনা গুলো বদলে গিয়ে আজ মানুষ জানে গেছে বিশ্ব প্রকৃতিতে ৪টি বল বা ফোর্স যথা ১)মহাকর্ষ বল ২) তড়িৎ চৌম্বকীয় বল ৩) দুর্বল নিউক্লিয় বল ৪) শক্তিশালী নিউক্লিয় বল কাজ করে। এই বল সমূহের অস্তিত্ব ও উৎপত্তি সংক্রান্ত উত্তর আজও মানুষের অজানা। তবে বলগুলো আছে আর সেগুলো গাণিতিক ভাবে বুঝা যায়। এই বলগুলো কখনো তার নিয়মের ব্যতিক্রম করে না। সাধারণভাবে বাস্তবতায় দেখা যায় পরিমাণগত পরিবর্তন কোন এক ক্রিটিকাল মূহুর্তে বা ক্রান্তি লগ্নে গুনগত পরিবর্তন ঘটায়, তার পর হয় প্রতিষেধের প্রতিষেধ বা নেগেশন অব নেগেশন। উদাহারণ হিসেবে বলা যায় পানি ফুটতে ফুটতে ১০০ ডিগ্রি না হওয়া পর্যন্ত বাষ্প হয় না, এমনকি ৯৯.৯৯ ডিগ্রিতেও হবে না। ঠিক ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে বাষ্প তৈরি হবে। সাধারণ তাপমাত্রায় পারদ তরল থাকে অথচ লোহা থাকে মহা শক্ত।
যদি বুলেট পয়েন্ট আকারে বাস্তবতার আন্তলীন বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরি তা হলে তা হবে নিম্নরূপঃ-
- বাস্তবতা সর্বদাই সতেজ ও কখনই পিছন ফিরে তাকায় না। বাস্তবতা সময়ের পথ ধরে হাটে।
- আমরা বাস্তবতার বিভিন্ন পরিস্থিতির টানেল দিয়ে সমনে অগ্রসর হতে থাকি।
- বাস্তবতার পরবর্তী মূহুর্তটি সর্বদাই অনিশ্চিত আর তাই তাকে মহনীয় করে তোলে।
- বাস্তবতা পূর্ব নির্ধারিত কি না তা সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট উত্তর নাই, হতেও পারে না’ও হতে পারে।
- বাস্তবতা সর্বদা ভারসাম্যর দিকে ধাবিত হয়, এই ব্যালেন্স আছে বলেই আমরা টিকে আছি।
- বাস্তবতা বুঝার ক্ষেত্রে আমাদের মারাত্মক সব ধাঁধাঁর মীমাংসা করতে হয় তা না হলে ধোঁকা সুনিশ্চিত।
- বাস্তবতা অবারিত শক্তির উৎস যার সামান্যই আমরা ব্যবহার করতে শিখেছি।
- বাস্তবতার সবকিছু সীমাবদ্ধ ও পরনির্ভরশীল, এই পরনির্ভরশীলতার শেষ কোথায় তা আজও জানা যায়নি।
- বাস্তবতা মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয়র উপলব্ধির ফলে সৃষ্ট একটি মায়া নাকি তা সত্যিই অস্তিত্বশীল তা আজও অনিশ্চিত।
- বাস্তবতা পর্যাবৃত্ত যা বার বার ফিরে আসে কিন্তু তা সর্বদাই নতুন কিছু নিয়ে আসে, তাই তা একঘেয়ে হলেও বৈচিত্র্যময়।
- এর রয়েছে ঐক্যের মাঝে অনৈক্য আর অনৈক্যের মাঝে ঐক্যের এক জটিল সমীকরণ।
- এই বাস্তবতাকে বুঝা যায়, যা গাণিতিক ও পরিসংখ্যানিক ধ্রুব গুলো দ্বারা বেশ কিছুদূর পর্যন্ত ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
- বিশ্ব প্রকৃতি ৪টি বল এর এক মহা বিস্ফোরণ এর ফলশ্রুতি ও এর মহা সমন্বয়।
- পরিমাণগত পরিবর্তন কোন এক ক্রিটিকাল মূহুর্তে গুনগত পরিবর্তন ঘটায়, তার পর হয় প্রতিষেধের প্রতিষেধ ।
উপরের এই ১৪টি বৈশিষ্ট্য যা আমার চোখে ধরা পরেছে তার চাইতেও অনেক বেশী আন্তলীন বৈশিষ্ট্য এর থাকতে পারে। তবে সমকালীন বিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে যারা আধ্যাত্মিক কিংবা মারফতি লাইনে এই বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করতে চায় তারা নির্বোধ ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবতা কোন গুপ্ত বিষয় নয় তা আমার আপনার চারপাশে ও চোখের সামনেই বিদ্যমান। একে বুঝতে অলৌকিক ক্ষমতার প্রয়োজন পরে না। লৌকিক বিজ্ঞান চিন্তা চেতনাই এটি বুঝার জন্য যথেষ্ট। মজার ব্যাপার হলো বিশ্ব বীক্ষণ সবার কাছে সমান ভাবে ধরা পরে না। তাই একেক জনের কাছে একই বাস্তবতা ভিন্ন ভিন্ন অনুভূত হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞান তা তথ্য প্রমাণ ও পরীক্ষণ সহ সবার কাছে একই ভাবে ব্যাখ্যা করে। তাই বাস্তবতাকে সঠিক ভাবে বুঝতে হলে বিজ্ঞানের জ্ঞানের কোন বিকল্প নাই। বিজ্ঞানই মানুষকে উচ্চতর মানবে পরিণত করে।
Edit and update history> 11dec18>converted to Bangla and updated on 31dec22> 03Jan2023 > 13jan2023 > 20jan2023> 03jan2024>
No comments:
Post a Comment