আমার বাবা (শেখ মোহাম্মদ আব্দুর রহিম) কে নিয়ে পারিবারিক গ্রুপে লিখার কথা মনে হলো বাবার একটা ছবি দেখে। অফিসে কাজ চলাকালীন আমি কম্পিউটারের একটা সাইড-উইন্ডোতে পছন্দের ছবিগুলোর স্লাইড শো চালায়ে রাখি, তাতে মনটা ভালো থাকে। বাবার ছবি হঠাৎ চলে আসায় মনে হলো বাবা সম্পর্কে তো আমি লিখতে পারি, আমার পরিবারের অন্যরা তো আমার বাবাকে তেমন করে কিংবা আমার মত করে চিনে না। সবাইকে তাই আমার বাবা সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্যই এই লেখাটা শুরু করি। তাঁর স্মৃতি আমার মনে এত বেশি যে কত গুলো পাতায় শেষ করতে পারবো জানি না তবে সবাই যাতে বিরক্ত না হয় তাই সংক্ষিপ্ত আকারেই বক্তব্য গুলো লিখে রাখবো।
আমার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আমার বাবা, মাত্র ৪৮ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান ১৯৯০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর। আমার জীবনে পুর পৃথিবীটা টাল মাটাল হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সেদিনের কথা মানে ১৪ ও ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৯০ এর কথা লিখলে তা বিষাদময় একটা কাহিনী হয়ে যাবে তাই ওদিকটাতে যাবো না। ওই স্মৃতি মনের অনেক গভীরে চাপা দুঃখ তাই ওটাকে আর না বলি এখানে, হয়তো অন্য কোন লেখায় সবিস্তারে বলবো। আমি বাবা মার একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমাকে ছোট বেলা থেকে মানুষিক ভাবে তৈরি করা হয়েছিল যদি তারা না থাকে তখন যাতে আমি দৃঢ় পদে সব দিক সামলাতে পারি। বাবা মারা যাওযার পর আমি অসম্ভব গম্ভীর হয়ে পরের কাজ গুলো করেছি কিন্তু বাবাকে কবরে নামায়ে দিয়ে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম এই ভেবে যে আর কোন দিন বাবার সাথে কথা বলতে পারবো না। বড়মামা ও রুহুল চাচা বাসায় ছিলেন, তারা আমাকে সামলেছিলেন। কিন্তু তার বেশ কয়েকদিন পর বাবার রেখে যাওয়া কাপড়ে তার ঘামের গন্ধ পেয়ে তাকে কাছে পাওয়ার জন্য যে আকুলতা তা প্রশমিত না করতে পেরে নিজের ঘরে গভীর রাতে হাউমাউ করে কেঁদেছি প্রায় দেড় ঘণ্টা। মার ঘর দুরে ছিল বলে মা তা জানতে পারেনি । বাবার স্মৃতি তাই মনে করতে ভয় লাগে যে নিজেকে হয়তো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না তাই লিখতেও ভয় লাগে। বাবাকে আমি আজও প্রত্যাশা করি, তিনি মরে গেছেন এটা মন মানতে চায় না, মনে হয় কোন না কোন এক সময় আমি ঠিকই আবার তার দেখা পাবো। সারাক্ষণ তার স্মৃতি আমার মনে জাগরূক আছে একদম তর তাজা । আমার জীবনে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তি কখনই ছিল না আর কখনই তার মত মানুষ আমি আর পাবো না, তবে ছোট্ট মুসাবকে কোলে নিলে মনে কিছুটা প্রশান্তি পেতাম পিতা হারানোর দুঃখ লাঘব করার ক্ষেত্রে।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বাবা আমাকে তার শরীরের ভাজে ঘনিষ্ঠ করে নিয়ে ঘুমাতো আর আমিও পরম শান্তিতে ঘুমায়ে যেতাম। আমি নিজেকে বাবার মানবিক ও শারীরিক একটা অংশর মত ভাবতাম তাই যখন সে নাই হয়ে গেল তখন মনে হলো পুর পৃথিবীর অর্ধেকটা অর্থহীন হয়ে গেছে। বাকি অর্ধেকটা ছিল যেহেতু মা বেচে ছিলেন ওই সময়।
সেই ছোট্ট বেলায় বাবার হাত ধরে মোবারকগঞ্জ সুগারমিল দেখতে যেতাম, বাবা ওখানকার চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিল, সময়কালটা ১৯৭৫ হবে। একবার বাবার সাথে আখ আনার ট্রাকটার গুলোর খালি ওজন ও আখ ভড়া ওজন মাপার দৃশ্য, কনভেয়ার বেল্টে আখের বয়লারের দিকে নিয়ে যাওয়া আর বয়লার গুলো দেখে যখন নিচে আসলাম তখন দেখলাম একটা বড় নলের মাধ্যমে চিনি আসছে আর একটা লোক বস্তা বস্তা চিনি দ্রুত ভরে বস্তার মুখ সেলাই করে বন্ধ করে দিচ্ছে। ঠিক ওই সময় চারদিকে একটা হইচই শোনা গেল, বাবা আমার হাত তার এক কলিগকে ধরায়ে দিয়ে সাইরেন রুমের দিকে গেলেন। কে যেন আখের ছোবড়ায় জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা ফেলে আগুন ধরায়ে দিয়েছে আর তার সতর্কতায় সাইরেন। আমি বাবাকে বলতে চেয়েছিলাম আমি দেখেছি কে ফেলেছে কিন্তু আমি এতটাই ছোট ছিলাম তখন ৪ কি ৫ বছর বয়স যে আব্বা গুরুত্ব দেন নাই।
ছবিঃ লিবিয়ার তবরুখ শহরে প্রবেশ পথের পার্কে বাবা, মা ও আমি।
সময়কালঃ ১৯৮০
বাবা উচ্চাভিলাষী ছিলেন, তাই চিনির মিল গুলো তখন লাভজনক অবস্থায় থাকলেও যখন জানতে পারলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মিডিল ইস্ট ঘুরে এসে দেশ থেকে সরকারী ভাবে শিক্ষিত জনশক্তি রপ্তানির একটা প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তখন লিবিয়ায় প্রচুর দক্ষ জনশক্তির জন্য চাকুরীর ব্যবস্থা হচ্ছিল। বাবা ঢাকায় এসে ওই মন্ত্রণালয়ের এক লোকের সাথে খাতির জমায়ে ফেলেন। তিনি মানে জাহাঙ্গীর সাহেব জনশক্তি রপ্তানি অধিদপ্তরে ছিলেন, তার সাথে বাবা বন্ধুত্ব করে কখন কি রকম দক্ষতার লোকবল বিদেশে পাঠানর সরকারী ব্যবস্থা হচ্ছে তা আগে থেকে জেনে ফেলতেন, তাই যখন তার ছোট বেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যিনি কিনা তখন খুলনা শিপ ইয়ার্ডে ছিলেন, আমার শ্রদ্ধেয় খায়ের আঙ্কেল, উনাকে একটা সুযোগে লিবিয়ার ত্রিপলিতে পাঠানর ব্যবস্থা করেন। তার পর যখন টেলিফোন প্রকৌশলে আবুধাবিতে লোকবল পাঠানো হচ্ছিল খবর জানতে পেরে তার ভায়েরা ভাই (আমার স্বশুর) জনাব সাইদ আহমেদকে সেই সুযোগে পাঠায়ে দেন। আমার খালু তখন ঢাকার গাজিপুরে টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস) এ কর্মরত ছিলেন। তার পর তার নিজের যোগ্যতার চাকুরীর সুযোগ পান লিবিয়ার তবরুখ শহরের পাওয়ার প্ল্যান্টে। সেই সুযোগে তিনি সুগারমিলের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে চলে যান লিবিয়ার ইজিপ্ট সীমান্তবর্তী পোর্ট সিটি তবরুখে। আমাকে ও আমার মাকে ছয় মাসের জন্য রেখে গিয়েছিলেন ২৭০ মালিবাগের নানা বাড়ির কাছেই এক ভাড়া বাসায়। ছয় মাস পর আমাদেরও তিনি নিয়ে যান তার কাছে। তাই আমার ছোটবেলার তিনটা বছর লিবিয়ার তবরুখের শাহারা মরুভূমিতে কেটেছে। আমার মা ওখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হাইয়ার পেট্রলিয়াম ইনিস্টিটিউটের লাইব্রেরিতে টাইপিস্টের চাকুরী নেন যার সুবাদে আমি ওই কলেজের অধ্যাপকদের জন্য নির্মিত ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আমার পড়াশুনা শুরু করার সুযোগ পাই। ওই শৈশবেই আমি ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী, বুলগেরিয়ান, টার্কিশ, চাইনিজ বাচ্চাদের সাথে একই ক্লাসরুমে পড়া ও খেলার মাঠে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম আর তখনই আমার ইংরেজিতে কথা বলার ফ্লয়েন্সি চলে আসে।
আমার বাবা অত্যন্ত কর্মঠ, হাস্যউজ্জল ও নিষ্ঠাবান মানুষ ছিলেন। চিনি কলে থাকার সময় তখনকার চিনি শিল্প কর্পোরেশনের সচিব নেফাউর রহমান যে এলাকার দায়িত্বে থাকতেন সেখানেই আমার বাবাকে নিয়ে যেতেন পোস্টিং দিয়ে। কারণ আমার বাবা অত্যন্ত জন দরদী ও সহজ সরল মানুষ ছিলেন যে তিনি যে কোন মিলের শ্রমিক ইউনিয়নকে ম্যানেজ করে ফেলতেন। বাবা কুষ্টিয়া সুগার মিলে থাকার সময় মুক্তিযুদ্ধ হয়। মা তখন তার সাথে, তারা যুদ্ধের সময় জয়পুর হাটের কোন গ্রামের একটা গৃহস্থ বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন যখন তাদের মিল কম্পাউন্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কৌতূহল বসত মিলে থেকে গিয়েছিলেন, তার ভাষ্যমতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কমান্ডো স্টাইলে মিলটা দখল করে নেয়, তবে তাদের দখল করার আগেই সব লোককে সেখান থেকে সরায়ে নেয়া হয়েছিল। আমার বাবা মার বিয়ের সময় ১৯৭০ আর আমার জন্ম ১৯৭২ এর ৫ই নভেম্বরে। মা বলতেন আমার জন্ম জয়পুরহাটে কিন্তু আমি তো জানি আমার জন্ম হলী ফ্যামিলি হাসপাতালে। মা যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা হলো আমি তার পেটে জন্ম নিয়েছি তারা যখন জয়পুরহাটে ছিলেন তখন।
বাবার যে তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটি আমার মধ্যে ও তার পর আমার সন্তানদের মধ্যে বংশানুক্রমে সংক্রমিত হয়েছে তা হলো পরমত সহিষ্ণুতা বা অন্যর মতকে সহজে গ্রহণ করে নেয়ার প্রবণতা। আমরা সাধারণত অন্যের মতকে সহ্য করি ও তা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখি। কিন্তু এতে করে আমরা কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া (লিডারশীপ) থেকে বঞ্চিত হই। এই তিনটি পৈত্রিক বৈশিষ্ট্য আমার ও আমার সন্তানদের মাঝেও আছে দেখে আমি ওদের সতর্ক করে দিয়েছি যে আপাত দৃষ্টিতে এগুলোকে ভালো গুন বলে মনে হলেও এর অতিরিক্ততা প্রকৃত অর্থে আমাদের জন্য কোন মঙ্গল বয়ে আনে না। যা হোক আমার বাবা সহজ সরল হলেও তার ৪৮ বছরের কঠোর পরিশ্রমী জীবনে যা করে গেছেন আমার ৫২ বছর বয়সেও সেই পরিমাণ সম্পদ আমি অর্জন করতে পারি নাই, তবে তার ও আমার মা এর পরিশ্রমে গড়া সম্পদ আমি ধরে রেখেছি আমার সন্তানদের জন্য ও তাদের প্রায়শই দাদা ও দাদীর পরিশ্রমের কথা স্মরণ করায়ে দেই যাতে তারাও এর মূল্য বুঝে। আমার বাবাকে নিয়ে এত অল্প লেখা কখনই যথেষ্ট নয় । আমি আমার বাবার পুর জীবনটার সাথী আমার জন্মলগ্ন থেকে। আজ আমার বাবা বেচে থাকলে খুব খুশি হতেন দেখে যে তার তিনটা নাতি-নাতনি হয়েছে যারা পড়াশুনায় ভালো আর আমিও সরকারী ব্যাংকে চাকুরী করছি। বিধির এ কি খেয়াল যে তিনি জানতেও পারলেন না তার পরিশ্রমের ফলাফল আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে। বাবাকে নিয়ে, বাবার স্মৃতি থেকে আরো অনেক লিখবো, আপাতত এখানেই শেষ করছি।
সম্পাদনা ও উন্নয়কালঃ ২২জানুয়ারী২০২৪> ১৮এপ্রিল২০২৪> ২৫এপ্রিল২০২৪>
আমার কাছে অনেকের প্রশ্ন https://surzil.blogspot.com/2024/02/blog-post_28.html
ব্লগ লিংকঃ https://surzil.blogspot.com
ফেইসবুক প্রফাইলঃ https://www.facebook.com/mustafa.surzil.rawnak
A dynamic character and a passionate father! It is a duty to cherish his memories. It is also a great honour to be his son.
ReplyDelete