২০১৬’র জুলাই মাসে উইন্ডোর কার্যক্রমে ইন-চার্জ থেকে সিনিয়র অফিসার (আইটি) পূর্ণাঙ্গ লাইন আপ সংযোজন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসাটা বেগবান করা। যারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে জেনে গেছেন এই সংযোজন সময় সাপেক্ষে কতটাই না যথার্থ ও যুক্তিযুক্ত হয়েছিল যার ফলশ্রুতি নিম্নের ছক গুলর মাধ্যমে প্রকাশিত সাফল্য চিত্র। আক্ষেপ এই যে এই সাফল্য অর্জনের স্বীকৃতি স্বরূপ উচ্চতর মহল থেকে কোন প্রণোদনা কিংবা সম্মাননা স্মারক সংশ্লিষ্টদের দেয়া হয় নাই। সঠিক লোকবল সঠিক স্থানে ও সঠিক সময়ে ডিপ্লয়মেন্ট ব্যবসায়ীক সাফল্যের চাবি কাঠি এই কথাটাই বহুবারের মত এখানেও প্রমাণ হয়ে গেছে। আলোচনার শেষাংশে আমাদের দেশে ইসলামী ব্যাংকিং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সমস্যার উপর খানিকটা আলোকপাত করব। তাই প্রথমটা সাফল্য চিত্রায়ন ও এর নিয়ামক গুল বিশ্লেষণ আর শেষাংশটা মূলত সট (SWOT, Strength :: Weakness || Opportunity :: Threat) এ্যানালিসিস। সট এ্যানালিসিস এর মূল উদ্দেশ্যই থাকে সমস্যা ও ঝুঁকি সমূহকে চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের উপায় প্রস্তাব করা। নিম্নের আলোচনায় আমি তা করার চেষ্টা করব। আমার ব্যাখ্যা গুল যথাযথ না’ও হতে পারে তাই আগেই অনুরোধ রইল যারা এর চেয়ে আর বিজ্ঞ বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবেন তাঁরা যেন তা মন্তব্যে প্রদান করে লেখাটাকে সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করেন।
নিচের টেবিল-1 আলোচ্য ব্যবসায়ীক ইউনিটটির বিগত ৫ বছরের (২০১৬ থেকে ২০২০) ক্রমাগত সাফল্যর উপাত্ত। এই সাফল্যর একক কৃতিত্বর দাবিদার উইন্ডোতে ওই সময়কালে কর্মরত কর্মকর্তা গণের অক্লান্ত পরিশ্রম আর দায়িত্ব বোধের সাথে পেশাদারিত্ব। এই সময়কালে তিন জন এজিএম ইন-চার্জ বদল হয়ে গেছেন বটে কিন্তু দু/তিন-জন কর্মকর্তা ক্রমাগত অক্লান্ত কাজ করে গেছেন। ধারাবাহিকতাটা তাই ধরা পরেছে নিচের ছক গুলতে।
সাফল্য চিত্রটি সরল ও স্বাভাবিক, ব্যাংকিং অঙ্গনে যাদের পদচারণ তার সকলেই জানেন প্রদত্ত টার্গেট অর্জনের চাবি কাঠি হল একটা সরল সূত্র। আমানতের বিপরীতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। লক্ষ্যমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি করা হয়েছে যতে উত্তরণের ধারাটা অব্যাহত থাকে। এই উইন্ডোর অর্জনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। ২০১৬ সালে আমানত ও বিনিয়োগ এর বিপরীতে মুনাফা অর্জন স্বাভাবিক নয় বটে, যার কারণ মনে হয় নতুন লোকবল তখন মাত্র কাজে নেমেছে। এই নতুন টিম পরবর্তী বছর যেমন আমানত বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়নি তেমনি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে। উপরের ছক থেকে আলোচনার সুবিধার্থে নিচের গ্রাফ গুল প্লট করা হয়েছে যাতে বাস্তব চিত্রায়নটা বুঝতে সহজতর হয়।
নতুন লোকবল উইন্ডোতে ইনজেক্ট করা হয় ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের মাঝামাঝি, অর্থাৎ ২০১৭ এর জুলাই মাসে, তাই দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৭ তে আমানতে লক্ষ্য মাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। পরবর্তী বছর ২০১৮ তে লক্ষ্য অর্জন তো হয়েছেই বরং আর বেশি হয়েছে। ২০১৮ এর লক্ষ্যমাত্রার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী বছরের জন্য আকাশচুম্বী লক্ষ্যমাত্রা প্রদান করা হয়। বিগত তিন বছরের চিত্র অনুপাতে এই লক্ষ্যমাত্রা প্রদান যে কোন বিচারে অস্বাভাবিক মনে হতেই পারে কিন্তু জনবলের শক্তি অনুযায়ী তা যথার্থই ছিল, তাই দেখা যায় সেই প্রদত্ত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জন দ্বিগুণেরও বেশী। আমানতের এই অস্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রা প্রদান ও তার দ্বিগুণের বেশী অর্জন করার সামর্থ্য প্রমাণ করে উইন্ডোতে যে লোকবল প্রদান করা হয়েছিল তারা যথাযথ তো ছিলই বরং আর যোগ্য ছিল।
ব্যাংকিং এর মূল ব্যবসাই হল আমানতের বিপরীতে বিনিয়োগ করার সামর্থ্য। যাকে বলে পরের টাকায় ব্যবসা করা। আমানত সংগ্রহর পাশাপাশি যদি সেই অনুপাতে বিনিয়োগ করা না যায় তবে মুনাফার বদলে লোকসান হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে দেখা যায় বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অনুপাতে অর্জিত বিনিয়োগ আমানতের গ্রাফের সমানরূপ। এটাও প্রমাণ করে যে সঠিক ব্যাংকিং করার ফলেই উইন্ডোটি ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। নিচের গ্রাফ-চিত্রটি তার প্রমাণ বহন করে।
আমানত এর পাশাপাশি বিনিয়োগ যথাযথ হওয়ায় প্রফিট বা মুনাফার ক্রমাগত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। উপরের চিত্র গুল সবগুলি ব্যাংকিং ব্যবস্থা দক্ষতার সাথে প্রয়োগের ফলাফল। কিন্তু ২০২০ এর ফলাফল বিগত বছর গুলর মত নয় কেন? মনে হতে পারে উর্দ্ধযাত্রাটা হঠাৎ থেমে গেছে। পাহাড়ে উঠতে উঠতে সকলেরেই বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন হতেই পারে, এটা তেমন একটা বিষয় কি? ২০২০ সালে এই থমকে যাওয়ার বা রেস্ট নেয়াটা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক মনে হলেও আসলে তা নয়। যারা ব্যবসা করেন তাঁরা জানেন প্লেন যখন ফ্লাই করে তখন এক ধাঁ তে তা টেক অফ করার সময় যত উপরে উঠান যায় ততই তা উচ্চতর স্তরে উড়তে থাকবে, অন্যথায় গোত্তা খেয়ে নিচে পরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২০ সালের এই হঠাৎ স্থবিরতা এক প্রকার বিপদ সংকেত বটে আর যারা অভ্যন্তরের খবর রাখেন তাঁরা জানেন হয় নতুন প্রডাক্ট উন্মোচন করা হয়নি কিংবা পরিচালনায় কোথাও না কোথাও গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ উন্নতিটার নিয়ামক গুল ধরা গেছে তাই হঠাৎ থেমে যাওয়ার কারণগুলো পাওয়া যাবে নিশ্চয়। ওই সময়কারের পরিবর্তন গুল ধরতে পারলেই নিয়ামক গুল পাওয়া যেতে পারে। প্রথম কারণটি হতে পারে ব্যাংকিং সফটওয়্যার এর পরিবর্তন কিংবা উন্নয়ন। হঠাৎ করে নতুন সফটওয়্যার প্রদান করা হলে তা দু দিকেই ধাক্কা দেয়, পরিচালনা কারি কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ আর গ্রাহকদের সেবা দানের একাউন্ট নম্বর গুলতে রদবদল। নতুন সফটওয়্যার এর সংযোজনা হতে পারে জরুরি ছিল কিন্তু এই নতুনত্ব আনয়নের যে ঝুঁকি তা সমাধান বা মিটিগেট করার সহায়ক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নতুন সব সময় ভাল কিছুই নিয়ে আসে কিন্তু তা হজম করার শক্তিও থাকা চাই। অতি মশলাদার খাবার মজার হয় নিশ্চয় কিন্তু সবাই তা হজম করতে পারে না সহসাই, সময় লাগে অভ্যাস করতে। বাটন মোবাইল থেকে টাচ্প্যাড মোবাইলে উন্নয়নে অনেকেই এই বিষয়টা বুঝতে পরেছেন বৈকি।এমনকি অনেকে টাচ প্যাডে উঠতেই পারেননি। ডিজিটাল ডিভাইডের ও’পারেই রয়ে গেছেন। দ্বিতীয় কারণটি হতে পারে এই যে উন্নয়ন হল উইন্ডোটার তার জন্য এর কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কোন প্রণোদনা প্রদান করা হল না, তাই যে কাজ গুলকে তারা প্রাথমিক উদ্দীপনা হিসেবে নিয়ে শুরু করেছিল, যার প্রতিফলন প্লেনটার টেক অফ করা, তা তারা ধরে রাখতে পারছে না। তৃতীয় কারণটি হতে পারে ব্যবসার মূল কাঠামর পরিবর্তন, ওয়েটেজ ভিত্তিক মুনাফা থেকে ইনকাম শেয়ারিং পদ্ধতিতে গ্রাহকদের মুনাফা প্রদানের সিদ্ধান্ত। নতুন সফটওয়্যারে এই পরিবর্তন আনায় স্থায়ী আমানতকারীরা মুনাফা’র লভ্যাংশ কম পেল যার ফলে তাদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হওয়ায় স্বাভাবিক। এই তিনটা কারণে ২০২০ সালে ব্যবসায়ীক এই থমকে যাওয়া পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। চতুর্থ কারণ হতে পারে, ব্যবসায়ীক ধারায় গ্রাহকদের নতুন কোন আমানত কিংবা বিনিয়োগ প্রডাক্ট অফার করার অপারগতা। ব্যবসায় নতুনত্ব কিংবা চমক না আনলে গ্রাহক সাধারণ আগ্রহ হারয়ে ফেলতে বাধ্য কারণ অন্যরা তাদের ডাকছে ক্রমাগত নতুন নতুন প্রডাক্ট নিয়ে। আপনার প্রতি তাদের প্রতিপক্ষ সুলভ মনোভাবে সৃষ্টি হওয়ায় তাই অবাক হওয়ার কিছুই নাই। এছাড়াও আর অন্যান্য কারণ থাকতে পারে যেমন, প্রধান কার্যালয়ের তদারকির অভাব কিংবা উইন্ডোর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সকল দিকে নজর দেয়ার অপারগতা। ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল বাড়লে বা আউট লেট বাড়লে তার একটা ওভার হেড কষ্ট আছে, তাই তা দুর ভবিষ্যতে ব্যবসায়ীক উন্নয়ন ঘটালেও প্রাথমিক ধাক্কাটা শ্লথ করে দেয় ব্যবসার গতি। কিংবা প্রধান কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রক ডিপার্টমেন্ট কে ডিভিশনে উত্তরণ প্রস্তাব এর অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে না পারা। অবশেষে তাই বলতে হয় আল্লাহ্ সুবহানাওয়াতালাই ভাল জানেন কেন কি হল। মানুষ কেবল লাইন মত চেষ্টা চালায়ে যেতে পারে মাত্র। আমাদের দেশে ইসলামী ব্যাংক গুলোর অর্থ প্রবাহ যথাযথ রাখার প্রয়োজনে কোন মানি মার্কেট আজও গঠিত হতে পারে নাই, তাই অতিরিক্ত অর্থ তারা অন্য ব্যাংকে মেয়াদী জমার আকারে রেখে থাকে। এভাবে দেখা যায় উইন্ডোটির সারপ্লাস মানি একই অঙ্গনের অন্য চারটি ব্যাংকে নিম্নোক্ত ছকানুপাতে রাখা হয়েছিল। ওই সকল ব্যাংক সমূহে জমা কৃত ফান্ডের অর্জিত মুনাফার অংশবিশেষও উপরোক্ত ছকে প্রতিফলিত।
ব্যাংক ফান্ড সব ব্যাংক নেয় না তার পরও ক্রাইসিস চলাকালীন ও ইসলামী মানি মার্কেট চালু না থাকায় বিভিন্ন ব্যাংকে আলোচ্য উইন্ডোর টাকা রাখা হয়েছিল অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে, উপরোক্ত পাই চার্ট থেকে দেখা যায় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে সর্বাধিক টাকা রাখা হয়েছে। এর আগে এই শেয়ার ইউনিয়ন ব্যাংকের ছিল, মার্কেটে তাদের সম্পর্কে ধারণার প্রেক্ষিতে এই ফান্ডের স্থানান্তর করা হয় অন্যান্য ব্যাংক সমূহে। যা ভুল প্রমাণ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে বরং একটু রিস্ক নিয়ে যদি ওখানেই রাখা হত তবে অধিক মুনাফা পাওয়া যেত আর উত্তরণের গতি আর বৃদ্ধি পেত। বিশ্বয় বোধ হয় এই দেখে যে, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে SIBL এ সারপ্লাস স্থায়ী আমানতের বৃহদাংশ স্থানান্তরিত হয়ে গেছে ২০১৯ এর আগেই তা’ও আবার বৃদ্ধি পেয়েছে এক বছরের ব্যবধানে। এই বৃদ্ধির পিছনের নিয়ামক গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা অবশ্য হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে, যে লোক গুল এই ফান্ড এর পিছনে কাজ করেছে তাদের মধ্যে রদবদল হয়ে গেছে। ইউনিয়ন ব্যাংকের লোক-গুল অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে গেছে আর SIBL এর লিয়াজ জনবল আর জোরদার হয়েছে। উপরের ছক দুটো’র প্রথমটি ২০১৯ এর শেষের আর পরেরটি ২০২০ এর শেষের ডাটার ভিত্তিতে প্রণীত। এই সময়কালে উইন্ডোটির আমানত প্রবাহ প্রায় একই রকম আছে বুঝা যায় এবং অন্যান্য ব্যাংকে রাখা টাকার মধ্যেও তেমন বড় ধরনের কোন হেরফের হয় নাই। উদ্ভূত করনা পরিস্থিতি অতিক্রম করে ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোটি তার আমানতের পাশাপাশি বিনিয়োগ ধরে রেখেছে এটা নিতান্তই কম কথা নয়। তার পরও বলব, নতুন নতুন বিনিয়োগ প্রডাক্ট উন্মোচন করে উইন্ডোটি আর ভাল অবস্থানের দিকে যেতে পারতো, কিংবা অদূর ভবিষ্যতে যেতে পারবে বলে আশা করা যায়।
উপরোক্ত ছক সমূহ এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিং এর চাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতা আছে তা প্রমাণ করে। ইসলামী ব্যাংকিং এর চাহিদা আছে এদেশের গণ মানুষের মধ্যে। তাই অনেক গুল ইসলামী ব্যাংক পুর দমে কাজ করে যাচ্ছে আর এরই মধ্যে আর দুটো কনভেনশনাল ব্যাংক সম্পূর্ণ রূপে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়ে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনে। ইসলামী ব্যাংকিং এর সুবিধা – অসুবিধা – ঝুঁকি ও সম্ভাবনা নিয়ে এর পর আলোচনা করব।
সুবিধাঃ এ দেশের জনগণের ইসলামী ব্যাংকিং এর প্রতি আগ্রহ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের আগ্রহর কারণেই ইসলামী ব্যাংকিং ইউনিট সমূহের প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী আছে। দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশই মুসলিম আর তারা কনভেনশনাল ব্যাংকিং এ সুদ সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি এত দিনে পরিষ্কার বুঝতে পারছে। সুদ কে সুদ না বলে মুনাফা বলা কিংবা সুদি ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ এর টাকা দরিদ্রকে সাদাকা করে তাকে পরিশোধিত যে করা যায় না বা সুদের টাকা সুদ মুক্ত করা যায় না তা তারা এতদিনে বুঝতে শুরু করেছে। দেশের আলেম-ওলামাদের মধ্যেও ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল যা দিন দিন দুর হয়ে যাচ্ছে। তাদের মাহফিল বয়ানেও ইদানীং তাঁরা ইসলামী ব্যাংকিং এর পক্ষে বক্তব্য রাখছে। দেশে বর্তমানে অনেক গুল ইসলামী ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে একাধিক কনভেনশনাল ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকে সম্পূর্ণ রূপান্তরের অনুমোদনও পেয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারী মহল ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে ভাল মনোভাব রাখে আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এই সেক্টরের ব্যাংক গুল দ্রুত তাদের অবস্থান পক্তো করে নিতে পারে। ইসলামী ব্যাংকিং কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য বিশ্ব মানের সফ্টওয়ার দেশেই তৈরি হচ্ছে। দেশীয় কোম্পানি মিলিনিয়ামের ইসলামী ব্যাংকিং সফটওয়্যার ’আবাবিল’ ও ইরা ইনফো-টেক এর ’হিকমা’ কোর ব্যাংকিং সলিউশন ব্যবহার হচ্ছে দেশের বেশির ভাগ ইসলামী ব্যাংক গুলোয়। মিলিনিয়ামের ‘আবাবিল’ মালয়েশিয়া থেকে বিশ্ব মানের সফটওয়্যার হিসেবে প্রথম পুরষ্কারও অর্জন করেছে। মালয়েশিয়া ছাড়া দুবাই এও মিলিনিয়ামের ‘আবাবিল’ সিবিএস ব্যবহৃত হচ্ছে।
অসুবিধাঃ সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও কম না, জনমনে ইসলামী ব্যাংকিং এর সঠিক প্রয়োগ নিয়ে অনাস্থা আছে আজও। এই অনাস্থা কাটাতে ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন আরও অনেকদিন থাকবে বলে মনে হয়। গ্রাহকদের মধ্যে টাকায় টাকা বাড়ানর প্রবণতা এখনও আছে। যখন তাদের বলা হয় ইনকাম শেয়ারিং রেশিও (ISR) এর মাধ্যমে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে মুনাফা বণ্টন করা হয় তখন তাঁরা তা বুঝতে পারেন না। বার বার জিজ্ঞাসা করেন কত টাকা রাখলে মেয়াদ শেষে কত টাকা বাড়তি পাব কিংবা এখন রেট কত করে চলছে। এই মনোভঙ্গির পরিবর্তন হতে পারে যখন তাদেরকে এই নতুন ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অভ্যস্ত করে তোলা যাবে। এফডিআর এর ইসলামী সমার্থক শব্দ যে এমটিডিআর বা টার্ম ডিপোজিট এটাই অনেকে জানেন না। আর সামান্য পরিবর্তন করে একই রকম প্রডাক্টের ভিন্ন নাম বলা হলে তা অনেক কনভেনশনাল ব্যাংকার এর কাছেও বিভ্রান্তিকর মনে হয়। যেমন আল-ওয়াদিয়া, মুদারাবা কিংবা বাই-সালাম, বাই-মুয়াজ্জাল এসব টার্ম গুল গ্রাহক এমনকি অনেক কনভেনশনাল ব্যাংকার-গনও বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না। তাদের কৌতূহল অন্য দিকে, যেমন তাদের প্রশ্ন একই রকম দেখতে কেন, ইসলামী প্রডাক্টের মাথায় টুপি কই, টাখনুর উপর পাজামা আছে কি না, এ সব খুঁজে তারা প্রডাক্ট গুলয় আর প্রডাক্ট বিপণন কারী লোকজনের মধ্যে। এটা বুঝাটা কেন এত শক্ত যে ব্যাংকিং প্রডাক্ট গুল দেখতে এক রকম হতেই পারে যেহেতু তাকে কনভেনশনাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার একই মাঠে খেলছে। এমন যদি হতো যে দেশের পুর ব্যবস্থাটা ইসলামিক তা হলে তার কাছে ব্যবসা করাটা সহজ হতো। পুরপুরি বিপরীত একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চলতে হচ্ছে বলে এর অভ্যন্তরীণ কাঠামোটা বা চুক্তিটা ভিন্ন করে প্রডাক্ট গুল একই রকম রাখা হয়েছে। তাই বুঝতে হবে কনভেনশনাল ব্যাংক করে সুদে মুনাফা প্রদানের চুক্তি আর ইসলামী ব্যাংক করে কেবল ব্যবসায়ীক চুক্তি যাতে মুনাফা বন্টন করা হবে এই শর্ত থাকে। এই চুক্তির ভিন্নতার ফলে প্রডাক্ট গুল ভিন্ন নামে দেখতে কাছা কাছি হলেও আদতে তারা ভিন্ন ঘরানার। এটা সাধারণ গ্রাহকদের সাথে সাথে কনভেনশনাল ব্যাংকিং এ অভ্যস্ত অভিজ্ঞ ব্যাংকারদেরও বুঝান কষ্টকর। উপরন্তু ইসলামী নামটা থাকায় অন্য ধর্মাবলম্বীরা একে কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য ব্যাংকিং মনে করে। এটা যে সবার জন্য উন্মুক্ত একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা তা’ই জনমনে প্রতিষ্ঠা করা যায় নাই এত দিনেও। মানি মার্কেট না থাকার কারণে কোন ব্যাংকের অতিরিক্ত অর্থ অন্য ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের আকারে রাখতে বাধ্য হচ্ছে যা ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অতি সত্তর ইসলামী মানি মার্কেট প্রণয়ন করাটা একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। এই সেক্টরে দক্ষ লোকবলের অভাব ছিল আর সেক্টরটার দ্রুত বৃদ্ধির কারণে এই অভাব এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাই প্রচুর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লোকবল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়াটাও জরুরী।
সম্ভাবনাঃ ইতোমধ্যে এ দেশের সকলেই বুঝে গেছেন এই ব্যাংকিং সেক্টরের সম্ভাবনা প্রচুর। বিশাল আমানত যেহেতু আছে তাই এর সঠিক বিনিয়োগও সম্ভব। দেশটা উন্নয়নশীল তাই প্রচুর ক্ষেত্র রয়েছে যাতে বিনিয়োগ করলে মুনাফার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক সুকুক প্রচলন করলে এই সেক্টরে প্রচুর সম্ভাবনাময় প্রডাক্ট চালু করা সম্ভব হবে। ব্যাংকের শরীয়া কাউন্সিল গুল আর কার্যকরী হলে জনমনে এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে সকল সন্দেহর অবসান হবে ও জনগণ অধিক আস্থার সাথে তাদের আমানত সুদ মুক্ত ভাবে সংরক্ষণ করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। দেশের সর্বত্র এই ব্যাংকিং সেবার সুযোগ করে দিলে জনগণ উপক্রিত হবে। সরকারী ব্যাংক গুলর মধ্যে সোনালী এবং রূপালী ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো আছে। সরকার বিশেষায়িত ব্যাংক এর মত শুধুমাত্র ইসলামী ব্যাংকিং এর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক চালু করার উদ্যোগ নিতে পারেন। পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট এর কল্যাণ ব্যাংক নতুন চালু হল, এই ব্যাংকটিকে শুরু থেকেই পূর্ণাঙ্গ ইসলামী মডেলে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দিতে পারত। সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা এই যে, ইসলামী ব্যাংকিং সরাসরি ব্যবসায় অংশ গ্রহণ করতে পারে যা কনভেনশনাল ব্যাংক পারে না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন ইসলামী ব্যাংকিং প্রডাক্ট চালু করলে দেশের অর্থনীতিতে তা বিশাল অবদান রাখার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি দেশের জনসাধারণও এর বিপুল সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। অনেকের ধারনা ইসলামী ব্যাংকিং কেবলমাত্র জনকল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারে আর তার ব্যবসা সফল হওয়াটা জরুরী নয়। যেহেতু ইসলামী ব্যাংক বছরান্তে তার অব্যবহৃত অতিরিক্ত আমানতের উপর জাকাত প্রদান করে কিংবা ব্যবসায়ীক লেনদেনে সমতা আনার উদ্দেশ্যে কখনও কখনও এহসান করে কিংবা অতিরিক্ত অর্থ জনকল্যাণে স্কুল কিংবা হাসপাতাল এর জন্য ব্যয় করে তাই এরূপ ধারণা অনেকের মধ্যেই রয়েছে। প্রকৃত বিষয়টি হলো যেহেতু এটি ব্যাংক আর ব্যাংক মানেই সে ব্যবসা করবে, তাই শুধু জন কল্যাণের জন্যই নয় তার নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনেও তাকে মুনাফা অর্জন করতে হবে। তাই মনে রাখতে হবে ইসলামী ব্যাংক কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয় যদিও এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা জন কল্যাণকে আমলে এনেই পরিচালিত হয়।
ঝুঁকিঃ সব চেয়ে বড় ঝুঁকি হল যদি কোন অসাধু ব্যাংকার ইসলামের নাম ব্যবহার করে শরীয়ার তোয়াক্কা না করে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে। এরূপ অসাধুতা কনভেনশনাল ব্যাংকিং এও হতে পারে যখন তারা ব্যাংকিং নীতিমালার ভঙ্গ করে। সঠিক তদারকি ও অডিট ম্যাকানিজম থাকলে এ সব ঝুঁকি প্রতিহত করা যায়। সরল মনের গ্রাহকেরা তাদের টাকা কোন খাতে ব্যবহার হবে তা জানে না যদি না সুকুকের মত ভাল প্রডাক্ট বাজারে আসে, তাছাড়া গ্রাহক গণ সব ক্ষেত্রেই সুদ মুক্ত থাকবে কারণ তাঁরা সুদ মুক্ত চুক্তিতে ব্যাংকের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। ব্যাংকার গণ মূলত দায়িত্বে থাকে টাকাটা যাতে সুদ মুক্ত ভাবে বিনিয়োগ কৃত হয়। অর্জিত মুনাফা যাতে সঠিক ভাবে বণ্টন করা হয়। দ্বিতীয় ঝুঁকিটা হল মানি মার্কেট কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ ঝুঁকি, মানে হল যদি কোন শক্ত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ না থাকে তবে সব ক্ষেত্রেই যা খুশি তাই করার প্রবণতা থাকে তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি আরো জোরদার করা প্রয়োজন। নিয়মিত অডিট হলে এ সকল ঝুঁকি মোকাবেলা করাও সহজ হবে। অর্থনৈতিক লেনদেনে যাতে সুদ সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে একজন ইসলামী ব্যাংকার সর্বদা সতর্ক থাকে তার পরও যদি কোন ভুলের কারণে সুদ সৃষ্টি হয়ে যায় তার দায়ভার সম্পূর্ণভাবে ব্যাংকের উপর বর্তাবে আর গ্রাহক সম্পূর্ণ রূপে সুদের দায়ভার থেকে বেচে যাবে। এই সরল হিসাবটি মনে রাখলে একটি ইসলামী ব্যাংক কখনই সুদী কিংবা হারাম দ্রব্যর ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ করবে না। এটাই স্বাভাবিক ভাবে ধরে নেয়া হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে এই হারাম দ্রব্যর ব্যবসা করা যেমন মদ, জুয়া, নেশা দ্রব্য এসব খাতে ইসলামী ফান্ড বিনিয়োগ করা যায় না। এমনকি যে প্রতিষ্ঠান এই সব ব্যবসা করে তার সহযোগী কোন খাত বা পরিবহন খাতেও লগ্নি করা শরীয়া সম্মত নয়। ইসলামী ব্যাংকের টাকা সমাজের জন্য ক্ষতিকর যে কোন বিষয়ে ব্যবহার করা যাবে না। সেকেন্ডারি শেয়ার মার্কেট কিংবা লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার ক্রয় বিক্রয়ও ইসলামের স্কুল অব থট্স এ যথাযথ নয়। এই সব সূক্ষ্ম বিষয় গুল মাথায় রেখে ইসলামী ব্যাংকিং প্রডাক্ট গুল প্রণয়ন করা হয়। যদি এর ব্যত্যয় হয় তবে তা শরীয়া অডিটে অবশ্যই ধরা পড়বে।
আপডেট হিস্ট্রি: প্রস্তাবিত ১৪অক্টোবর২০২০> ৮ডিসেম্বর২০২০> ২৮ডিসেম্বর২০২০> ১২জানু২০২১>২১জানু২০২১> ৫ফেব্রুয়ারী২০২১> ৮ফেব্রুয়ারী২০২১>
Amazing brother. 💜👍
ReplyDelete