Tuesday, June 29, 2021

এই রিকারিং বাস্তবতার বিরক্তিকর একঘেয়েমি আর অস্থিরতা


সময়ের ধাঁধা এক মহা ধাঁধা। “বার বার আসে ফিরে শুভ জন্মদিন” গানটা ছোট বেলার শোনা গান কিন্তু বড় বেলায় এসে দেখি প্রত্যেকদিনই বার বার ফিরে আসে। প্রত্যেক দিনই যেন নতুন একটা জন্মদিন। এই বার বার আসাটা বিরক্তিকর নয় কি? একমাত্র মানুষ নামক প্রাণীরই একঘেয়েমি জনিত বিরক্তি বোধের সামর্থ্য আছে । যার একমাত্র কারণ তার স্মৃতি ও তার মস্তিষ্কের সাদৃশ্যপূর্ণ ঘটনার সমাপতন ধরতে পারার ক্ষমতা। এক ভিডিও ক্লিপে দেখাল বিজ্ঞানীরা ধারনা করে সুদূর অতীতের কোন এক ভাইরাসের সংক্রমণে আদি মানব মনের স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় যার ফল স্বরূপ বানর সদৃশ মানব চিন্তাশীল নব্য মানবে রূপান্তরিত হয়। আজকের করনা বাস্তবতায় এরূপ তথ্য রূপ কথার গল্প মনে হয় না বরং মনে হয় হলিউড মুভি দেখতে দেখতে বাস্তবতাকে কোন এক মুভির সাথে গুলায়ে ফেলেছি হলিউডের Edge of tomorrow মুভিটা দেখে থাকবেন হয়ত, যাতে ঘটমান ঘটনাটি বারবার রিসেট হয় হয়ে যায় শুরু থেকে, বাস্তবতা তো আদতেই রি-অকারিং, তার পরও কেন এত অবাক হতে হবে? ইঁদুরের মেমোরি নাকি মাত্র ২৪ ঘণ্টায় রিফ্রেশ হয়ে যায়। মানুষের যদি এমন হত তা হলে তো মানব জ্ঞনের বারটা বেজে যেত। মেমোরি/স্মৃতি বেশি দেখেই যত চিন্তা ভাবনা, অতীতের আক্ষেপ আর ভবিষ্যতের আশংকা। সব ভুলে এই "এখনে" মননিবেশ করেত পারলেই যত শান্তি। অতীত যত ভুলে থাকা যায় তত ভাল। মানুষের এই স্মৃতি ক্ষমতা আছে বলেই কিন্তু সে চিন্তা করতে পারে, এখনকে আগের সাথে তুলনা করতে পারে আর তা থেকে শিখে ও নতুন স্বপ্ন দেখার সাহস রাখে। এই স্মৃতি যদি না থাকত তা হলে মানব মনের কি হত? মন বলে আদৌ কি কিছু থাকত? মন বলতে বুঝাচ্ছি চিন্তা, ভাবনা, কল্পনা করার ক্ষমতা। স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতাই মন সৃষ্টি করে কারণ তা গত, বিগত, এখন আর আগামীর মধ্যে একটা যোগসূত্র প্রদানে মানুষকে সমর্থ করে। প্রতিদিন ঘুম থেকে  উঠে আমাদের এই কয়েকটা প্রশ্নর উত্তর প্রদান করতে হয়। আমি কোথায় আছি, কোথায় ছিলাম আর কোথায় যাচ্ছি আর এ সব কিছুর উদ্দেশ্যটা কি? এই বিষয়গুলি বার বারই মনে আসে, আর বার বার বুঝায়ে দেয়া হয় কি থেকে কি হল, কেন হোল আর কি হতে যাচ্ছে।

অতীত কিংবা ভবিষ্যতকে ধরা যায় না তা’র অবস্থান কালে আর মনে, তার পরও মানুষ অতীতের প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। আমি পর্যাবৃত্ত পুনরাবৃত্তির কারণে বিরক্তির উদ্রেকের প্রসঙ্গটা আনতে চাচ্ছি কারণ যা বার বার করা হয় তা’র জন্য বিরক্তি বোধের উদ্ভব হওয়াটাই মানবিক ও স্বাভাবিক। গরু আজীবন ঘাস খেয়েই কাটায় দিবে তাতে তার কখনই অরুচি হবে না কিন্তু এমনও মানুষ আছে যে দু বেলা একই তরকারি দিলে মহা রাগান্বিত হয়ে হয়ত খাবেই না। এই রুচির বৈচিত্র্য বা মনোভঙ্গি কিংবা মুড এগুল তো মানবিক বিষয়াবলী। মানুষ যদি প্রত্যেক দিন একই কাজ একই ভাবে করে তাহলে সে তো রোবট সদৃশ হয়ে যাবে যদিও তাতে করে তার ব্যবহারিক জীবনে দক্ষতা আসবে আর সে উত্তর উত্তর উন্নতি করবে। যে একেক দিন একেক রকম আচরণ করতে চায় সে হয়ে যাবে উশৃঙ্খল আর তার কাজে কোন আয় উন্নতি হবে না। এই দুটোর মাঝে যার ব্যালেন্স করে চলে ও দু দিক সামাল দিতে পারে তারা অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। এ সব সবারই জানা কথা। আমি যে দিকটায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি তা হল, এই দিন রাত্রির আবর্তনে যে বিরক্তিকর বার বার আসে ফিরে শুভ/অশুভ একই ধারার ছন্দবদ্ধ পাতা উল্টানো। যা ঋতু পরিবর্তনের পালা বদলে ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড পট পরিবর্তনে বিচিত্র হয় বটে কিন্তু এই ঋতুগুলোও বছর পরিক্রমায় ছন্দবদ্ধ বুঝা যায়। এই রোদ, এই বৃষ্টি, এই মেঘ, এই শীত যখন যা খুশি তাই হয় না বরং পর্যায়ক্রমে বছরের কাছা কাছি মাসগুলতে ঘুরপাক খায় একই নিয়মে। যারা বিজ্ঞান বুঝেন তারা জানেন এ সব ঋতু পরিবর্তনের জন্য দায়ী সূর্য থেকে পৃথিবীর অবস্থান দূরত্ব তারতম্য যা পৃথিবীর কক্ষপথের গতি আর তার নিয়মিত আবর্তনের সাথে পর্যায়ক্রমিক সুতা বান্ধা। মানুষ যত জানতে চাচ্ছে ও জানতে পারছে ততই তার কছে সবকিছু বৈচিত্র্য হীন গণিত, পদার্থ, রসায়ন হয়ে নিরস হয়ে যাচ্ছে। আগে মানুষ বিদ্যুৎ চমকানকে দেবতাদের রোষানল মনে করত আর আজ সবাই ম্যাক্সওয়েলের ইলেক্ট্রম্যাগনেটিজম সূত্র গুল জানে তাই আর তার ভয় করে না। সবই যদি বুঝে ফেলেন তা হলে বিদ্যুৎ চমকের রোমাঞ্চ আর থাকল কই। আমার বক্তব্যটা এখানেই।

আমাদের মনের যেমন স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা আছে তেমনি এই মনেরই আবার প্রচণ্ড কষ্টকর স্মৃতি গুল মুছে ফেলার ক্ষমতাও আছে। এই মুছে ফেলার সক্ষমতা আছে বলেই বাবা মা, সন্তানের মৃত্যুর মত কষ্টকর স্মৃতি গুল ভুলে থাকতে পারে মানুষ। আমার জন্য এই কষ্ট গুল ভুলে না থাকলে বাচার ইচ্ছাই নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হয়েই গেছে বলা যায়, তাই মাঝে মাঝে খুব ক্ষতিকর কাজ করতে ইচ্ছা করে। বারট্রান্ড রাসেলের লেকচার পরতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, একমাত্র মানুষেরই একঘেয়েমি জনিত বিরক্তি বোধের সামর্থ্য আছে। আর এই বিরক্তি বোধ আসে কারণ যে পর্যাবৃত্ত একই দিবা রজনীর মধ্যে দিয়ে যায়। এই দিবা রজনীর পর্যাবৃত্ত গতিময়তায় জীবন কোথা হতে যে কোথায় হারায়ে যায় তার খেই ধরে রাখাই দায়।

হঠাৎ যখন সব কিছু অর্থহীন মনে হয়, যখন কোন কাজেই মন বসে না, তাকে অনেকের কাছে অযথা লোড শেডিং এর মত মনে হতে পারে। আমার এমন প্রচুর হয়েছে আর এর জন্য নানা জনের সাথে এর প্রতিকারের বিষয়ে আলাপ করেছি কিন্তু প্রত্যেকেই নানা মন্তব্য প্রদান করা সত্ত্বেও সন্তোষজনক কোন সমাধান প্রদান করেতে পেরেছে বলে মনে হয় না। মানুষের মতামতের কোন গাছ পাথর নাই, যার যা জ্ঞান তাই ঝাড়তে থাকে অনবরত আর নিজের মতামতের যথার্থতা যাচাই করার প্রয়োজনও বোধ করে না। যখন মন এর বাত্তি ফিউজ হয়ে যায় তখন কেবল সেই বুঝতে পারে এই অন্ধকার একাকীত্ব কতটা ভয়ানক হতে পারে। মানুষের মন যখন চরম একাকীত্ব অনুভব করে তখন সে একজন সঙ্গী খুঁজে যার সাথে মনের কথা গুল শেয়ার করে সে মনকে কিছুটা হলেও ভেনটিলেট করতে পারে। আদতে মানব মন প্রকৃতিগত ভাবেই একক বা একাকী। এই বদ্ধ জগতে সে অতিথি আকাঙ্ক্ষা করে। মানব মনের সন্তুষ্ট হওয়ার ব্যকুলতাকে প্রশমিত করতে পারে কেবল সে’ই যাকে সে মনে প্রবেশাধিকার প্রদান করে। যারা গতানুগতিকতাকে মেনে নিয়ে জীবনাচরণে কোন সমস্যায় পরে না তারা স্বাভাবিক নাকি যারা প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয় তারা স্বাভাবিক এটা যাচাই করার মত কোন যন্ত্র নাই বা এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই।

রাসেল আমার ধানমন্ডি স্কুলের বন্ধু, মানে অনেক পুরাতন বন্ধু, ও’র এক কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড মুস্তাফিজ ভাই পুরাতন টাকা ও মুদ্রা সংগ্রহ করেন। আমার কালেকশন থেকে তাকে কিছু দেয়া হয়। আমি যে বিষয়টাতে অবাক হই তা হল, এতটা উদ্যম নিয়ে তিনি কেন এই সংগ্রহের কাজটা করেন। এখন পর্যন্ত আমার এ বিষয়টি বুঝে আসে নাই। এই পাগলের মত পুরাতন মুদ্রা তা’ও আবার বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় মাথায় রেখে এই সংগ্রহ কার্যক্রমের পিছনে উনি উদ্যম পান কোথায়? উনাকে ডেকে এনে আমার লেখা গুল দিয়েছিলাম, আমার পাগলের মত লেখা লিখি করার অভ্যাস গড়ে উঠেছে ইদানীং, তা’ও আবার মনের কথা গুছায়ে বলার মত লেখা লেখি যা বিষয়ভিত্তিক নিজের আত্ম কথনের মত রূপ পায়। মুস্তাফিজ ভাই এর এই মুদ্রা কালেকশনের পেছনের রহস্য উদ্ধার করতে পারি নাই। আমার লেখার উদ্দেশ্য আমি নিজের কাছে ব্যাখ্যা করেছি আমারই অন্য এক লেখায় মুস্তাফিজ ভাই এর পুরাতন মুদ্রা সংগ্রহর মত আরেকটি ঘটনা যেমন গিটার বাদক শুখন ভাই, উনি বিভিন্ন ব্রান্ড এর গিটার সংগ্রহ করেন, উনি গিটার বাদক তাই উনার শখ এর যে যুক্তিতে যথার্থতা আছে তেমনি মুস্তাফিজ ভাই যেহেতু ব্যাংকার তার মুদ্রার প্রতি আসক্ত হওয়াটা অযথা না’ও হতে পারে। তবে আমার অপর এক স্কুল বন্ধু বিজু গাড়ি থাকা সত্ত্বেও সাকেলে করে বন্ধুদের সাথে ভ্রমণ করতে মহা আনন্দ পায়। মানুষের এই বিভিন্ন দিকে আসক্তি আছে তা বুঝা যায়। এই আসক্তিকে জ্যাকব ব্রুনওস্কি তার দ্যা এসন্টে অব ম্যান ডকুমেন্টারিতে বলেছিলেন বা দেখিয়েছিলেন একজন ময়লা আবর্যনা দিয়ে বিশাল এক ভাস্কর্য সদৃশ নির্মাণ করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী মানুষ এর মন বড় কিছু একটা করতে চায় আর তার এই বড় কিছু করার বাসনা থেকেই এই সব যা কিছু তা করে থাকে। তা যত উদ্ভটই হোক না কেন তার কাছে তো মূল্যবান আর এর জন্য সে অন্যর কাছ হতে প্রশংসা প্রত্যাশা করে। এ সব গুলো আসক্তি বা সখ পূরণকারীরা মূলত অন্যকে তাদের কৃত কর্ম প্রদর্শন করে আনন্দ পায়। দর্শক না থাকলে এই সংগ্রহ কিংবা এই পাগলামি গুলোর মানেটা কি এমন হতে পারে। যেমন আমার লেখা পড়ে কেউ যা খুশি তাই মন্তব্য করলেও আমার ভাল লাগে, আর যাই হোক, আমার মনের কথা গুল সে শুনেছে তাতেই আমি খুশি। অনেকেরই মন্তব্য এমন যে, বেশিদূর আগ্রহ ধরে রাখতে পারা যায় না আপনার লেখা পড়ার সময় কার মন্তব্য যা’র মধ্যে আগ্রহ নাই সে এই লেখা পড়ে মজা পাবে না – ইত্যাদি। একটা বিষয় পরিষ্কার যা হল যারা সারাক্ষণ টিকে থাকার ধান্দায় ব্যস্ত যারা তারা এই সব সখ পালন করতে পারবে না কিংবা এর মূল্য নির্ধারণ করতে পারবেন না।  এ প্রসঙ্গে বারট্রান্ড রাসেলের ‍”অরাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তি প্রবৃত্তি” বইটি চমৎকার তবে বহু আগে পড়েছি বলে এর উদাহরণ গুল ভুলে গেছি।

মন যখন বসে যায় তখন তাকে উঠাব কি দিয়ে, চার্জ দিব কি দিয়ে? সেদিন মাওয়া থেকে আসার পথে গাড়িটা বসে গেল, স্টার্ট নেয় না। এক ম্যাকানিক এসে বেটারি খুলে নিয়ে গেলে, চার্জ দিয়ে নিয়ে এসে গাড়ি স্টার্ট করে দিল, তেমনি করে মনটাকে চার্জ দিব কি দিয়ে? ভারতীয় জনপ্রিয় লেখক ও সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতানুসারে চার্জার ব্যক্তিত্ব খুঁজে নিজেকে চার্জ দিতে হবে। কেউ হয়ত বলবেন হাওয়া বদল করে আসেন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বারে বারে আসে ফিরে একই জন্মদিন সমস্যাটার কি তাতে সমাধান হবে? ইদানীং কালের উন্নত মনোবিজ্ঞান অনেককিছুই ব্যাখ্যা করে কিন্তু মানব মন এত বিচিত্র যে সরল অংক দিয়ে তা কখনই সমাধান করা যায় না। এত জটিলতা সমাধানের উপায় কি তা কেউ জানে বলে মনে হয় না। দিন আসে দিন যায় ফের দিন আসে সন্ধ্যা ঘনায় রাত হয়। এই পর্যায়ক্রমে আমাদের রুটিন মাফিক কাজ গুল করা লাগে, তা না করা হলে পশ্চাদ অপসারণ ঘটতেই থাকে। মনের মাঝে যত ভাবের উৎপত্তি ও তার জন্য যত ইচ্ছা আর অনিচ্ছা। এই ইচ্ছা করা, আর না করা নিয়ে বিস্তর চিন্তা ভাবনা করেও কোন আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় নাই বা পাই নাই। ভবিষ্যৎ যতই নিশ্চিত করতে চাই না কেন তা সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ উক্তি, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে একটা কথাই বলা যায় যা হল, পরিবর্তন হবেই, এই পরিবর্তনকে নিজের স্বপক্ষে আমরা কতটা আনতে পারি তার উপরই আমাদের সফল হওয়া নির্ভর করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের ইচ্ছার স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায়, ইচ্ছাটা মরে গেলে কি ভাবে তাকে পুনর্জীবিত করব সেই উপায় কেউ অদ্যাবধি বলে নাই।

আপডেট হিস্ট্রিঃ ১৪সেপ্টেম্বর২০১৭> প্রস্তাবিত ২১নভেম্বর২০১৯> 20সেপ্টেম্বর২০২০> ৭জুলাই২০> ০৬ফেব্রুয়ারী2021> ০৩মাচ২০২১> ২৩জুন২০২১>২৯ জুন ২০২১>

No comments:

Post a Comment