আমি সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ নই, সাধারণ সঙ্গীত স্রোতার দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে লিখছি, গান যারা গাইতে পারেন তারা না হয় পুর মজাটাই পান কিন্তু যারা স্রোতা তারাও কম বেশী মজা পান বলেই শুনেন। অনেক সময়ই গানের কথার শব্দ গুলো ভুলে যাই, মন খেলা করতে চায় প্রতিশব্দ নিয়ে, কিন্তু সুরটা মনে গেঁথে থাকে, প্রতিধ্বণীত হতে থাকে অহরহ। বহুদিন পরও গানের সুরটা স্মৃতির পাতা থেকে ঠিকই ধরতে পারে। সেই ছোট বেলায় বাবা যখন রেডিওতে বাংলাদেশ বেতার প্রচারিত প্রভাতি অনুষ্ঠানের খবর ও গান শুনতেন তখনকার সেই গানে আমার ঘুম ভাংত, তখন থেকেই গানের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মে। সেই সময়কার গান গুল এখন শুনলেও মনটা আবার শৈশবে ফেরত চলে যায়। কয়েক বছর আগে ডা.সাঈদ ভাইকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম গান শোনাকে বা গাওয়াকে ধর্মে বারণ করা হয়েছে কেন, উত্তরে তিনি বলেছিলেন গান খুব শক্তিশালী একটি মাধ্যম, তিনি একবার ট্রেনে যাওয়ার সময় দেখেছেন একজন সেই ট্রেনের প্রচণ্ড শব্দের মধ্যেও দোতারা হাতে গান গেয়ে যাচ্ছে। গান মানুষের মনকে প্রশান্ত করে, শুধু তাই নয় গান মানুষের মনের কথাগুলো বলে। ’মায়াবন বিহারীনি হরিণী, গহন স্বপন সঞ্চারিণী, কেন তারে ধরিবারে করি পণ, অকারণ’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এবং জাতীয় কবি দুখু মিয়া ওরফে কাজী নজরুল ইসলামের প্রত্যেকটা রচনাই, তা কবিতা বা গান হোক, নাটক হোক, গীতিকাব্য, গীতিনাট্য কিংবা প্রবন্ধ হোক সবখানেই প্রমাণ পাওয়া যায় কতটা গভীর তন্ময়তা, তমসাচ্ছন্নতা তাঁদের সৃষ্টিশীলতায় গ্রন্থিত হয়ে আছে। তাদের সৃষ্টি শুখের উল্লাসে। যা আজ সকল বাঙ্গালী প্রাণে অনুরণিত প্রতিধ্বনিত হয়ে অনন্তে বহমান আছে। ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনটি মাত্র আরটিক্যাল ভাষা ও শব্দ সম্পর্কে আমার ধারণা আমূল পাল্টে দেয়, (এক) ক্লাস ফাইভের পাঠ্য পুস্তকের রবীন্দ্রনাথের ভাসা ও ছন্দ কবিতা, (দুই) তৎকালীন ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত “শব্দের অপ্সরী” প্রবন্ধর সমালোচনা এবং (তিন) তখনকার ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকের জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান নানা’র, নানা বলছি কারণ আমার খালার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শারেকা আন্টির মামা ছিলেন উনি “কবিতার কথা” প্রবন্ধে তন্ময়তার ধারনার উদাহরণ। শব্দের ভারত্ব ও ব্যবহার গুরুত্ব আর যথার্থতা এ সব নিয়ে তখন থেকেই ভাবতাম, শব্দের সামান্য তারতম্যে পুর বক্তব্যর ভাব, অর্থ, উদ্দেশ্য সব বদলে যায়। এরপর ২০০২ হতে ২০০৩ সালে ধানমন্ডি টেকনোকিড্সে আমার বস দেলোয়ার ভাই এর বহু-চিন্তা করে কথা বলার ধরণ আর ২০০৪ সালে সোনালী ব্যাংকের এমডিস স্কোয়াডে দপ্তর ভাষ্য (অফিস নোট) টাইপ করার সময় এর বহুবার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ইত্যাদি দেখে শব্দর গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণার আর উন্নয়ন হয়। মনের ভাব প্রকাশে শব্দ বা শব্দ গুচ্ছ যথেষ্ট নয় তাই তাতে সুর তাল লয় যোগ করে গান রচনা করা হয় যেন তা মনের তন্ময়তার সঠিক ভাবটা প্রকাশ করতে পারে।
যারা গান রচনা করেন, সুর করেন ও গান গান তদের এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। কার কার সুর সহ পুর গানের কথাই মুখস্থ হয়ে যায়, কেউ কেউ ছড়া কাটে, তাদের মনে শব্দের ঝর্না ঝড়ে ড়ে। কি আর করা, আমার মনে শুধু সুরটা ভাল লাগে আর গানে তবলার তাল, তা যদি ঢোল হয় তবে তো কথাই নাই, “একে তো কই মাছ তার উপর আবার রানছে” অবস্থা হয়। ক্লাস ৭ কি ৮ এ রনি আমার স্কুলের বন্ধু সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে ভোর সকালে গলা সাধত। আমাকে বলত, তুই গান জানিস না, মানে হল তুই আনন্দময় বিশ্বের অর্ধেকটা থেকেই বঞ্চিত। সেই নৌকার মাঝি আর শিক্ষিত যাত্রীর মধ্যকার তর্ক মনে পড়ে যেত, মাঝিটি বহু কিছু সম্পর্কেই অজ্ঞ তাই তার জীবনের ৮ আনা, কখনো ১২ আনা ইত্যাদি বিভিন্ন অনুপাতে বৃথা বলছিল শিক্ষিত যাত্রী কিন্তু যখন ঝড় উঠল বাতাসে তখন শিক্ষিত যাত্রীটি সাতার জানত না, তাই ঝড়ে পড়ে মারা গেলে তার জীবনের ১৬ আনাই বৃথা। জীবনে চলার পথে কার কতখানি সার্থকতা তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞর পক্ষেও হিসাব করে বের করা সম্ভব নয়। এটা মারাত্মক রকম আপেক্ষিক ও প্রেক্ষিত নির্ভর একটা অংক যার সমাধান এত সহজ নয়। যারা গান শুনে না কিংবা গান বুঝে না তাদের জীবনের ১৬ আনাই বৃথা এ কথা বলা যাবে না তবে ৫ কিংবা ৮ আনা যে বৃথা তা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। মন যখন তন্ময় হয় বা তন্ময়তাকে খুঁজে তখন তা গানের মধ্যেই আন্ত-প্রকাশ ঘটায় কিংবা গানের মধ্যেই অবগাহন করতে চায়। তাই সঙ্গীত বা গানকে হেলা ফেলা করার উপায় কোথায়?
ইদানীং কিছু কিছু গান তাক লাগায়ে দেয়ার মত মনে হয়েছে, কয়েকটার কথা উল্লেখ করি, গান বিশেষজ্ঞ নই তাই গায়ক বা গায়িকা, সুরকার এর নাম বলতে পারব না, তবে প্রথম লাইনগুলি অনেককে হয়ত পুর গানটা মনে করায়ে দিবে। যেমন, প্রজাপতি টা, দেখছ কি তাকে, এক পায়ে নূপুর আমার, ছেড়ে দে ছেড়ে দে ছেড়ে দে ছোকরা ঝেড়ে বাধি চুল! কণার জ্যামিতিক ভালবাসা আর বর্ষা, সামিনা চৌধুরী আর বাপ্পা মজুমদারের আকাশ খুলে বসে আছি, তাও কেন দেখছ না, শিরোনামহীনের খোলা জানালা ইত্যাদি এরকম আর বেশ কয়েকটা গান অভূত পূর্ব ও অপূর্ব ভাব ধারার গান কিন্তু এ তো হাতে গোনা কয়েকটা দারুণ দারুণ গান, আজকালকার এফ এম রেডিও তে শুনা প্রচুর অখাদ্য টাইপ গান আছে যা শুনলে গানের প্রতি ভক্তি উঠে যায়। এ রকম একটা গান হল তিন পুরুষ এবং এ রকম অখাদ্য গান আর অনেক আছে যে গুল শুনার সাথে সাথে কান থেকে যত দ্রুত সম্ভব ডিলিট করে ফেলাই ভাল।
জনপ্রিয় ব্যান্ড গায়ক আইউব বাচ্চু এক টিভি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ”কথাই তো গান”, তখনই আমার মনে খটকা লেগেছিল, উনি এটা কি বললেন? কথাই যদি গান হয় তা হলে তো গান মানে যা খুশি তাই। তা কি করে হয়? সকল কথাই কি গান হতে পারে? কথার মধ্যে যতক্ষণ না তন্ময়তা প্রকাশ পাবে, যতক্ষণ না মনের মাধুরী মিশবে ততক্ষণ তা গদ্য, এমনকি তা পদ্যও না। গদ্য কবিতা পরা বাস্তবতার উপর লেখা হয় তাই তা অন্য ধাঁরা, কিন্তু যে কথা গদ্যও হল না পদ্য তো দুরের কথা তাকে গান বলা যায় কোন বিবেচনায়? পদ্য কে সুর ও ছন্দে প্লট করলে তবেই না তা গনে বা সঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। আজ কালকার ছোকরারা ব্যান্ড গাতক দল বানায়ে এত সব বুঝে গান বাধে বলে মনে হয় না। কালজয়ী সঙ্গীত এর সুর এদের কাছ থেকে আশা করতে ভয় লাগে। তবে তারা ইমপ্রুভাইজ করছে। পল্লিগীতি, লালন গীতি হিন্দি-বাংলা মিশায়ে নানা ফিউশনও ঘটাচ্ছে যে গুল বুঝা আমার সাধ্যের বাইরে।
প্রেমের দুর্বোধ্য আকর্ষণে এক অন্তহীন পথের যাত্রী প্রেমিকা। তার দৃঢ় বিশ্বাস, দুর্গম পথের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রেমিকের সন্ধান একদিন সে ঠিকই পাবে। প্রেমিক-মনের বন্ধ দুয়ার খুলে এক আলোকিত ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় সে উচ্ছ্বসিত। এমনই এক প্রেমিকার গল্প নিয়ে আরতি মুখার্জী'র গান ‘হারিয়ে যেতে যেতে’à কন্ঠঃ প্রিয়াংকা বিশ্বাস মূল শিল্পীঃ আরতি মুখার্জী কথা ও সুরঃ সুধীন দাশগুপ্ত ছায়াছবিঃ কখনো মেঘ (১৯৬৮) মিউজিক রিঅ্যারেঞ্জমেন্টঃ পার্থ বডুয়া প্রোডাকশনঃ ফোর্টিনাইন ব্লু এজেন্সিঃ ক্রিয়েটো Seylon Music Lounge [https://youtu.be/FMx|BT8Ejn0]
উপরের এই গানটা নিয়ে আমার একটা স্মৃতি আছে, ২০১২ সালে ফার্মগেট মার্কেটের নীচ দিয়ে হেটে যাচ্ছি, হঠাৎ উঁচু ভলিউমে হেমন্তর এই গানটা বেজে উঠল শ্রীকান্তর কণ্ঠে, শোন কোন এক দিন ----- মন হারাল হারাল, হারাল, মন হারাল --- শুনে আমার মনটাও হরায়ে যাওয়ার উপক্রম হল। গানটা আমার চাই-ই–চাই, আবার শুনব, কিন্তু দোকান পর্যন্ত পৌছাতে না পৌছাতে গানটা বন্ধ হয়ে গেছে। কোন দোকান তা’ও ধরতে পারছিলাম না আর দোকানদারকে বুঝাতেই পারলাম না কোন গানটা চাচ্ছি। যা হোক পরে এক সময় ঠিকই পেলাম গানটা আর যত বার শুনি ততবারই মন হারায় যায়। সুর আর আবেগের যে সংমিশ্রণ ঘটেছে গানটায় তা আমার অবচেতনের কোন একটা টিউনের সাথে হুবহু মিলে যায় বলেই মনে হয় এরকম বার বার মন হারায়।
স্বপ্নের তুলিতে আঁকা প্রেয়সীর সাথে হঠাৎ বাস্তবে দেখা হওয়ায়—প্রেমিকের অবিশ্বাস-বিস্ময়-মুগ্ধতা মেশানো এক অনুভূতি। প্রেমিকার দৃষ্টির গভীরতা, সাজ-সজ্জার সৃজনশীলতা, অব্যক্ত অনুভূতির নাটকীয়তা প্রেমিক-মনকে চঞ্চল করে। প্রেমিকের আনন্দের উচ্ছ্বাস আর সুরের মূর্ছনা যেন সংক্রমিত হয় প্রকৃতিতেও। এমনই এক প্রেমিকের সারল্য মাখা অনুভূতি—শ্যামল মিত্রের ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন’গানে। à কন্ঠঃ মিফতাহ্ জামান মূল শিল্পীঃ শ্যামল মিত্র কথাঃ গৌরী প্রসন্ন মজুমদার সুরঃ শ্যামল মিত্র ছায়াছবিঃ দেয়া নেয়া (১৯৬৩) Seylon Music Lounge [https://youtu.be/PbsVZNoa4O0]
গহন ঘন ছাইল গগণ ঘনাইয়া,
স্তিমিত দশ দিশি, স্তম্ভিত কানন,
সব চরাচর আকুল, কি হবে? কে জানে?
ভোরা রজনী বিক ললনা ভয় বিভলা গহন ঘন ছাইল গগণ ঘনাইয়া,
চমকে চমকে সহসা দিক উজলী, চকিতে চকিতে মাতিছ তিল বিজলি
থরহর চরাচর পলকে ঝলকিয়া ঘোড় তিমিরে ছায় গগণ মেদিনী
গুরু গুরু নীরদ গরজনে স্তব্ধ আধার ঘুমাইছে
সহসা উঠিল জেগে প্রচণ্ড সমীরণ, কড় কড় বাজ।।
আজকালকার ছেলে ছোকরাদের কাছে এ গানটা হিব্রু ভাষায় রচনা করা হয়েছে বলেও মনে হতে পারে তবে যারা সত্যিকারের বাঙ্গালী তারা নিশ্চয়ই বুঝেছেন ঝড়ের আগের প্রকৃতিতে যে অভূতপূর্ব অবস্থা বিরাজ করে তার চমৎকার চিত্রায়ন এই কটা মাত্র লাইনে। অনেক আগে কম্পিউটার তখন নতুন এই দেশে, এক প্রোগ্রামারকে বলতে শুনেছিলাম মাত্র ১৫ লাইনের প্রোগ্রাম লিখে দিলাম, এর দাম ৫০ হাজার টাকা। উপরের মাত্র সাত লাইনের গানের কথা কিন্তু এর দাম মনে হয় না কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে মাপা যাবে। সাহিত্যর মূল্য ইলেকট্রনিক টাকা কিংবা বিট কয়েনেও মাপা যাবে বলে মনে হয় না। এটা মাপার জন্য চাই সেই মানের বড় মাপের মন।
শুভ মিতার গান গুল মনে দাগ কেটে গেছে। তবে ওই গান গুল আবার শুনতে ভয় লাগে। অনেক পুরাণ স্মৃতি মনে পরে যায়। তার কিছু সুখের, কিছু অভিমানের, কিছু বিভ্রান্তিকর অনুভূতির জন্ম দেয়া অতীত। তাহসানের গানগুলো ভাল লাগছিল বটে তবে তা যেন সেই ধারাটা নয় বরং আধুনিক অন্য রকম একটা ধারা, আর তাঁর গান গুল তারই মুখেই মানায় ভাল। তন্ময়তা আছে তবে একপেশে তন্ময়তা যেন, সবার মন ছুঁয়ে যাওয়া তন্ময়তা নয়। শ্রীকান্তর গান গুলর কথা-বাজনা-সুর এক কথায় কমপোজিশান খুব ভাল লাগে। শ্রীকান্তর নীল ধ্রুব তারা এ্যালবামের ৬ নং ট্র্যাক এর কথামালা এরকমঃ-
এটা কাব্য তার পর গান। কাব্য না হয়ে যদি সরাসরি গান বানান হয় তবে তা অখাদ্য থুড়ি অশ্রাব্য কিবাং শ্রুতিমধুরতা বিহীন সঙ্গীতে পরিণত হতে বাধ্য। আগে কাব্য তার পর গীতি কাব্য এটা এই প্লাস্টিক/কনক্রিট প্রজন্মর কতিপয় গাতক মনে হয় ভুলে গেছেন বা তাদের গুরুজন তা তাদের বলতে ভুলে গেছেন। বিষয়টা তো এমনি এমনিই বুঝার কথা, আলাদা করে বলার প্রয়োজন কই। শ্রীকান্তর ’স্বপ্ন দেখাও তুমি’ এ্যালবামের ৫ম ট্র্যাক একা একা’র কথামালাঃ-
কয়েকটা অবিস্মরণীয় ভক্তিমূলক গান এর কথা না বললেই নয়। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেই তো তোমার আলো
আর “আনন্দ লোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজ সত্য সুন্দর” যদিও এগুল বন্দনা সঙ্গীত নামে পরিচিত, তার পরও বলব গান গুলর কথা, ছন্দ আর ভাব সব মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করে তা সে বন্দনার উদ্দেশ্যেই শুনুক আর এমনি এমনি শুনুক।
স্টয়িক ব্লিস এর বাংলা হিপ হপ গান গুল ভালই লেগেছিল কিন্তু সে গুল নাই হয়ে গেল হঠাত করেই যেন রবীন্দ্রনাথের কণিকার স্ফুলিঙ্গ, তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ, উরে গিয়ে ফুরিয়ে গেল সেই তা’রি আনন্দ। ফুয়াদ ফিচারিং আনিলার পঞ্জাবীওয়ালা আর মিলার বাবু রাম সাপুড়ে গান গুলর কম্পোজিশন খুব ভাল ছিল কিন্তু ওগুলো লোকজন শুনে হজম করে ফেলেছে। গান গুল তাই সময়ের সাথে সাথে বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে কালের গহ্বরে। গান গুল কয়েকবার শুনলে পরে আর শুনতে মন চায় না। ছোটবেলায় আমার নানী ছোলার হালুয়া পাঠায়ে ছিল আমার জন্য, আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কেমন লেগেছে, উত্তরে বলেছিলাম একবার খেলে আবার খেতে ইচ্ছা করে। এই গান গুল কিছু দিন শুনার পর আর শুনতে ইচ্ছা করে না, যার মানে হল এগোল গাজরের হালুয়া, ছোলার হালুয়া হয় নাই। আযম খান, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মিলা, ফুয়াদ এরা যে গানের ধারা গুল দিল তা কিভাবে বাঙ্গালী প্রাণের মূল ধারা হয় বুঝি না। পল্লীগীতি, লালনগীতি, হাসন রাজার গান এগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধারা কিন্তু আধুনিক বাংলা গানের সেই ধারা নয়। শাকিলা জাফর, সুবীর নন্দী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন এদের প্রকাশিত গানগুলও সময়ের সীমানা পেরতে পারেনি বলে আমি মনে করি। মান্না দে কিংবা হেমন্তর মত কিংবদন্তীর গান, তাঁদের সেই গানে স্বপ্ন যদি আনে আঁখি পল্লব ছায় ধারার গান উনারা দিতে পারেন নাই একদমই। “বুকটা ফাইটা যায়” এর গায়িকা যার নাম গিনিস বুকস অব রেকর্ডস এ উঠেছে বলে শুনেছি। সর্বাধিক সংখ্যক গান প্রকাশের তালিকায় সবার উপরে থাকার কারণে। উনি প্রমাণ করেছেন পরিমাণ বৃদ্ধি করলেই মান বাড়ে না বরং কমে। উনার গান গুল এক শ্রেণীর গ্রামের মানুষের খুবই প্রিয় হতে পারে কিন্তু বাংলা আধুনিক গানের সেই ধারা নয় মোটেও।
মোজার্ট ৩৫ বছরের জীবনে যা দিয়ে গেছে ইউরোপের সঙ্গীতে তারই প্রতিধ্বনি শুনা যায় ওখানকার সকল গান বাজনায় আজও। আমাদের গান বাজনায় রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি কেন শোনা যায় না বুঝি না। হুবহু না হোক ওই সুর গুল তো প্রতিধ্বনিত হবে। আজকালকার কপি-পেস্ট জেনারেশন কি আমাদের অতীত ঐতিহ্যর মূল্য হারায়ে বসে আছে? কত গুল গান অনন্ত কালের ভিসা নিয়ে জন্মেছে, যেমন- ধিতাং ধিতাং বোল-এ, মাদলে তাল তুলে কিংবা রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে। কিছু দিন আগে সুমন চট্টোপাধ্যায় এর ’তোমাকে চাই’, অঞ্জন দত্তর ’রঞ্জনা, আমি আর আসব না’ আর নচিকেতার ’নীলাঞ্জনা’ তিনটি নতুন গানের ধারা উপহার দিয়ে গেছেন তবে ভূপেন হাজারিকার ‘জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’ গান গুল যেমন অন্য কার মুখে মানায় না তেমনি এদের গানগুলো যেন কপি রাইট মৌলিক ধারা। মান্না দে, আর ডি বড়মন এঁদের গনের ধাঁরা গুলোও মৌলিক। আমি মৌলিক ধারার গানের কথা বলছি না, সেই আধুনিক বাংলা গানের ধারার কথা বলছি যা’র মধ্যে ১৬ আনাই বাঙ্গালীত্ব প্রকাশ পায়। ইদানীং কালের সঙ্গীত গুলতে সেই ধারাটা ধরা পরছে না বা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর পেছনের কারণ গুল কি হতে পারে?
আমার যা মনে হয় তা হলো, পুরাতন কালজয়ী গানগুলির সবই প্রায় ছায়াছবির জন্য নির্মিত, শুধু গানের জন্য গান করা নয়। গান গুলর পিছনে টাকা খরচ হয়েছে বা গান গুল বিক্রি হয়েছে উচ্চ মূল্যে। টাকার মূল্যে কেনায় গান গুলর মানও উন্নত হয়েছে। ছায়াছবির জন্য নির্মিত বলে তাকে জনমনে গ্রহণযোগ্য করার জন্য বহু শ্রমও ব্যয় করা হয়েছে। যেমন “পৃথিবী বদলে গেছে, তুমি, আমি একই আছি, দুজনে যা ছিলাম আগে”, “পিচ ঢালা এই পথ টারে ভালবেসেছি”, “পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি, চেনা পথের ধারায় আমি অনেক হেঁটেছি”, এই পথ যদি না শেষ হয়? তবে কেমন হবে?” এখনকার ছায়া ছবিগুল সেই মানের হয় না তাই তার গান গুলর মানেরও যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়ে গেছে। আর হিন্দি গানের অনুকরণ করার একটা প্রচ্ছন্ন চেষ্টা মনে হয় আছে ছায়াছবি নির্মাতাদের তাই বাংলা গানের আদি অকৃত্রিম ধারাটার প্রতি তাদের নজর নাই মনে হয়।
আরেকটি কারণ হতে পারে এখনকার হ য ব র ল গান গুল সরাসরি কথা বলে, যেমন তোমায় আমার ভাল লেগেছে তাই ধেই ধেই করে নাচছি আর গান গাইছি এই টাইপের কথা বেশী। সরাসরি বলায় তা মনের তন্ময়তাকে হারায়ে সাহিত্যের মূল্যমান হারায়ে ফেলে। ”আলগা কর গো খোপার বাধন, মন ওহি মেরা ফাঁস গায়ি” নজরুলের এই গানটায় একটা প্রেক্ষিত এর উপর কতটা তন্ময়তা দিয়ে সেই প্রেমের কথাই বলা হচ্ছে। একে যদি বলা হয় ‘ওই ছেমরি তোর খোপা খোল মনটারে খুঁজে দেখি’, তবে কি তা সাহিত্য হয়? তার চেয়ে বরং যদি বলা হয় “ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে ছোকরা, ঝেড়ে বাধি চুল” তা হলে তা মনের কথা প্রাণের কথা হয়ে যায়। যারা মনের-কথা আর কথার-কথার পার্থক্য ধরতে পারে না তারা হয় কনক্রিটের মানুষ না হয় প্লাস্টিকের মানুষ আর এই যান্ত্রিকতার যুগে এদের সংখ্যাই দিন দিন বাড়ছে। তাই আমিরা বাঈ এর ’ঝাকানাকা, ঝাকানাকা, দেহ ঝুঁকা না’ গান গুলই জনপ্রিয়তা পাবে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নাই।
ব্যবসায়িক শিক্ষায় বলা হয় বাজারে চাহিদা আছে তো প্রোডাক্ট বা পণ্য আছে। চাহিদা যে রকম পণ্যও সেরকম ভাবে বদলে যেতে বাধ্য। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে কারণ হিসেবে বলা হয় রাশিয়া ঠিকই ছিল কিন্তু মানুষ গুলর মধ্য থেকে কমিউনিজম প্রিয়তা হারায়ে গিয়েছিল অর্থাৎ সেই মানুষ-গুল হারায়ে গিয়েছিল যারা সোভিয়েত রাশিয়া চাইত। সেই সূত্র ধরে বলতে চাই, গানগুলো বদলে যাচ্ছে কারণ মানুষ-গুল বদলাচ্ছে। সময়ের সাথে বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু তার মানে কি এই, যা খুশি তাই বাজনার তালে তালে বাজাব আর তাকে গান বলে বাহবা দিব? যে গান এ কান ও কান হয়ে বের হয়ে যায় তা কি সঙ্গীত হতে পারে? গান এক কান দিয়ে প্রবেশ করে মনটাকে নাড়া দিয়ে অন্য কান দিয়ে বের হলেই না তবে সার্থক হয়। তাই বলি যে গান মনের ভিতর দিয়ে না যায় সেটা গানই না।
যা হোক আমার মত সঙ্গীতে অজ্ঞ সঙ্গীতজ্ঞ লোকের এত বড় বড় কথা বলা সাজে না। যার যা খুশি বাজনা বাজাক আর কথা মালা সাজায়ে গান বানাক আর হ য ব র ল শুনুক কিংবা হুলা হুপ নাচুক তাতে এমন কি যায় আসে। ’দেখেছ কি তাকে’ গানটা যখন প্রথম এফ এম রেডিওতে শুনলাম তখন আমি একটা সিএনজি ট্যাক্সিতে অফিস যাচ্ছি। গানটা শুনে এতটাই তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম যে, ট্যাক্সিটা তার গন্তব্য পার হয়ে গেলেও ওটাকে থামতে বলি নাই গানটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। সেই আধুনিক বাংলা গানের ধারাটা আবার ফিরে আসুক এই প্রত্যাশা নতুন প্রজন্মর কাছে।
লেখাটার উপর আমার বক্তব্য আছে https://youtu.be/C1SwJ4YxBsI
আপডেট হিস্ট্রি: ১৮নভেম্বর২০১৯> ২৬জানু২০২১>২৯জানু২০২১> ০১ফেব্রুয়ারী২০২১> ৬ফেব্রুফারী ২০২৪ >
Mind blowing brother.💙
ReplyDelete