নগর পিতাদের উদ্দেশ্যে বলছি, যদিও জানি না উনাদের কান পর্যন্ত এই কথাগুলো পৌঁছাবে কিনা? আমরা প্রতি বছর সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্স দিচ্ছি আবার আমরা আয়করও দিচ্ছি। প্রতিটি পণ্য তা সেবা হোক বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হোক কিনতে গিয়ে ভ্যালু এ্যডেড টেক্স বা ভ্যাট (মূশক) তো দিচ্ছিই। ব্যাংকে টাকা রাখলেও তা থেকেও সরকার আবগারি শুল্ক বা এক্সাইস ডিউটি ও সোর্স টেক্স (উৎসে কর) কেটে নিচ্ছেন। এত কিছুর পরও আমাদের কেন ময়লা আবর্জনা যুক্ত আর অবহেলিত ভিক্ষুকে পরিবেষ্টিত নগরে বসবাস করতে হয়? সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড “ভিক্ষুক মুক্ত ঘোষিত এলাকা”দেখলেই ভাল লাগে। এই ভেবে যে, সরকার এর সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর একটা দারুণ কাজ করছে। শুধু ভিক্ষুক মুক্ত করলেই চলবে না তাদের কোন না কোন ভাবে পুনর্বাসন তো করতে হবে? নিশ্চয়ই সেই রকম কোন ব্যবস্থা করেই তবে এলাকা থেকে ভিক্ষুকদের অপসারণ করা হচ্ছে বলে আমার ধারনা। এ কাজটা শুধু সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর করবে কেন, স্বাভাবিক হিসাবে এটা তো সিটি কর্পোরেশনের কাজ। এর পাশাপাশি ভাল কাজের হোটেল যা ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ করছে এরকম বেসরকারি এনজিও গুলোও আগায়ে আসতে পারেন। আর ভাল হতো যদি ময়লা মুক্ত ঘোষিত এলাকা নামে সাইনবোর্ড দেখতাম। এত ময়লা চারদিকে যে মনটাও অপরিষ্কার হয়ে যায়। আমার এক বন্ধুর বন্ধু নাকি বিদেশে থেকে এ দেশে এসে মন্তব্য করেছিল বিরাট এক ডাস্টবিনে প্রবেশ করলাম। ময়লা আবর্জনার জন্য গন মানুষের অনুন্নত মানুষিকতাও কম বেশী দায়ী। আমার অফিস মতিঝিলে হওয়াতে নানা প্রকারের ভিক্ষুক দেখতে পাই এখানে। একেক জনের দুরবস্থা একেক রকম, বেশিরভাগই ভেক ধরেছে বা ভান করছে, কেউ এমনকি মাইকে তার আর্তি জানাচ্ছে। কেউ বিয়ের কুলা নিয়ে জনসাধারণের কাছে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা চাইছে। মতিঝিল দিলকুশায় ভিক্ষাবৃত্তির অধিক্য কারণ এখানে যারা আসে সবাই পয়সাওয়ালাদেরকে পায়। বিশেষ করে ফুটপাতের চা এর দোকান গুলোতে যখন কেউ মানিব্যাগ খুলে তখন তারা তাদের উচ্ছিষ্ট ২ টাকা, ৫ টাকা বা ১০টাকা ভিক্ষুককে দিয়ে দেয়। আমার একটা উদ্ভট অভ্যাস অফিসের কাজের ফাকে ফাকে চা খেতে যাওয়া। কোন একটা কাজ শেষ করেই একটা রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য দৌর দেই। কাজে ফাঁকি দিয়ে নয় বরং পরবর্তী কাজের রিইনফোর্সমেন্ট এর মত এটা কাজ করে আমার মধ্যে। এই এলাকার ভিক্ষুকদের ধরন ধারণ ও পথ পরিক্রমা আমার জানা হয়ে গেছে। একেক জনের ভিক্ষা চাওয়ার ধরন আলাদা। প্রথম প্রথম আমার খুব খারাপ লাগত ওদের দুরবস্থা দেখে, তবে এখন যখন প্রত্যেক দিনই ওদের একই অবস্থায় একই ভাবে ভিক্ষা করতে দেখি তখন রাগ হয় আবার করুণাও হয়। একটা ছোট্ট মেয়ে বয়স ১২কি ১৩ হবে, তার কোলে একটা বিকলাঙ্গ বাচ্চা সারা দিন পিপলস টাওয়ারের সামনে বসে ভিক্ষা করে বিকাল হলে দলিকুশার রাস্তা ধরে ভিক্ষা চাইতে চাইতে বাড়ি ফিরে। ওই ছোট্ট মেয়েটা এই বিকলাঙ্গ বাচ্চাটাকে নিয়ে কিভাবে জীবন পার করবে কে জানে। হয়ত বাচ্চাটা আর বড় হলে হুইল চেয়ারে করে ওকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সেই একই কাজ করবে। কয়েকজন খুব বৃদ্ধ মহিলা আসে পথ পরিক্রমায় তাদের দেখার কেউ নাই বুঝাই যায়, না হলে এত বৃদ্ধ বয়সে কেউ ভিক্ষা করত না। ভিক্ষুকদের মধ্যে সব থেকে ভিক্ষার দাবিদার হলো অন্ধ আর বিকলাঙ্গ ভিক্ষুক, তাদের চাওয়ার মধ্যে তাদের অন্ধত্বর ও বিকলঙ্গতার কথাটা স্পষ্ট করে বলে আর এরা ভিক্ষা পায়ও যথেষ্ট পরিমাণে। একবার এক চায়ের দোকানে এক বয়োবৃদ্ধ কিন্তু শার্ট পেন্ট পড়া মুখে করুন ভাব করে রাখা লোক তার দুরবস্থার কথা জানাচ্ছিল। আমি প্রথমে ভাবছিলাম উনি ভিক্ষুক নয় কিন্তু পরে বুঝেছি এটা তার একটা ভড়ং বটে। এদের অনেকের মানুষিক রোগ আছে বলে আমার মনে হয় কিংবা হয়ত সত্যসত্যই দুরবস্থা গ্রাস করেছে এদের ভাগ্য। এক মাঝ বয়সী কি প্রায় বৃদ্ধ মহিলাকে রাজার বাগ মোড়ে দেখতাম ভিক্ষার জন্য গাড়ির পিছন পিছন দৌড়চ্ছে, আর কয়েকদিন পর দেখলাম সে ধীরে ধীরে আর দরিদ্র হয়ে চরম অবস্থায় চলে গেল। প্রথমে তাকে দেখে ভিখারি মনে হতো না কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তার চরম দুরবস্থা দেখলেই বুঝা যেত। আমার আফসোস এর কথা শুনে একদিন চা এর দোকানে এক লোক বলল ফার্মগেটের এক ভিক্ষুক তার দেশের বাড়ির, সে প্রতি মাস শেষে লোকটির কাছে তার ভিক্ষার্জিত সকল অর্থ জমা দেয় গ্রামের বাড়িতে পাঠানর জন্য আর সেটা নাকি কম করে হলেও ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা হয়। প্রতি মাসে সে তার গ্রামের বাড়িতে সেই টাকা পাঠায়ে দেয়। গ্রামের বাড়িতে তার কালার টিভি আছে এত বড় যে শহরে তত বড় টিভি কিনার সাহস করে না অনেকেই। ফার্মগেটে হাজার মানুষের ভিড় হয় বললেও কম বলা হবে। প্রত্যেক দিন ওখানে মনে হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের আনা গোনা হয়। সেখানে ৪০ কি ৫০ হাজার টাকা মাসে ভিক্ষা পাওয়া তেমন অসম্ভব বলে মনে হয় না।
ভিক্ষাবৃত্তি এদেশে বেশি কারণ এদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম আর ইসলামে দান করাকে উৎসাহিত করে। কিন্তু এই দান যা ইসলাম উৎসাহিত করে তা যারা হাত পাতে তাদের জন্য নয়, কিংবা যারা হাত পাতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে তাদের জন্য তো নয়ই বরং যাদের অর্থনৈতিক কষ্ট আছে কিন্তু বলতে পারছে না তাদের জন্য বলা হয়েছে। তাদেরকেই আরবিতে মিসকিন বলা হয়। বাস্তব প্রয়োগে জনগণ তা অন্যরকম করে ফেলেছে। ইসলামের প্রত্যেকটা শিক্ষাকেই যেন ভিন্নভাবে এ দেশে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে যার কারণে ইসলামের সুফল গুলো থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। ভিক্ষুক মুক্ত ঘোষিত দেশ মনে হয় কল্পনাও করা যায় না তবে ভিক্ষুক যখন হাত পাতে তখন তার দুরবস্থাও সহ্য করা যায় না। ভিক্ষুকদের সংখ্যা দিন দিন যেন বাড়ছেই। মুছে ফেল চোখের জল, শক্ত করো মন, বাঁচতে হলে লড়তে হবে তোমায় সারাক্ষণ এই মন্ত্রে সকল ভিক্ষুককে দীক্ষা নিতে হবে আর এ কাজটা করবে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোন অঙ্গ সংগঠন আর এর মূল দায়িত্ব মূলত বর্তায় নগর পিতাদের উপর। সাধারণ নাগরিকদের মধ্য হতেও এরকম উদ্যোগ নেয়া হতে পারে যার একটি উদাহারন ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ ও তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম। এ রকম একটা কি দুটা দিয়ে হবে না, অনেক গুলো লাগবে কিন্তু সেরকম সুবুদ্ধি সম্পন্ন উন্নত সুশীল সমাজ কি গঠিত হয়েছে এ শহরে? আমার ছাত্রাবস্থায় এক বন্ধু সমাবেশে বলেছিলাম যে দেশে দুই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা পাশাপাশি চলে (অর্থাৎ স্কুল ও মাদ্রাসা) সে দেশে এক সময় না এক সময় একটা মারাত্মক সংকট বা দ্বন্দ্ব অবস্থা হবেই। আজ এ দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে উগ্র ইসলামপন্থী আর মুক্তমনা সেকুলার মুসলিম নামধারী দুটি সম্প্রদায় বিভক্তি রেখা স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। কেবল মাত্র ভাষা কে কেন্দ্র করে কোন সর্বসম্মত দর্শন সম্ভব নয় এটা সবাই জানে। ধর্ম ভিত্তিক দর্শন দিয়ে একটা পুর জাতিকে হয়তো একত্রিত করার প্রয়াস চালান যেতে পারে কিন্তু সেই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যদি এত বিভেদ থাকে তবে তা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবে কিভাবে? আজকের প্রযুক্তির যুগে ধর্মের গালগল্পগুলোও পানসে হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। বকধার্মিক কিংবা সেকুলারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে যার পরিসংখ্যান নেয়া হয় না বা কেউ জানে না। একটি সুগঠিত সমাজে ভিক্ষুক কেন থাকবে? অভাব গ্রস্থদের জন্য সমাজের সচ্ছল লোকদের কি কোন দায়বদ্ধতা নাই? শুনেছি সিঙ্গাপুরের ফুটপাতে একটা আলপিন পরলেও খুঁজে পাওয়া যায়, ওরা এতটাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অথচ আমাদের দেশে একটা গোট মানুষ হারায়ে গেলেও খুঁজে পাওয়া যায় না। ভিক্ষুকদের অর্তি শুনে আমার মধ্যে যে কষ্ট বা করুণা হয় আশ পাশের মানুষের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া হয় বলে মনে হয় না। তারা এটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে নেয় আর যখন দান করে তখন ধার্মিক দায়িত্ব থেকে করে মানবতার দৃষ্টি কোন থেকে করে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। আজকের ধর্ম তার মানবতা বোধ হারায়ে ফেলে একে একটা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে। ইসলামের স্বর্ণযুগে বায়তুল মাল থেকে বিনা সুদে ঋণ বা কর্যে হাসানা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। ক্যানাডার মত ওয়েলফেয়ার ইকনমিতে কেউ পরিবার নিয়ে অসহায় হয়ে গেলে তাদের বেকার ভাতা দেয়া হয় বলে শুনেছি। আমাদের দেশে সে কথা চিন্তাই করা যায় না এখনো। নবী মোহাম্মদ (সাঃ) এক ভিক্ষুককে কুঠার কিনে দিয়েছিলেন, তার মানে তাকে ভিক্ষা না করে কাজ করে উাপর্যনের পথ দেখায়ে দিয়েছিলেন। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে যারা ভিক্ষা করতে বের হয়, তাদের কেউ কেউ হয়ত বাচ্চা ভাড়া নিয়ে আসে তবে এক বোবা মা তার তিন বছরের ছোট্ট বাচ্চা হঠাৎ চোখের আড়াল হলেই হাউ মাউ করে উঠে, খুব স্পষ্ট বুঝা যায় বাচ্চাটা তারই আর সে কথা বলতে পারে না। আরেকটা মহিলা একটা ৯ কি ১০ বছরের মেয়ে নিয়ে ভিক্ষা করে, তাকে বললাম তুমি কাজ কর না কেন, সে বলে তার হতে ব্যথা তাই কাজ করতে পারে না। হাঁটুতে ভর দিয়ে হেটে ভিক্ষা করে এক মহিলা আর এক পুরুষ, তারা হাঁটুর জুতা বানায়ে নিয়েছে। আমি লোকটাকে বললাম তুমি তো বসে যারা কাজ করে যেমন বই বাধাই করা কিংবা অন্য কিছু তা করে রোজগার করতে পার, কর না কেন? সে কানে কম শুনে আমার কথা বুঝতেই পারলো না। আশপাশের সবাইকে যার যার ধান্দা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখি কেউ এ সব ছাই পাস ভিক্ষুক নিয়ে বিন্দু মাত্র চিন্তা করে না। আর সমাজের ধার্মিক সম্প্রদায় তাদের আখিরাতের চিন্তায় ব্যস্ত আর ফকির মিসকিনরা হলো তাদের কাছে স্রষ্টার পরীক্ষায় পতিত জনতা তাই তার সাথে মানবতা বোধের সংযোগটা করতে পারে না। ইংলিশ মিডিয়মে পড়া আমার আট বছরের ছেলেকে তার স্কুল থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সে বড় হয়ে কি হতে চায়? সুপার ম্যান না কি আর বড় কিছু, সে অকপটে বলেছিল সে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হতে চায়, আওয়ার সিটি ইজ টু মাচ ডারটি, এটা ছিল তার উত্তর। শুনে আমার অবাক লেগেছে অতটুকু ছোট একটা ছেলে বানায়ে কথা বলে না। যা সত্য মনে আসে তাই বলে দেয়। ওর কাজিনের জন্ম কানাডায় তাই সে হয়ত এরূপ মানসিকতা নিয়ে বড় হবে না। কিন্তু আমরা যারা এ দেশের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছি তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এতটা অপরিচ্ছন্ন শহরে বড় হবে কেন? আমরা কি এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি না? একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য সিএনজি ট্যাক্সি ভাড়া করলাম, ড্রাইভারটার কথা জড়ায়ে জায়, পথে যাওয়ার সময় বললো তার ব্রেন স্ট্রোক করার পর থেকে এই অবস্থা হয়েছে। এ কারণে তাকে মালিক সিএনজি চালান থেকে বাদ করে দেয়, তার এক বন্ধুর নামে গাড়ি নামায়ে সে চালায় আর তা দিয়ে সংসার চালাতে পারে কোন মতে। এক আরহী একদিন সন্দেহ করে যে সে রাতে মদ খেয়েছিল বলে কথা জড়ায়ে যাচ্ছে? ড্রাইভার এর চোখ দিয়ে অশ্রু দেখে আর সব জানতে পেরে সে তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল ও জরায়ে ধরেছিল। সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার হতে ৫০০ টাকার কম থাকায় পিজি হাসপাতালে সিটি স্ক্যান করতে না পেরে বাবা মেয়ে কেঁদে বাড়ি ফিরেছে। এই সব করুন বাস্তবতা গুল মিথ্যা নয় মোটেও। এদের ভাগ্যে দুর্ভোগ নেমে এসেছে আর তা থেকে উত্তরণের জন্য তারা কার সাহায্যও পাচ্ছে না। শিক্ষিত ও ধনিক শ্রেণীর এ সকল বিষয়ে কি কিছুই করনীয় নাই? এ সব দেখার জন্যই কি আমরা নগর প্রতিষ্ঠা করেছি, কর দিচ্ছি? এতকিছুর পরও কেন মানুষের এত দুর্ভোগ দেখতে হবে। সবাই যার যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এরকমটা হওয়ারই কথা।
আমার মাথায় উপরে উল্লেখিত প্রশ্নগুলো বহুদিনের, মহাখালীর সাত রাস্তার একটু সামনে ভূমি অফিসের পাসের ফুটপাতে একদিন দেখলাম দেয়াল লিখন, “ভালো কাজের হোটেল” এখানে খেতে টাকা লাগে না, একটা ভাল কাজ করলেই চলে। এটা দেখে প্রথমে আমি ঠিক বুঝি নাই এটা কি বলছে? তবে আগ্রহ জন্মেছিল জানার। এর বহু দিন পর ফার্মগেটে ওদের বাঁশের ছাউনিতে একটা সাইনবোর্ডে লেখা facebook.com/vkhbd ওটা দেখে বাসায় এসে যখন ইন্টারনেটে ওদের ফেইসবুক পেইজ পেলাম আর ওখানে সময় টিভির ভিডিও ক্লিপটা দেখলাম তখন বিষয়গুলো পরিষ্কার হলো। আর খোজ খরব নেয়ার পর জানলাম ওরা ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ নামের দেশিও একটি সংগঠন যারা ডেইলি টেন মেম্বার সংগ্রহ করে। মানে হলো দিনে ১০ টাকা করে জমায়ে মাসে ৩০০ টাকা ওদের দিলে ওরা প্রত্যেক দিন এক বেলা তাদের তিন কি চারটা ভালো কাজের হোটেলে পথের ছিন্নমূল লোকদের খাওয়ায়। ওদের কিচেন খিলগাঁও এ আর ওদের বেশ কয়েকটি ডেইলি টেন স্কুলও আছে। ওদের কাজকর্ম সবই আমার খুব ভাল লাগলো। এরা তো মানবতার কাজ করছে আর মুসলিম সংগঠন গুলো হাদিস কোরান ঘাটা ঘাটিতে এতটাই ব্যস্ত যে তাদের সামাজিক দায়িত্বটাও ভুলে গেছে। ইয়ুথ ফর বাংলাদের ডেইলি টেন মেম্বার দের জন্য (যারা ওয়েব পেজে ঢুকে রেজিস্ট্রেশন করে) একটা করে মাটির ব্যাংক পাঠায়ে দেয় যাতে সদস্যরা প্রত্যহ ১০ টাকা করে সংগ্রহ করে মাস শেষে তাদের ৩০০ টাকা দিবে। এছাড়াও ওদের ওয়েব পেইজে কেউ যদি ২০ জন কিংবা ৩০ জনের বা আর বেশি জনের তিনটা সেট মেনুর যে কোনটা খাওয়াতে চায় তাও পারবে, তাতে যা খরচ হবে তা হিসাব করে দেয়া আছে ওখানে। ওদের সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর জানলাম ওরা শেয়ারে কোরবানির আয়োজন করে, এটা জেনে ওদের সাথে ২০২৩ সালের কোরবানি ওদের সাথে দিলাম। ওরা তিন ভাগের একভাগ নিয়ে নিবে জেনে খুশি হলাম যে তৃতীয় ভাগটা যথাযথ বিতরণ হবে। ওরা সঠিক হিসাব দিল ও কিভাবে তৃতীয় ভাগটা বিতরণ করেছে তারও বিস্তারিত বিবরণ পাঠাল।
ওদের কাজকর্মে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে আমার পরিচিত সবগুলো অনলাইন গ্রুপে ওদের সম্পর্কে বললাম আর ওদের কাজ কর্মের সাথে সম্পৃক্ত হতে বললাম। এখানে এসে আমার নতুন অভিজ্ঞতা হলো। লোকজন তাদের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলো। আমি ওদের যাচাই বাছাই করার সব লিংক গুলো সরবরাহ করার পরও কার কার সন্দেহ গেল না আর অনেকেই এ সব বিষয়গুলোতে উদাসীন বলে মনে হলো। সব থেকে অবাক করা ব্যাপার হলো আমার যে সব বন্ধুরা আগে অতটা ইসলাম সচেতন ছিল না কিন্তু ইদানীং লম্বা দাড়ি রেখে মহা মুসুল্লি হয়ে গেছে তাদের মধ্যে নামাজ রোজা হজ্জ্ব নিয়ে যত উন্মাদনা কিন্তু সমাজের অবহেলিত ও অভাবগ্রস্তদের নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নাই। তারা যাকাত দিবে অথরিটি ছাড়া আর পথে ঘাটে দু চার টাকা দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিকে চলমান রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে তাতে তাদের কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু এটা কি ইসলামের শিক্ষা ছিল কোন দিন? হুজুররাও সমাজে এসব বিষয়ে মানুষদের সচেতন করে না। মুসলিম প্রধান দেশে ভিক্ষাবৃত্তি তাই একটা চিরাচরিত ব্যবস্থা। একটা হলিউড মুভিতে দেখিয়েছিল মক্কা দিয়ে যাওয়ার পথে ফকিররা গাড়ির জানালা দিয়ে ভিক্ষা চাইলে ওরা আঙ্গুল দিয়ে উপরের দিকে দেখায় যার মানে হলো আল্লাহ ফয়সালা দিবে। এটা ওদের মুভিতে হাস্যকর হিসেবে দেখিয়েছিল। আমি ছোট বেলায় লিবিয়ার তবররুক শহরে ছিলাম ওখানেও দেখেছি মিসকিন আছে, ওরা বিদেশিদেরকেও মিসকিন বলতো। ইসলামে রাস্তা থেকে একটা ময়লা সরানও সুন্নত, এমনও কথা বলা আছে সারা জীবন দেহপসারীনির কাজ করছে অথচ একটা বিড়ালকে দয়া করে পানি পান করিয়েছে তা হলে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। এই সব কথা থেকে এটা প্রায় নিশ্চিত যে ইসলাম মানবতার কথা বলে অথচ আজকের মুসলিম শহর গুলো ফকির মিসকিনে ভরা। এটা কোন কথা হলো? ইসলাম কি শুধু নামাজ রোজা হজ্জ্ব জাকাত আর কালেমা এই পাঁচ টা জিনিস নাকি এর সামাজিক একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক সমাজে যত অসংগতি তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া ওই সমাজের সকলের দায়িত্ব আর সমাজ থেকে ময়লা আবর্জনা আর ভিক্ষুক দুর করাও সবারই দায়িত্ব। নগর পিতাদের উদ্দেশ্যে তাই আবারও অনুরোধ জানাচ্ছি, এই বিষয়গুলোর দিকে আপনাদের সদয় দৃষ্টি দিন।
আপডেট হিস্ট্রিঃ ২৬নভেম্বর২০২২> ৩০নভেম্বর২০২২> ১ডিসেম্বর২০২২> ২৫মে২০২৩> ১১জুলাই২০২৩>
No comments:
Post a Comment