আনুমানিক ২০১২ সালের জুপিটার এ্যাসেন্ডিং মুভির মিথ্যা বিষয়ক কিছু ডায়ালগ আমাকে মারাত্মক অবাক করে দিয়েছিল। ডায়ালগ গুলো ছিল এরকম যে, মিথ্যা একটি অপরিহারযোগ্য বাস্তবতা। মিথ্যার অবর্তমানে সত্যকে যুক্তিযুক্ত করা যায় না, ইত্যাদি কয়েকটা বাক্য। ধ্রুব সত্য, আপেক্ষিক সত্য ও সত্যবাদিতা (Absolute truth, relative truth and truthfulness) নিয়ে কথা বলা অত্যন্ত ঝঁকিপূর্ণ কারণ সত্যকে চ্যালেঞ্জ করার মত সৎ সাহস খুব কম মানুষেরই আছে। আমরা মিথ্যা বলি না বা বলতে চাই না কিন্তু আমাদের বক্তব্য কতটা সঠিক সত্য তাকে সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। সত্য-অসত্যর ব্যবধানটা কতখানি? বা কোথায়? সত্য কি সবসময়ই আপেক্ষিক নাকি বাস্তব সত্য বলে আরো কিছু আছে। বক্তব্যর দ্ব্যর্থকতা নিয়ে একটা দার্শনিক আরটিক্যালে এরূপ পড়েছিলাম যে, বাস্তবতা কেবল দ্ব্যর্থকই নয় বরং দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর বিভিন্ন প্রকার অর্থবোধকও হতে পারে। তার আগে বুঝে দেখি সত্য বলতে সচরাচর কি বুঝান হয় বা আমরা কি বুঝে থাকি। যা ঘটে তা বর্ণনায় অতিরিক্ত বা কম বলা কিংবা তার সাথে অতিরঞ্জিত করে আরও কিছু সংযোজন করে বলা বা সম্পূর্ণ অন্য কিছু বলাই কেবল মিথ্যা নয় এমনকি কোন সত্য গোপন করাও মিথ্যার সমার্থক। সত্য গোপন করা বা সত্যর সাথে মিথ্যার মিশ্রণ করা উভয়েই সমান মিথ্যা। এর উপর আবার মিথ্যার প্রকার ভেদ আছে, যেমন ছোট মিথ্যা আর বড় বা ঢাহা মিথ্যা। ছোট মিথ্যা হলো সামান্য ঘটনা যা না বললেও কিছু যায় আসে না কিংবা কিছুটা ঘুরায়ে বললে বড় কোন দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। এরূপ ভাবনা থেকে যে সব মিথ্যা বলা হয় তাকে ছোটখাটো মিথ্যা বলা হয়ে থাকে। আর ডাহা মিথ্যা হলো সত্যকে সম্পূর্ণ অন্য কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করা। সত্য গোপন করা যে মিথ্যা হতে পারে তা আমার মনে হয় অনেকেই জানে না কিংবা ঠিক মিথ্যার পর্যায়ে ফেলে না। সকলের মনে সত্য মিথ্যা সম্পর্কে একই ধারণা না থাকায় সমাজে এর ভুল প্রয়োগ হয় আর নানা ঝামেলার সৃষ্টি করে। সত্যকে স্পষ্ট করে বুঝতে না পারলে কিংবা মিথ্যার সাথে সত্যের পার্থক্য করতে না পারলে যতই সততা সংঘ কিংবা শুদ্ধাচার সংঘ করা হোক না কেন সমাজ থেকে মিথ্যাচার দুর করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। আর মিথ্যাচার থেকেই সকল প্রকার দুর্নীতির সূত্রপাত বলা যেতে পারে। ”সদা সত্য কথা বলিব” এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ অনেকের সেই স্কুল জীবন থেকেই শুরু হয় তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলতে চলতে তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। ছোট খাট মিথ্যা তো মানুষ অহরহ বলছে আর সত্য গোপন হর হামেশাই করে চেলেছে অনেকে। এমনকি কথা একটু ঘুরায়ে বলার ডিপ্লোম্যাসি আয়ত্ত করার চাতুর্যকে অনেকে সফলতার কৌশলও মনে করে। সত্য বলতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মিথ্যা বলাই শ্রেয় এটাই এখনকার প্রচলিত মতামত। এরূপ মন ভঙ্গিকে কি আপনি স্বাভাবিক কলতে পারেন?
একটি ঘটনা বাস্তবে যখন ঘটে তখন তা নানা জন নানা ভাবে অনুধাবন করে তাই পরবর্তীতে তাদের বর্ণনাতেও পার্থক্য পাওয়া যায়। এই পার্থক্যকে কি আমরা মিথ্যা বলতে পারি? সকলেই সৎ ভাবে ঘটনাটি বর্ণনা করেছে তাহলে মিথ্যাটা কোথায়? অনেক সময় তারা মূল ঘটনার ছোটখাটো অংশ ভুলে যায় আর অনুমানের উপর নির্ভর করে বক্তব্য দেয়, এই অনুমান নির্ভর বক্তব্যও তো সঠিক নয়। অতিরিক্ত বিশেষণ সংযোজন করে অতিরঞ্জনও বাস্তব ঘটনার বিকৃতিকে নির্দেশ করে। ভুল বলা আর মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যটা মূলত মানুষের অভিপ্রায় বা ইনটেনশন নির্ভর বক্তব্য। একজন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে সত্যকে বিকৃত ভাবে উপস্থাপন করে তা সে তার স্বার্থ সিদ্ধির জন্যেই হোক বা না হোক তা মিথ্যার পর্যায়ে পরে যাবে। তাই মানুষের কুচিন্তা/অসৎ ইচ্ছা প্রসূত সত্য উপস্থাপনই মিথ্যা।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো সত্য বলা তাই মানুষ তখনই মিথ্যার আশ্রয় নেয় যখন তার সাথে স্বার্থ জড়িত থাকে। মিথ্যার মাধ্যমে সে কোন বিপদ থেকে বাচতে চায় কিংবা কোন উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। মানুষের খারাপ অভিপ্রায় থেকেই মূলত মিথ্যার সৃষ্টি হয়। অনেকে মধ্য পন্থা অবলম্বনের কথা বলে যা সত্যও নয় আবার মিথ্যাও নয় অনেকটা ডিপ্লোম্যাটিক বক্তব্য, কিন্তু এরূপ বক্তব্যও মিথ্যা কারণ তা সত্যকে গোপন করে কিংবা তা প্রকাশ করা থেকে বাধা দেয়। ছোট খাট কয়েকটা মিথ্যার উদাহারন দিলেই বুঝা যাবে এই মিথ্যা কতটা প্রচলিত ও সমর্থিত। বস একটা কাজ করতে দিয়েছিল দু এক দিন আগে, আজ জিজ্ঞাসা করতে বলা হলো কাজটা চলছে আদতে সে কাজটা বা ফাইলটা ধরেই দেখে নাই। এটা অনেকটা জনি জনি ইয়েস পা পা, ইটিং সুগার নো পা পা, ওপেন ইওর মাউথ, হা হা হা এর মত মিথ্যা। ধরা পরলে হাসি দিয়েই উতরে যাওয়া যায় মিথ্যা। একটা মিথ্যাকে ঢাকতে অনেক সময় এটার পর একটা মিথ্যা বলতে হয় আর এর এক পর্যায়ে শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না তেমনি নিজের দোষটা বের হয়ে আসে যে সে মিথ্যা বলছে। ছোট ছোট মিথ্যা বলা থেকেই বড় সড় মিথ্যা বলার চর্চা শুরু হয়। কেউ কেউ যত্র তত্র মিথ্যা বলতে বলতে সিদ্ধ হস্ত হয়ে যায়। তাদের কেউই আর বিশ্বাস করতে পারে না। ২০১৫ সালের দিকে লাভের আশায় আমার বাড্ডার বাসার কেয়ারটেকারের বড় ছেলের প্ররোচনায় নিটোল মটরস থেকে একটা টাটা ইএক্স-২ পিক আপ ভ্যান কিনেছিলাম। ওর কথা ছিল গাড়িটা রাস্তায় নামাতে ১ লক্ষ টাকা লাগবে আর মাসে মাসে ২২ হাজার টাকা কিস্তি দিয়েও প্রতি মাসে ৩০ কি ৪০ হাজার টাকা বাড়তি থাকবে। হাতে টাকা ছিল তাই গাড়িটা রাস্তায় নামালাম, কয়েক মাসে সত্যটা পাওয়া গেল, মাসে মাসে ২২ হাজার টাকা জোগাড় করাই কষ্ট হয়ে দাঁড়াল। ও নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আমাকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়েছিল। একবার জিপিএস ট্রেকার চেক করে দেখলাম ড্রাইভার সারা রাত গ্যারেজে গাড়ি রেখে পরদিন সকালে বলে কি না সে সারা রাত পুলিশের রিকুইজিশান এর ডিউটি দিয়েছে। যা ছিল পুরপুরি মিথ্যা। তার পরপরই ও’র কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নিলাম। ভাগ্যিস গাড়িতে জিপিএস ট্রেকার লাগান ছিল। বহু কষ্ট হয়েছিল গাড়িটাকে অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়ার সময় আর লসের কথা না হয় নাই বললাম।
মানুষের সন্দেহ প্রবণতাও অনেক সময় সত্যকে মিথ্যায় পর্যবসিত করে। গাড়ির ব্যাটারিটা বসে গেছে, ড্রাইভারকে বলা হয়েছিল কয়েকদিন পর পর গাড়ি চালু করে রাখতে যাতে ব্যাটারিটা বসে না যায়। সে তাই করেছে। কিন্তু ডাস্ট ব্যাটারি হওয়ায় ব্যাটারিটা বসে যায়। মালিক তো তার উপর মহা খেপা, তার বিশ্বাস ড্রাইভার নিয়মিত গাড়ি স্টার্ট দেয় নাই। সে মিথ্যা কথা বলছে। এটা কি মিথ্যা না কি সত্য তা যাচাই করার উপয় নাই। হতে পারে ড্রাইভার মিথ্যা বলছে কিন্তু কেন সে তা করবে। সে যদি পুরান হয় তবে তার অপরাপর আচরণগুলো বিচার করলেই কিন্তু সত্য টা পাওয়া যায়। মিথ্যা বলার পিছনে তো একটা যুতসই উদ্দেশ্য বা এলিবাই থাকতে হবে। গাড়িটা নিয়মিত চালু করা তেমন কোন কঠিন কাজ নয় আর তা সে করবেই বা না কেন যদি না তার কোন অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। আমার সরল বিবেচনায় ড্রাইভার মিথ্যা বলছে না বরং তাকে অযথা মিথ্যাবাদী বানান হচ্ছে কেবল মাত্র সন্দেহর উপর ভিত্তি করে। গাড়ি চাপা পড়ে একজন আহত হলো জুরিসপ্রুডেন্সের কাজ হল গড়ির ড্রাইভারের অভিপ্রায়কে মূল্যায়ন করা।, সে কি ইচ্ছাকৃত ভাবে ওই ব্যক্তিকে আহত করতে চেয়েছিল না কি বিষয়টি একটি অসাবধানতা বসত দুর্ঘটনা। এই অভিপ্রায় যদি নেতিবাচক হয় তবে ড্রাইভারটি দোষী অন্যথায় সে নির্দোষ।
মানুষে মানুষে যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণেও মিথ্যার সৃষ্টি হয়। ভুল বুঝাবুঝি হর হামেসাই লোকজনের মাঝে চলতে থাকে। সবার কথা বলার দক্ষতা সমান না, একটা বলতে গিয়ে অন্যটা বলে বসে। সবার মেধা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতাও সমান হয় না। ভাষা গত বিভ্রাট, শব্দের অর্থের ভুল ব্যাখ্যা বা ভিন্ন অর্থে শব্দের ব্যবহার অনেক ঘটনাকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করে। অসাধু সংবাদিকরা এ ব্যাপারে ওস্তাদ বটে। ক থেকে কর্কশ কাক হবে না সুরেলা কোকিল হবে তা তারা লেখার আগেই ঠিক করে নেয়। এখানেও দেখা যাচ্ছে মানুষের অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্যর অস্পষ্টতা বা নেতিবাচকতাই মিথ্যার জন্ম দিচ্ছে। গাড়ী চাপায় দু জন ছাত্র-ছাত্রী মারা গেছে এ বিষয়ে সংবাদিকরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়ের মন্তব্য জানতে চেয়েছে, বেচারা মন্ত্রী তখনও বিষয়টি বিস্তারিত জানেন না, আর সে একটা ভিন্ন বিষয়ের মিটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাই স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে সে তার পরিস্থিতিটা বর্ণনা করেছে মাত্র। ব্যাস সংবাদ রটে গেল দু জন ছাত্র ছাত্রী মারা গেছে অথচ মন্ত্রী মহোদয় তা নিয়ে হাসছে ও একে তুচ্ছ ঘটনা হিসেবে বিচার করছে। উক্ত মন্ত্রী মহোদয় এর সকল বিষয়ে হাসি দিয়ে কথা বলাটা একটা প্রকট মিথ্যা। সে হাসিটা সর্বক্ষেত্রে কৌশলগত ভাবে ব্যবহার করে থাকে সকল পরিস্থিতি হালকা করার জন্য। তার এই মোক্ষম অস্ত্রটা তার জন্য কতটাই না বিপদের কারণ হয়েছিল সেই সময় তা সকলেই জানেন।
সত্য বা মিথ্যা বলা নিয়ে জনপ্রিয় মুভি বোধ হয় জিম ক্যারির ”লাইয়ার লাইয়ার” যেখানে দেখানো হয় একজন আইনজীবীর পক্ষে সত্য বলাটা কতটা কষ্টকর । ছেলের বার্থডে উইশ ছিল যে তার বাবা আর কখনও মিথ্যা বলবে না, সত্য সত্যই তাই হল, আর সত্য বলতে গিয়ে তার বাবার যে প্রাণান্তকর অবস্থা হয় তাই ছবিটির বিষয়বস্তু। ডাহা সত্য বলতে গিয়ে সে তার চাকরীতে বিপদে পড়লো, বন্ধু বান্ধবদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হলও আরো কত কি। সত্য সম্পর্কে এর সঞ্জাটাকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। “সদা সত্য কথা বলিব” বলতে আসলে কি বুঝান হচ্ছে। নিজের ক্ষতি হলেও সত্য কথা বলতে হবে এমন ব্রত কি বর্তমান সময়ে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য করা যাবে?
সত্যের আপেক্ষিকতা ও সত্য-অসত্য–সততা সংঘ বিষয়ে গুণীজনদের আরো সরব হতে হবে। এটা যেন ধরেই নেয়া হয় যে, সত্য কি তা সবাই জানে বা বুঝে। সবাই বুঝে ঠিকই কিন্তু একেক জন ভিন্নতর ভাবে বুঝে তাই সকলের বুঝের মধ্যে সমতা নাই। শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো সকলের মধ্যে একই ধরনা বা ধারণার সমতা নিশ্চিত করা। কিন্তু ধারনার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো বড় বড় দুর্ঘটনার কারণ তা হয়ত আমরা চিন্তা করে দেখি না। ধারণাগত বিশৃঙ্খলাই সকল অসত্যর মূলে কাজ করে বলে আমার বিশ্বাস।
এডিট হিস্ট্রিঃ ১৪নভেম্বর২০১৯ > ২৩জানুয়ারী২০১৯ >২২সেপ্টেম্বর২০২২ >০২অক্টোবর২০২২
No comments:
Post a Comment