মনে
করুন যদি, সব ছেড়ে হায়, চলে যেতে হয় কখনও আমায়, মনে রবে কি? – ঠিক আছে গানের ছন্দে
আর নাই বা বললাম, এই প্রসঙ্গটা কবি সাহিত্যিকরা বার বার এনেছেন, যেমন আজ হতে
শত বর্ষ পরে, কিংবা যখন পরবে না মোর পায়ের
চিহ্ন এই ঘাটে তখন পরবে কি মনে আমিও যে ছিলাম? অপরের মনে এই আমার কথা ধরে রাখাটা এত
জরুরী হবে কেন? এর জন্য কেন এত মনের আকুতি। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের
সামগ্রী প্রবন্ধে এর চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে
গেছেন। তিনি বলেছেন “সে নানা মনের মধ্যে নিজেকে
অনুভূত করতে চায়,”
আবার বলেছেন “মানুষের হৃদয় মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অমরতা প্রার্থনা করছে” আরেক
জায়গায় বলেছেন “অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত হওয়ার জন্য প্রতিভাশালী হৃদয়ের কাছে সুর, রং, ইঙ্গিত, প্রার্থনা
করে, যা
আমাদের হৃদয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি না হয়ে উঠলে অন্য হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে
পারে না, “কিন্তু
আমার কাছে মনে হয়েছে অন্য কারণে, এটা
অমরত্ব পাওয়ার বাসনা নয় বরং এটা
মানব মনের স্থায়িত্ব পাওয়ার
প্রবণতা বা প্রবৃত্তি। মানব মন স্থায়িত্বে শান্তি পায়
আর অস্থিরতায় কষ্ট পায়। আমার মনে যে অনুভব সৃষ্টি হয়েছে তা মন থেকে মনে ছড়ায়ে যাবে তাই তার বিনাশ হবে না, এই প্রত্যাশা
থেকেই মনে হয় মানব মনে স্থায়িত্ব
পাওয়ার ইচ্ছায়
মন থেকে মনে সংক্রমিত হওয়ার
বাসনার সৃষ্টি করে। সময়ের
মধ্যে দিয়ে চলমান বাস্তবতায় বসবাসের যন্ত্রণা এই যে সময় সব কিছু মুছে ফেলে নিজেকে
সব সময় সতেজ ও
তরতাজা রাখে। বাস্তবতা অনেকটা রান টাইম ক্যাশ মেমরি বা র্যামের মত, জমা রাখার
জন্য যার কোন হার্ড ডিক্স নাই। সব সময় মুছে দেয় বলেই মনের মূল্য সংযোজিত অনুভূতি
গুল সঞ্চিত রাখতে মানব মন ধর্মীও ও সামাজিক
বচন, ছবি, কবিতা, গান, নাটক, মুভি এক কথায় সাহিত্য রচনায় সচেষ্ট হয়েছে আর অর্জিত জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য খাতা-কলম-কম্পিউটার তো
রয়েছেই। চেষ্টাটা হল ধরে রাখার চেষ্টা, সময়কে থামায়ে দেয়ার চেষ্টা,
অনেকটা সেই হার্ড ডিক্সটা বানাতে চায়। কিন্তু সময় এতই একরোখা যে এই চেষ্টাও নষ্ট
করে দেয় অপেক্ষাকৃত স্বল্প বা দীর্ঘ সময়ের প্রবহমানতায়। যা’ই
হোক মানব সভ্যতা অন্তত বিগত দুই হাজার বছরের সাহিত্য ও অর্জিত জ্ঞান বিজ্ঞান সংরক্ষণের
ব্যবস্থা করতে পেরেছে মাত্র। এর পূর্ব-জ্ঞান পাথরে কিংবা প্রত্নতত্ত্বে ছিটা ফোটা হয়ত
পাওয়া যাবে। ইসলামে প্রথম ঐশী বানীর একটা আয়াত হল এরকম, স্রষ্টা মানবকে কলম দ্বারা
শিক্ষা দেন, প্রশ্ন হল, কলম দিয়ে শিক্ষা দেন এই কথাটা প্রথম বাণীতে আসটা
জরুরি ছিল কেন? কলম তো যুগে যুগে বদল হয়েছে, সেই পাথরে খোদাই থেকে পালক-কালি,
দোয়াত, ঝর্না কলম, পেনসিল আর এখনকার ডিজিটাল
ষ্ট্যাণ্ডার্ড কি-বোর্ড সবই ত কলমের বিবর্তন ধারা, তা হলে কলমটা আসলে কি?
যা দিয়ে লেখা যায় তাই ত? কি লেখা যায়? মনের ভাব প্রকাশ, চিঠিপত্র? আমার যা মনে
হয়েছে প্রথম ঐশী বানিতে কলম শব্দটা এসেছে কারণ সময়ের স্রোতে
ঘটনা প্রবাহকে বর্ণনা করে ধরে রাখার একমাত্র হাতিয়ারটিই হল লেখনী। যা দিয়ে ঘটে
যাওয়া ঘটনা যা সময় তার চলমান ও সামনে ধাবমান বর্তমানের তাগিদে সব সময় মুছে দিচ্ছে। তাকে
যা ধরে রাখতে পারে তাই ত কলম যা কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে আজকের ডিজিটাল ইউনিভারসাল
কি-বোর্ড এ রূপান্তরিত হয়েছে। আর এই কলম দিয়েই সময়কে আপাত স্তব্ধ করে এর বিবরণ মনে
ধরে রাখার একটা উপায় মানুষ পেয়ে গেছে। এ
অর্থে এটা যুগান্তকারী একটা টেকনলিজও বটে।
লেখাটার
উদ্দেশ্য ধর্মীও মন ভঙ্গির দেয়া সর্ব রোগের সমাধান মাষ্টার প্রেসক্রিপশনের আর
গ্র্যান্ড ডিজাইনের বাইরে এসে জীবনের উদ্দেশ্য বিধেয় বুঝে দেখা, অনেকটা থার্ড আই
অংগেল ভি্উ থেকে মানে
হল তৃতীয় নয়নে জীবন, জগত ও এর
উদ্দেশ্যকে বিচার বিশ্লেষ করা। পাঠক মন, আমিও যেমন করে থাকি, কার লেখা পড়ার সময়,
প্রথমেই ভাবি লেখক কোন ঘরানার, দ্বান্দিক বস্তুবাদী নাকি অস্তিত্ববাদী, কট্টর অন্ধ ধার্মিক নাকি
লিবারেল বা সেকুলার। এভাবে লেখার প্রথম প্রস্তাবনাকে কোন একটা ঘরে ফেলতে পারলেই
পুর লেখাটাতে লেখক কি বলতে চাচ্ছে তা ধরা পড়ে যায়। আমি জানি যারা এই লেখা পড়বেন
তারও এ কাজটা করবেন মনে মনে, অন্তত যাদের প্রবন্ধ
পাঠে অভ্যাস আছে তারা তা করবেনই। আমি বলতে চাই নিরপেক্ষতার একটা বৈশিষ্ট্য
আছে, কোন মানুষের পক্ষেই পুরপুরি পক্ষপাত মুক্ত বক্তব্য দেয়া সম্ভব নয় আর প্রবন্ধ
মূলত লেখকের চিন্তা আর তার বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। লেখককে কমপারটমেনটালাইজড না
করে দেখা দরকার তার চিন্তার নিরপেক্ষতাটা কতখানি স্বচ্ছ। আর সৎ চিন্তন থেকে সমস্যা
সমাধানে অবশেষে তিনি কোন সিদ্ধান্তটি কে প্রস্তাব করেন।
জীবনের
পথ চলার এই পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে মানুষের জীবনের প্রধান সমস্যাটা মনে হয় সময়কে
বুঝতে না পারা, এটা চলমান না স্থির তাই তো
সঠিক ভাবে বুঝা যায়
না। দ্বিতীয় সমস্যাটা হল স্থায়িত্বর অভাব, যা কিছুই করুক না কেন সময় তা মুছে দেয়।
এ দুটো সমস্যা মূলত সময় সংক্রান্ত জটিলতা সমাধানে দুর হয়ে যেতে পারে, আরেকটি সমস্যা
হল এই সহস্র কোটি মহাবিশ্ব সম্বলিত এই অতিকায় মহাবিশ্বটা আসলে কোথায় আছে তা বুঝতে
না পারা, এটা কি কচ্ছপের পিঠে নাকি হাতির পিঠে? যদি তাই হয় তবে সেই হাতি বা কচ্ছপটা
আছে কোথায়? শূন্যের ভিতর শূন্যে নাকি সেই শূন্যটা কোন কিছুর উপর আছে। কিছু নাই
থেকে কিছু হয় কি ভাবে, যদি হয়ই তা হলে আবার ফিরে কিছু নাই যদি হয়ে যায়? নাকি এটা
মানব জ্ঞানে বুঝার অসাধ্য বিষয়। যেমন পিপড়াকে যদি কেমিস্ট্রি শিখাতে চান তবে তা
সম্ভব নয়, মাছকেও তো গাছে উঠান শেখান যাবে না, এটা কি সে করম কোন বিষয়? তা হলে
মুল সমস্যাটা হল স্থান আর কাল বুঝার অক্ষমতা যার কিছু ব্যাখ্যা আইনেষ্টাইন,
হাইজেনবার্গ আর হকিংস মহোদয়গন দিয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁরা পুর সমাধানটা
দিতে পারেন নাই। বরং
বিষয়টাকে এতটাই জটিল করে ফেলেছেন যে সাধারণ মানুষ তা বুঝতে অপারগ। আইনষ্টাইনের
থিওরি অব রিলেটিভিটি আজও সাধারণ মানুষের কাছে দুরবোধ্য, স্থান কালের বেঁকে
যাওয়ার বিষয়টা তাদের বুঝান গেল কেউ কেউ হয়ত তা মানতে নাও চাইতে পারে। এত উদ্ভট কথা
কেউ বলতে পারে কেবল পাগল ছাড়া? মহাবিশ্বর
আরম্ভ এক মহা বিস্ফোরণের
মাধ্যমে যা বহুকাল
হাইপথেটিক্যাল বা কেবল থিওরি মনে করা হত তা গাণিতিক
পদার্থবিদ্যার সূত্রে প্রমাণ করার পর জীবনাবসানের আগে হকিং সাহেব বলে
গেলেন একাধিক মহাবিস্ফোরণ ও বহু প্যারালেল শিশু মহাবিশ্ব হওয়াও সম্ভব। ব্ল্যাক হোলের বৈশিষ্ট্য উদঘাটন করে বলে গেলেন কাল গহ্বর
কাল নায় তা তাপ শক্তি
বিকিরণ
করে থাকে।
কিন্তু সাইন্স ফিকশনে যেমন দেখায় তেমন ভাবে ব্ল্যাক হোল দিয়ে ওপারে যাওয়া সম্ভব
নয়, এর অপর পারে শ্বেত গহ্বর থাকতেও পারে যা অনুমান নির্ভর কল্পনা
মাত্র। দেখে শুনে সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে ব্ল্যাক হোল হল মহাবিশ্বের একাধিক ছিদ্র
পথ যার ওপারে আছে শ্বেত গহ্বর আর এই সাদা গহ্বর গুলই হয়তবা
মহা বিস্ফোরণ যা একাধিক প্যারালেল শিশু মহাবিশ্বের উৎপত্তি
বা গেটওয়ে বা সূত্রপাত। ব্যাকগ্রাউন্ড
রেডিয়েশন প্রমাণ করে মহা বিস্ফোরণ হয়েছিল আবার কাল গহ্বর তো তাপ বিকিরণ করে চলে। তা হলে কি বিষয়টা এরকম
দাঁড়াল?
তিনিই প্রমাণ করলেন মহা বিস্ফোরণ বা দ্যা বিগ
ব্যাং এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনা লগ্ন আছে
আর জীবন শেষে প্রমাণ করলেন এই মহাবিশ্বর সূচনার মত আর বহু
মহাবিশ্ব আছে যাদের সূচনাও অনুরূপ মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে হয়েছে বা
হয়ে চলেছে অনুমান করা যায়। অর্থাৎ এই
মহাবিশ্ব গুল অনন্ত কাল হয়ত এরকমই ছিল আর হয়তবা অনন্তকাল এরকম থাকতেই থাকবে। আবার এমনও তো হতে পারে, এই প্রকৃতিতে যেমন সদা সর্বদা সৃষ্টি–প্রলয়-ধ্বংস
চক্র চলছে অনুরূপ চক্রের মত এই মহাবিশ্ব গুলও ক্রমাগত চক্রাকারে চলছে। হতে পারে তারকার যেমন জীবনচক্র আছে সেরকম মহাবিশ্বগুলোরও
জীবন চক্র আছে। এই
ব্যাখ্যাটা বস্তুবাদে দেয়া সমাধান যে, প্রকৃতি এরকমই ছিল আর অনন্ত কাল এভাবেই চলবে
যা সৃষ্টি হয়নি বা ধ্বংসও হবে বলে মনে হয় না, যেখানে এসব সৃষ্টিতে স্রষ্টার
প্রয়োজনকে অপ্রাসঙ্গিক ধরে নেয়া হয়েছে। জনাব হকিংস এর দেয়া সমাধানটা আমার কাছে অনেকটা
ছোট বেলায় দেখা চুল কাটার সেলুনে আয়নার মধ্যে আয়না তার ভিতর আয়না টেন্ডস টু
ইনফিনিটি সমাধান মনে হয়েছে। এ যেন
বাক্সর ভিতর
বাক্স, তার ভিতর আবার বাক্স এরকম চলতেই থাকবে শেষ বাক্সটা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোন দিন। ওই যে শুরতেই তো বলেছি তার আর পর নাই – ব্যাপারটা দাঁড়াল ওরকমই। তাছাড়া
কোয়ান্টাম বা কণা পদার্থবিদ্যায়
অনিশ্চয়তা সূত্রর
দার্শনিক ব্যাখ্যা
পড়লে সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে এই চলমান বাস্তবতা ফিল্মের সেলুলয়েড ফিতায় চলমান
আছে যার স্থির চিত্র নিলে অবস্থান পাওয়া যায় আর চলমান থাকলে কেমনে কি হচ্ছে কিছুই
বুঝা যায় না আর সেটাই বোধ হয় চলমান বর্তমান।
মানব মনের বা মানুষের আরেকটা বড় সমস্যা
হল আবেগ প্রবণতা আর জ্ঞানের ধারার মধ্যে
ভারসাম্য রাখতে না পারা, অনেকে তার ভাবের আতিশয্য দিয়ে
অন্যকে আবিষ্ট করে ফেলতে চায়
নিজের অজান্তেই,
আবেগের আধিক্যে কি
দিয়ে কি বলবে বুঝতে পারে না, কথা বলতে
শুরু করলে আর শেষ
করতে পারে না, সমস্যাটা হল মন ও মনের বহিঃপ্রকাশ বা মনের ভাবকে
বুঝে তাকে কথায়
প্রকাশ করতে পারার আনন্দ ও অন্যর মাঝে তাকে পুনরায় প্রতিস্থাপনের চেষ্টা ও তার
অক্ষমতায় অধৈর্য হয়ে যাচ্ছেতাই করা। অনেকেরই আচরণ তাই হুজুগে বলে মনে হতে পারে। যার
ফলে তাঁরা এমন সব ঘটনা ঘটায় বা ঘটনার সামনে পরে যে তাকে তাঁরা আর পরে সামলাতে পারে
না। জ্ঞেনের ধারা, ভাবের ধারা আর তৃতীয় ধারার এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব
মানব মনের এক বিচিত্র স্পেকট্রাম যার সরলীকরণের সূত্র আজও
আবিষ্কৃত হয় নাই। ধারা গুল স্পষ্টভাবে অনেকে সনাক্ত করতেও পারে
না বলে আমার মনে হয়েছে। এই প্রধান প্রধান সমস্যা কয়টির বিশৃঙ্খল সমাধান ও তার প্রতিক্রিয়া
আমাদের মত সাধারণ মানুষের মনে, কথায় ও আচরণে কি ভাবে প্রতিফলিত হয় তার উপর আমার
চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ গুল গুছায়ে লেখার চেষ্টা করছি এখানে। নিজের
প্রয়োজনে তো বটেই, পাঠক বন্ধুদের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েও, যাতে আমার চিন্তায়
কোন ভুল থাকলে তা ধরা পড়বে। এক সাক্ষাৎকারে হকিং সাহেব বলেছেন যে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়
গুল তিনি যতটা না পাঠকের উদ্দেশ্যে লেখেন তার চেয়ে বরং নিজের চিন্তা গুল
গুছায়ে ফেলার উদ্দেশ্যেও লিখেন। যা আমার লেখার চেষ্টার সাথে মিলে যায় অনেকটাই, আমি
নিজেকে লেখার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছিলেম এভাবে, চিন্তার জটিলতা সরলীকরণের জন্যই
এই লিখে চিন্তা করার চেষ্টা, বিশ্লেষণে সময় লাগে, লিখলে তা সহজ হয়। অনেকে নিজে নিজে কথা বলে এরকম এলাউড থিংকিং করে থাকে, আমিও
একসময় করতাম কিন্তু এখন আর সে রকম একাকী নিরবিচ্ছিন্ন সময় পাই না বরং বিভিন্ন সময়
লিখে রাখা বিষয়ভিত্তিক চিন্তা গুল পরে একসাথে করলে ওই কাজটাই হয়ে যায় হয়ত ভিন্ন
ভাবে।
মানব চিন্তার মৌলিক প্রশ্ন গুলর সমাধানে জীবন ও জগতের ব্যাখ্যায় এত মত এত পথ দেখে
বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া আমার মত সাধারণ
কার উপায় নাই। বাবা বলে একরকম, মসজিদের হুজুর বলে অন্য রকম, লাইব্রেরীর বই বলে
আরেক কথা, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বলেছেন আরেক কথা, এ
এক মহা বিভ্রান্তির কষ্টদায়ক চিন্তা
জট। অত শত
চিন্তা না করে বরং কাউকে
মডেল ধরে নিয়ে কিংবা
যে কোন একটা মত বা পথ বেছে
নিয় তাতে মননিবেশ করা বা বদ্ধমূল (কনভিকটেড) হওয়াটা সব থেকে সহজ মনে হতে পারে অনেকের
কাছে। এ ধরেনর মনোবৃত্তিকে অনেকে
হয়ত স্কেপ-গোট মেনটালিটি বা
পলায়ন প্রবৃত্তি বলবেন।
সৃষ্টি আর
স্রষ্টার ব্যাখ্যায়ও রয়েছে একই রকম বিভ্রান্তিকর
চিন্তা জট। এই দেখুন না স্রষ্টার
নাম নিয়ে মানুষ খুন, বোমাবাজী আবার সেই একই স্রষ্টার নাম নিয়ে গানে
গানে প্রিয় ভালবাসার মানুষকে চাওয়া। এমনকি
সরাসরি স্রষ্টার নাম ব্যবহার করে বেদম বাদ্য বাজায়ে গান হচ্ছে ইদানীং তাও আবার
ভক্তিমূলক বা আদ্ধাত্ব পূজার গান নয়, বরং প্রেমের গানেও সরাসরি
স্রষ্টার নাম ব্যবহার হচ্ছে। স্রষ্টা বা ব্রহ্মা কে নিয়ে এত টানা হেঁচড়া অথচ সবাই একসাথে একমত হতে যত বিপত্তি।
একটা বাক্য বিহীন
ইন্ডিয়ান ছোট ফিল্মে দেখাল এক
হিন্দু, এক খ্রিষ্টান আর এক মুসলমান যার যার টিফিন বক্স থেকে পাশাপাশি বসে লাঞ্চ করল, কেউ কাউকে খাবারের ভাগ দিল না এমনকি সাধলও
না, অথচ লাঞ্চ শেষে সবাই সিঁড়ি
বেয়ে নেমে এসে একই গঙ্গার জল খেয়ে
হাত ধুল । মানুষে
মানুষে কৃত্রিম ভাবে সৃষ্টি করা এই বিভেদ কি মানবতা বিরোধী মনোভঙ্গি নয়? এটা কি মানব সৃষ্ট অযথা বিড়ম্বনা নয়? আমার মনে হয়েছে বৃহৎ চিন্তা
বা ওয়াইড এ্যংগেলে বিশ্ব বীক্ষণ করার
অক্ষমতাই মানুষে মানুষে হিংসা
বা দ্বন্দ্বের মূল কারণ । আর
অনুভবে অক্ষম মানুষ তো যন্ত্র-মানব
বা রোবট ছাড়া আর কিছুই না, যাদের বিস্তার এক্স ম্যান মুভিতে যেমন দেখিয়েছে তার মত
দিনকে দিন বাড়ছে। একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তায় একটি ছোট
শিশুকে ফুটপাতে ছালা গায়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আমার চোখে পানি এসেছিল এই ভেবে যে,
আমার দ্বিতীয় কন্যাসন্তানের জনক হয়েছি মাত্র, ওই মেয়েটির বয়স আর আমার দ্বিতীয় কন্যার বয়স
একই, তা হলে পথ-শিশুটি ছালা গায়ে ফুটপাতে আর আমার মেয়েটি কত আরামে আছে ভেবে কান্না
পেয়েছিল। ওই কান্না পাওয়াটা কি শাশ্বত মানবতাবোধে আঘাত পাওয়ার বহিঃপ্রকাশ নয়? আমি নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করে এই উত্তর পেয়েছি,
আপনারা কি বলবেন জানি না।
কখনও
সময় আসে জীবন মুচকি হাসে, মনে হয় পাওয়া গেল ১৪ আনা, আর বাকি দু আনাও খুব শিগগিরি
পাওয়া যাবে, কিন্তু শেষ দু আনা আর কখনই পাওয়া হয় না
বরং জীবনের চার্জ ধীরে ধীরে কমতেই থাকে। এরকমটা হওয়াটা অত্যন্ত
স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই
তো মনে হয় আর এটা প্রাকৃতিকও বটে। থারমডাইনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র এনট্রপি তো ক্রমাগত বারতেই
থাকবে, মহাবিশ্বেরই এনট্রপি ক্রমাগত বাড়ছে আর আমাদের বাড়বে না? এই মন
ও দেহে বিশৃঙ্খলার মাত্রা আমাদের বয়স বাড়ায়ে দেয়, আর এই মাত্রা না বাড়লে চলমান বিশ্ব তো স্থবির হয়ে যেত। এই মহান গ্র্যান্ড
ডিজাইনটা এভাবেই সাজান বলে মনে হয়, এতে অবাক হওয়ার মত কিছু না থাকারই কথা। জীবন ও জগত সম্পর্কে সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ বা সম্মিলন সহমত
না থাকায় জীবনের পরিণতি ও স্রষ্টা নিয়ে বিভ্রান্তিকর জটিলতার সৃষ্টি হয় বলে আমার মনে হয়েছে। রূঢ়
বাস্তবতায় সবাই জানে চলমান সময়ের কোন এক ক্ষণে
সব ছেড়ে হায়, স্তব্ধ জগতে চলে যেতে হয় আর সে জগতে চেতনের সুইচটা অফ থাকবে
। সে অবস্থায়
তার সজ্ঞা বা সেন্স থাকবে না। সেখানে
চোখে দেখা বাস্তবতার চলচ্চিত্র বা তার মনের ভাবালুতার তো
প্রশ্নই আসে না। তার পরও কবর আজাব,
পরজন্ম, পুন-জন্ম, পুন-উত্থান নিয়ে এত মতভেদ কত মতবাদ। গোর আজাব বা মৃত্যুর পর কবরের জীবন নিয়ে
আমি ভীতিকর কিন্তু জনপ্রিয় গালগল্প প্রচুর শুনেছি যার সত্যতার ভিত্তি নিয়ে কেউই
(শ্রোতা বা বক্তা) চিন্তিত নন, বরং ভয় পাওয়াটা ও দেখানটা জরুরী
তাই গল্প গুল সত্যি ধরে নেয়া হয়েছে। ধর্ম অধর্ম নিয়ে বিতর্ক করতে ইদানীং আর ইচ্ছা করে না। এ সব
নিয়ে যৌবনে অনেক মল্লযুদ্ধ করেছি, আর না, যথেষ্ট দেখলাম নানা মুনির নানা মত আর
তার পর যতসব টানা হেঁচড়া। সেকুলার মনোবৃত্তি বিপক্ষে ছিলাম আর আজ ওসব পথেই হাটি না। আজকের আধুনিক পৃথিবীতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তা আর্থ
সম্পদ, বিত্ত, বৈভব, জ্ঞান, গরিমা যে দিক দিয়েই নেতাগীরি করেন, তারা ধর্মের বিষয়টা
ব্লা ব্লা বলেই উড়ায়ে দেন, মনে মনে হয়ত বলেন যতসব রাবিশ। উপরে উপরে শুক্রবার
জুম্মায় গালিচা জায়নামাজ কিন্তু নীতি আদর্শর বিচারে আর কর্মক্ষেত্রে পুর দস্তুর
সেকুলার, “যে যাই করে করুক না, আমার সমস্যা না করলেই হল” – এই মনোভঙ্গি। এই
বিরক্তিকর একঘেয়ে রি-অকারিকং বাস্তবতায় সেট-বদ্ধ নিতিমালা আর পরজন্মের সকল
প্রশ্নের সমাধান দেয়া ধর্ম একটা হাস্যকর বিষয় বটে তাদের কাছে। ধর্ম মধ্যবিত্ত আর
নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের একটি মহান হাতিয়ার। এর মাধ্যমে তাদের বশীভূত
করে রাখার একটা উপায় আবিষ্কার করেছে এই মানব সভ্যতা বহু যুগ আগে। ধর্মকে
সব রাজারাই উত্তম রূপে ব্যবহার করেছেন
যুগে যুগে। কেবল কোন এক মোঘল সম্রাট সব ধর্মকে এক করে দীন এ ইলাহি
নামে একটি কমপোজিট ধর্ম প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন মনে হয় এই ভেবে যে তাতে করে এত
বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা লাগবে না আর সবাইকে একই নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ
করা যাবে। তার মহত উদ্দেশ্য সফল হয় নাই, কারণ যারা যে যে ধর্মের ধ্বজা (ঝাণ্ডা বা
পতাকা) ধরে আছে তারা তাদের জীবিকার সাথে ওই ধর্মকে সম্পৃক্ত করে ফেলেছে, তাই তার
ধর্ম সমাজে মুছে গেলে ত তার মৃত্যু হওয়ার সামিল হবে, এটা সেই সারভাইভাল ইনিসটিংক্ট
যার থেকে মানব চরিত্রের বাকি সকল ইনিসটংক্ট বা প্রবৃত্তি সমূহ প্রস্ফুটিত পদ্মের
মত বের হয়ে আসে। প্রত্যেক
সফল শাসকের শাসন যন্ত্রের কেন্দ্রে দেখবেন একটা ধর্ম মন্দির
অবশ্যই আছে আর তা জমকাল জাঁকজমকপূর্ণও বটে। ধর্ম নিয়ে এত হানাহানি আর গোড়ামীর কারণে আধুনিক শিক্ষিত
গণ-মানস (ব্যক্তি বিশেষের কথা বলছি না, সারবীকিকৃত গড় মন ভঙ্গির কথা বলছি) ধর্মে
বিমুখ হয়ে গেছে বলে মনে হয় আর তা অনেকটা নিজের অজান্তেই। ধর্মকে কি
ভাবে ভ্রান্ত ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার একটা উদাহরণ দেই, আরবিতে আমল হল
কাজ যাকে ইংরেজিতে বলে ডিড। ধর্মে বলা হল, যারা সৎ কর্ম করবে
তারা বেহেস্তে যাবে বা সফলকাম হবে, এই সৎ কর্মর ইংরেজি
হল গুড ডিড আর আরবি হল ভাল আমল –আমাদের মাদ্রাসার
পুরহিত গণ এর অর্থ করল
আমল মনে তসবি, নামাজ আর কোরআন পাঠ। এই ভাবানুবাদ কি সঠিক হয়েছে? এর বিচার কে করবে?
আমল, সোয়াব, নেকি কিংবা বদির, এই টার্ম গুল ইসবগুলের ভুসির মত
পানিতে গুলায়ে খেয়ে ফেলেছে আমাদের বিজ্ঞ আতর মাখা পুরহিত মহল। শুধু তাই
না তারা তা গদ গদ স্বরে, তাদের প্রবর্তিত স্বব্যেখ্যায়িত পুরাণ আদর্শ নতুন বোতলে ভরে মাইক দিয়ে মানুষের কান ফাটায়ে প্রচারও করে থাকেন। আর সমাজে
যাদের অতি ভক্ত ধর্ম
অনুরাগী দেখতে পাওয়া যায় তাদের বেশিরভাগই জীবনের কাছে পড়াস্থ কিংবা ভবিষ্যতের
অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণকারী কিংবা অতি সম্পদ আর সফলতার আত্মস্লাঘায় বিমুগ্ধ স্বর্গ
যাত্রী । স্রষ্টার প্রতি ভালবাসা কিংবা ব্রহ্মার প্রকৃতি জানার আগ্রহ
তাদের মধ্যে খুব একটা নাই
বললেই চলে বরং পাপ মোচন আর এই ভোগময় জীবনকে আর কত দীর্ঘায়িত করা যায় তার জন্য কান্না কাটি প্রার্থনয় রত থাকে। ধর্ম বিষয়টিকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সাবজেক্ট যে ভাবে তার
গুরুদের কাছে শিখেছেন তেমনি ভাবে শিখতে চান। ধর্মকে
তাদের চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ না করে অন্যের শেখান বুলি, শেখান বিশ্বাস, শেখান
আচারে পরিণত করে ফেলেন। ভাবেন যারা এ বিষয়ে প্রফেসর তাদের কাছ থেকেই তো সার্টিফিকেট নিতে হবে। ধর্ম
পাশ সার্টিফিকেট যে জীবনাবসান উত্তর বিচার পরবর্তী
কার্যক্রম আর তাতে
স্বাক্ষর দাতা যে স্বয়ং বিধাতা তা তারা চিন্তা করে দেখেন নাই বা মানতে চান না কারণ
তাদের গুরুকুল সে কথা তাদের বললেও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়ে দেন নাই। চিন্তু শূন্য ধার্মিকেরা তাই
মন শূন্য কনক্রিটের মানুষে পরিণত হয়ে গেছেন। ধর্ম হয়ে
গেছে আচার সর্বস্ব
প্রথাগত জীবনধারণ ব্যবস্থা। সকল অমিমাংশিত বিষয়ের সুন্দর পার্থিব সমাধান।
আপনার
লয়ে বিব্রত হতে আসে নাই কেহ অবনী পড়ে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের
তরে-মানবতাবাদের এই মূল মন্ত্র থেকে ধর্ম তাই আজ অনেক দুরে,
বিষয়টা বিস্ময়কর বটে। ধর্ম –অধর্ম নিয়ে এখন আর কেউ ভাবে না, আরবান (শহুরে) কালচারে
সবাই বাই-ডিফল্ট (স্বপ্রণদিত ভাবে) সেকুলার বা ধর্ম-নিরপেক্ষ। মজার ব্যাপার হল
সাম্প্রতিক বিশ্ব আচারে ধর্মের সঞ্জায়নে যে রূপান্তর হয়ে গেছে সেটা এই সমাজের
বিজ্ঞ মহল মাথা ঘামান নাই। ভিটগেনষ্টাইন যেমন বলেছেন দর্শন বর্তমানে কেবল ভাষার চাতুর্যে পরিণত
হয়েছে তেমনি ধর্ম নিয়ে ইদানীংকালের মাতামাতি অন্ত-স্বার শূন্য প্রহসনে রূপান্তরিত
হয়ে গেছে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, যে কারণে ধর্মর প্রয়োজন ছিল তা কি নাই হয়ে গেছে
সমাজে? তা কিন্তু হয় নাই, বরং সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছেন নিউটন, আইনষ্টাইন,
ডারউইন, মেন্ডেল, হকিং, গেলেলিও, কোপারনিকাস, ম্যাক্স-প্লাংক, হাইজেনবারগের মত পয়গম্বর গন। ধর্মর মূল উদ্দেশ্য ছিল জীবনের উৎপত্তি
ও পরিণতি ব্যাখ্যা করা, দর্শনও তাই করার চেষ্টা করেছিল
কিন্তু এ দুটোকে পিছনে ফলে বাস্তবতার সর্বজন গ্রাহ্য
ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর নব নব উদ্ভাবন। যে
জ্ঞান ছিল কেবল পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ নির্ভর অনুসন্ধিৎসু মনের অবিরাম প্রচেষ্টা তা হয়ে গেল দর্শন আর ধর্মর
মত জীবন ও জগতের
ব্যাখাদানকারী। কখন যে
এই পরশপাথর শিকলে
ঠুকেছে পাগলটা (মানবতা) তা সে নিজেও জানে না, রূপান্তরটা তাই হয়ে গেছে
বিশ্ব-মানসে সবার অগোচরে। সেকুলারিজমের জনপ্রিয়তা তাই ঠেকায় কার সাধ্য। মানব চিন্তা-চেতনার উপর
লেখা শেখ তাক্কীউদ্দিন নাভায়ানীর বই “থট” এ বলেছেন রেশনাল থিংকিং আর সাইন্টিফিক
থিংকিং এর মধ্যে রেশনাল টাই সঠিক, কারণ মানবকে বা মানবের সকল বিষয়কে পরীক্ষাগারে পরীক্ষণ
ও পর্যবেক্ষণ করা যায় না। পরিপূর্ণ রূপে মানবকে বুঝতে
হলে তাঁর মতে রেশনাল থিংকিং ছাড়া উপায় নাই। রেশনাল মানে হল বাস্তবতা ভিত্তিক যৌক্তিক
বিশ্লেষন যা কেবল পরীক্ষণ
বা পর্যবেক্ষণ নির্ভর নয় আবার যা স্পেকুলেটিভ কিংবা অনুমান নির্ভর নয়,
বরং বাস্তবতার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশীল। আশপাশের
গনা বিশেক লোককে জিজ্ঞাস করে দেখুন তো আজকাল কেউ না মেপে
কথা বলে কিনা? যুক্তি দিয়ে বহুদূর জাল বুনা যাবে কিন্তু বাস্তবতা নিতান্তই বস্তুনিষ্ঠ। তবে বাস্তবতা
সবার চোখে সমান ভাবে ধরা নাও পরতে পারে, আমার কি এমন ঠেকা পড়েছে যে আপনার চোখে
দেখা বাস্তবতার ব্যাখ্যা আমাকেও মেনে নিতে হবে এই জন্য যে আপনাকে আমি বিজ্ঞ মনে
করি। আমার আপনার বাস্তবতার অনুধাবন তা হুবহু এক না’ও হতে পারে। বাস্তবতাটা অনেকের
কাছেই স্ব-বিরোধী একটা অনুধাবন, আমার কৈশোরে অনুধাবনটি ছিল অনেকটা এরকম, “স্রষ্টা
আমায় দেয়নি কোন স্ফীত অংশে নিবাস, দিয়েছে কেবল সময়ের সংকীর্ণ পথে
বসবার অবকাশ”। সেই অনুধাবন মাঝ বয়স পার হওয়ার পর হয়ে গেছে
“বাস্তবতা সর্বদাই সতেজ ও কখনই পেছন ফিরে তাকায় না” আর জীবনটাকে
বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এক পুনরাবৃত্ত
(রিকারিং) বিরক্তিকর যাত্রা বলে
মনে হয়। স্টিফেন
হকিং তার
বই “ব্ল্যাক
হোল”-এ বলেছেন অলটারনেটিভ
বা বিকল্প ভবিষ্যতের মত বিকল্প অতীত আছে। এ কারণেই হয়ত
ভবিষ্যতের
মত অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না
আর কখনও তা সম্ভব হবে বলে মনেও হয় না। অতীত বা
ভবিষ্যত বলে মনে হয় আসলে কিছুই নাই, পুরটাই
বর্তমান। বুঝার সুবিধার্থে
আমরা একে চলমান সময় বলে ভাবতে
শিখেছি, এটাকে জমাকৃত
এনট্রপির মত ভাবতে বাধা কোথায়? এই দ্বন্দটা মূলত সেই
পৌরানিক দার্শনিক অধিবিদ্যা আর দ্বান্দিকতার
দ্বন্দ। সবকিছুকে কি স্থির নিশ্চিত ভাব্বো নাকি সব কিছুকে চলমান, প্রবাহমান ভাব্বো এই দুয়ের সেই পুরাতন অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব। আমি বলতে চাচ্ছি বুঝার সুবিধার্থে একে
আমরা চলমান ভাবছি, মূলত এরা সব স্থির বর্তমানে ঘটমান। আমার এ অনুমানের কোন পরিক্ষিত ভিত্তি না
থাকলেও মনে হচ্ছে এই রূপকল্প সত্য মনে করাটাই স্বাভাবিক। চলমান হওয়ার জন্য রাস্তা দরকার, রাস্তা ছাড়া চলবেন
কোথায়, গ্যালাক্সি গুলর পরস্পর থেকে বিচ্যুতি মেপে একে বেলুনের গায়ে ছোপ ছোপ
দাগের সরে যাওয়ার মত মনে হওয়ায় মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বুঝা যাচ্ছে বটে কিন্তু
কোথায় যে বেলুনটা আছে তা কেউ বলতে পারছে না। তাই রাস্তা ছাড়া যেমন চলা যায় না, এই
বহমান বাস্তবতা অতীত থেকে ভবিষ্যতে ধাবমান বলা যুক্তি যুক্ত মনে হচ্ছে
না। মহাকালকে মহাবিশ্বের ব্যাকগ্রাউন্ড ধরলে মহাকালকে তো আগে
বুঝতে হবে, কাল কি তাই যদি না বুঝেন তা হলে মহাকাল বুঝবেন কি করে? কাল
বা মহাকালকে রাস্তা ধরে নিয়ে বাস্তবতাকে চলমান ভাবা হচ্ছে। কাল বা মহাকালের মান শূন্য
হলে সবই হবে মহা স্থির আর নিশ্চিত ধ্রুব। হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস “শূন্য”র কথা মনে পড়ে গেল যেটা পড়তে গিয়ে প্রথম
জেনেছিলাম ফিবনাক্কি রাশিমালা সম্পর্কে। উপন্যাসে
উনি মজা করেছিল এই বলে যে, সমীকরণের চল রাশিকে শূন্য ধরা
হলেই সমাধান পাওযা যায় তা গল্পের মূল চরিত্র সবার শেষে
বুঝতে পারেন। মানব
সভ্যতার অবস্থা মনে হয় সে রকমই,
হাজার বছরের গবেষনা অনুসন্ধানে অবশেষে শূন্য মানে সমীকরণ সমাধান করবে বলে মনে
হচ্ছে। মৌলিক প্রশ্ন গুল সমাধান না করে ধেই ধেই করে প্রযুক্তিতে আগে বাড়ার ফলাফল
এ ছাড়া আর কি হতে পারে।
অঞ্জন
দত্তর সেই গানটা শুনেছেন মনে হয়, যাচ্ছে চলে সব হন্তদন্ত হয়ে, এত সব যাচ্ছে
কোথায়? সবই কি হকিং এর শিশু ব্ল্যাক হোল দিয়ে মহাবিশ্বের অপর কোন অঞ্চলে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে নতুন অণু পরমাণু
কিংবা প্লাজমা হয়ে বিরাজ করছে? নাকি চিরতরে নির্বাণ পেয়ে
গেছে? এর উত্তর এখনও কার জানা নাই আর জানতেও পারবে না যতদিন না আরেক হকিং সাহেব নতুন
নামে জন্ম নিচ্ছেন। হকিং মহোদয় তাই
একটা মীমাংসা দিয়ে গেছেন মরে যাওয়ার আগে লেখা তার শেষ বইয়ে, খুব সাবধানে বলেছেন
বটে, যাতে মরার পর কেউ তাঁকে গাল মন্দ করতে না পারে। বলেছেন যদি
প্রশ্ন করেন সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করা আছে কিনা? আমার উত্তর হ্যাঁ, কিন্তু এই উত্তর না’ও হতে পারে।
তার মত এত মেধাবী একজন লোক যে কিনা বাস্তবতাকে গাণিতিক ভাবে অনুধাবন করতে পারে সে
যদি এরকম বিভ্রান্তিকর উত্তর প্রদান করে যান তা হলে আমরা সাধারণরা বাস্তবতা বুঝব কার সাধ্য? কালকের দৈনিক পত্রিকার প্রধান শিরনাম কি হবে তা সম্পাদক
মহাশয় নির্ধারণ করেন নাকি স্রষ্টা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন তা নিয়ে তার
শেষ বইয়ে একটি গুরুগম্ভীর আলোচনা আছে যা আমি আবার সময় নিয়ে বুঝে পড়ব বলে ঠিক করে
রেখেছি।
এত
সততার সাথে পরিশ্রম সহকারে কাজ করেও যখন কর্তৃপক্ষ সময়মত প্রমোশনটা দিল না তখন
সাজ্জাদ ভাই এর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম আর বড় জোর ১৩ কি ১৪ টা
বছর বাঁচব হুজ্জতি করতে চাই না। প্রাণ খুলে প্রাণবন্ত হয়ে বাচতে
চাই। মনে করুন বলে দেয়া হল, এত তারিখ এতটার সময় আপনার জীবনাবসান। এমনটা হয় যাদের ক্যানসার হয় কিংবা এমন রোগ যার কোন নিরাময় নাই আর যখন
ডাক্তার আশা ভরসা ছেড়ে দিয়েছে। এটা বৃদ্ধ বয়সেও হতে পারে আবার হতে পারে আপনার বয়স
যখন অনেক কম, বিয়ে-থাও করেননি এখনও। এই থা টা কি তা আমি আজও জানি না, মনে হয় কথা
বলার ধারা। অনেককে আফসোস করতে শুনবেন বেচারা এত অল্প বয়সে চলে গেল, বিয়ে থাও করেনি।
আরে ভাই বিয়ে করাটা এত জরুরি কি থা করার জন্য? সে যাই হোক? প্রসঙ্গে
ফিরে আসি। যদি জানতে পারি কখন মারা যাব তা হলে আমার মনোভঙ্গিটা কি রকম হবে? আমার
লেখা থ্রি টাইপস্ অফ মাইন্ড সেট উইথ টু ট্র্যাপস্ যারা
পড়েছেন তারা ধরতে পারবেন এবার আমি কি বলব। মাইন্ড সেট যাই হোক না কেন, মৃত্যু
ক্ষনটা জানা থাকলে কে কি করবে কিংবা কেউ যদি মনে করে আমি ঠিক এতটার সময় নিজের
জীবনাবসান করব তার আচরণটা কি হবে? এ থিমের উপর বেশ কতগুলা হলিউড মুভি হয়েছে যে
গুলর চিন্তাধারা চমৎকার বটে। কিন্তু একটি অস্ট্রেলিয়ান মুভিতে দেখান হল, এক নিষঙ্গ
বৃদ্ধ মরার প্রস্তুতি নিয়ে তার জন্মস্থানের দিকে রওনা হয়েছিল কিন্তু শত চেষ্টা করেও
সে মরতে পারে নাই। পথে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাই ছিল ছবিটির চলচ্চিত্র আর মূল থিম ছিল আপনি চাইলেই মরতে পারবেন না। পথিমধ্যে এক উচ্ছল তরুণীর অযথা অনুপ্রবেশ পুর মুভিটার
ভাবটাই বদলে দিয়েছে, মনে হয় বলতে চাচ্ছে প্রাণবন্ততাই জীবনে বেচে থাকার মূল প্রেরণা। বর্তমান
বিশ্বের মানব আচরণ দেখলে বুঝা যায় তারা মৃত্যুকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে বাস্তব
চিন্তা করতে চায় না। তাদের পরিকল্পনাতে হঠাত শেষ হয়ে যেতে পারে এই প্রসঙ্গটাই থাকে
না। তারা দেখে অভ্যস্ত যে কার মৃত্যুতে বাস্তবতা তেমন একটা ব্যেহত হয়
না, যার আপনজন মারা যায় সে বা তার পরিবার সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বটে, তার
পর সময়ের সাথে যেই লাউ সেই কদু। মৃত্যু যেহেতু চলমান সময়ে হঠাত ঘটে যাওয়া একটা
এক্সিডেন্ট কিংবা জীবনের ধীরে ধীরে ক্ষয় পেয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার মত একটি স্বাভাবিক ঘটনা তাই এত চিন্তার কি আছে।
মরে গেলে মরে যাব তার পর আর কি, যা হবার তাই হবে,। ভাল
ভাবে প্রাণবন্ত হয়ে, সুস্থ-সবল হয়ে মরার আগ পর্যন্ত বেচে
থাকার ইচ্ছা সবার।
তাই গানের লাইনটা চমৎকার বলেছে, তার আর পর নাই, নাই কোন ঠিকানা।
হলিউডের
ফাইনাল ডেসটিনেশন মুভি সিকুয়েলে মৃত্যুকে একটি ষড়যন্তকারী ও অভিষন্ধীকারী চরিত্র
আকারে চিত্রণ করা হয়েছে। মৃত্যু দূত আজরাইল এর কাজ এটা, তাকে তো ঘোষ্ট
রাইডার মুভিতে মানুষের আকৃতিতেই চিত্রণ করা হয়েছে। মৃত্যু বা জীবনাবসান তো সকল
প্রজাতিতেই রয়েছে, সরল মনে বিচার করলে প্রকৃতিতে কেবল দুট জিনিসই দেখতে পাওয়া যায়, একটি জড় যা ভাংছে গড়ছে কিন্তু শক্তির নিত্যতায় একই
থাকছে, যা স্থায়ীই বলা যায়, আর
এক হলো জীব ও তার জীবনচক্র যা
চক্রাকারে জন্মাচ্ছে, বাড়ছে, বুড়া হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে এবং নতুন প্রজন্ম রেখে যাচ্ছে কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই জীবন্তদের উন্নত প্রজাতিতে নিউরন আছে বিধায় বলা যায় এরা উন্নত ও সংবেদন সম্পন্ন এবং
এদের ধারায় সবার উপরে মানব
যার লক্ষ কোটি নিউরন
বা স্নায়ু সমৃদ্ধ মস্তিষ্ক ও তার ইলেক্ট্রা-কেমিকেল ইমপাল্স চালিত মননশক্তি
আছে। এটা নিঃসন্দেহে নাস্তিক ও ধর্ম নিরপেক্ষদের জীব সংক্রান্ত ব্যাখ্যা। এই মানব মনের
এ্যাসেন্ট বা উত্তরণ তাদের
কাছে জীবনের উদ্দেশ্য, জীবন চক্রে প্রজাতির পুনর্জন্ম সংখ্যা বাড়তে বাড়তে পরিমাণ
গত পরিবর্তনের কোন এক ক্রিটি-কাল মুহূর্তে বিবর্তন ঘটে যাবে তার
পর হবে প্রতিষেধের প্রতিষেধ। তা হল আদীমানব বিবর্তিত হয়ে মহাকালের ধারায় একসময় অতিমানব ও তার পর মহামানবে রূপান্তরিত হলেও
হতে পারে। হলিউডের এক্স-ম্যান মুভি সিকুয়েল তো এই থিমের উপরই রচনা করা
হয়েছে। পূর্বের মানব মনের
সংশ্লেষণ ক্ষমতা বা বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে, কম্পিউটারের বিবর্তন
ইতিহাস দেখলেই তা প্রমাণ হয়। মানব মনের উন্নয়ন তারা বিস্তার করছে যাতে সম্মিলিত
মানব সত্ত্বা তথা সভ্যতা উন্নত হয়। অন্য যে কোন প্রজাতির মত মানব প্রজাতিও
সারভাইভাল বা টিকে থাকার প্রতিযোগীতা করে, যেমন প্রতিকুল অনুন্নত শহর থেকে উন্নত
শহরে মাইগ্রেট করে। বংশ বৃদ্ধি করে ও সন্তানের জন্য যার পর নাই যা খুশি তাই করে।
তার পর অসহায় বোধ করে মরে গেলে কি হবে জানে না কিন্তু আর বেচে থাকার উপয়ও তার
জানা নাই। তাই তো সব উত্তর এর আধার ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মানব মনের পূর্ণতা। মনে
মনে ভাব ও চিন্তার বিস্তার ঘটায়ে স্থায়িত্ব পাওয়ার প্রবৃত্তি আছে বটে মানব মনের
কিন্তু সে ভাবে কি আর বাস্তবে অমরত্ব পাওয়া যায়? ধর্মের ব্যাখ্যা যদি মেনে নেন তা
হলে মনে প্রকাণ্ড শান্তি পাবেন আর না মানলে আপনার শান্তির প্রচেষ্টা অমীমাংসিতই
থেকে যাবে। আমার মতে মানব জীবনের চ্যালেঞ্জটা হল মনের প্রশান্ত ভাবটাকে নিশ্চিত
রেখে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা আর গবেষণা ও এক্সপেরিমেন্টেশনের মাধ্যমে উন্নত বুদ্ধিমত্তায়
ক্রমাগত উত্তরণের অবিরাম প্রচেষ্টা। একেই জেকব ব্রুনওস্কি হিউম্যান এসেন্ট বলেছেন
তার বইয়ে। একই রকম কথা ধর্মীও বক্তা ইমরান নজর হোসেনও বলেছেন। তিনি
অনেকটা এরকম বলেছেন যে, মানব বুদ্ধিমত্তার ক্রমাগত উন্নয়ন চেষ্টা মনে হয় স্রষ্টা
পছন্দ করেন।
আমি
কোন ঘরানার তা বলেই দেই, ধর্মকে ইদানীং আমার খুব একটা ভাল লাগে না তবে স্রষ্টার
উপর বিশ্বাস হারাই নাই। সব কিছুই পূর্ব পরিকল্পিত কি না? অর্থাৎ স্রষ্টার পরিকল্পনা
কি না, সে প্রসঙ্গে আমার মতামতও গুরু হকিং মহোদয়ের দেয়া শেষ বক্তব্যে আটকে আছে, উত্তরটা
হ্যাঁ, কিন্তু না’ও হতে পারে। যদিও এই উত্তরটা পড়ে আমার তিতা তিতা লেগেছে, তার পরও
বলব, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়গুলো পূর্ব পরিকল্পিত ভাবতে আমার ইচ্ছা করে না, তবে
উত্তরটা হ্যাঁও তোঁ হতে পারে। লেখাটার শিরনাম “তার আর পর নাই” বলেছি কারণ, এ লেখাটা নিয়মিত
আপডেট করার ইচ্ছা আছে ব্লগে আর “নাই কোন ঠিকানা” বললাম এই কারণে যে, এই মানব
সভ্যতার মা-বাপ নাই, যার যা খুশি তাই করছে আর করতেই থাকবে। তাছাড়া গানটাও তো চমৎকার,
আগে বহু বার শুনে থাকলেও আরেকবার শুনতে ভালই লাগে।
No comments:
Post a Comment