Thursday, January 16, 2025

ব্যাংকিং ও ইসলামী ব্যাংকিং পরিস্থিতি - ২০২৪ বর্ষ সমাপনী

 


গত বছর ২০২৪ এর শুরুতে ব্যাংকিং পরিস্থিতি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা ছিল কিন্তু এবার ২০২৫ সালের শুরুতে কেমন যেন হুরমুর করে সব ঘটে যাচ্ছে। পরিস্থিতি বুঝতে না বুঝতেই চলে আসছে নিত্য নতুন অবস্থায়। কাজের ব্যস্ততায় সব দিকের খোজ খবরও ঠিকমত রাখতে পারছি না। প্রতি বছর নিজের প্রয়োজনেই ব্যাংকিং পরিস্থিতি নিয়ে একটা পর্যালোচনা দরকার হয়, এবারও সেই উদ্দেশ্যেই কিছু লিখে রাখা। আমার বর্তমান অভিজ্ঞতা বলছে যে দেশের এই রিস্কি পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যে তান্ডব চলছে, আর জনগণের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যে উথাল পাথাল দৌড়া দৌড়ী প্রত্যক্ষ করছি, তাতে আমি হতভম্ব হওয়ার ঠিক আগের অবস্থায় আছি। আমি এর পিছনের কারণ গুলো খুঁজতে গিয়ে প্রায় খেই হারায়ে ফেলার অবস্থায় ছিলাম। আমার স্কুলের বন্ধু আইএফআইএল এর প্রাক্তন এমডি আমাদের স্কুল গ্রুপে জানালো তার আক্ষেপের কথা, তার ভাষ্য মতে "দেশের সকল সিস্টেম, সকল এডমিনিস্ট্রেশন মুখ থুবড়ে পড়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যবসা বাণিজ্যের লালবাতি, ব্যাংক গুলো খালি, অর্থনৈতিক চরম দুরবস্থা, অনিশ্চয়তা সর্বক্ষেত্রে, কোটি কোটি বেকার" তার প্রশ্ন এর অবসান কোথায়।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো দেশের এই রিস্কি পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে আপাত দৃষ্টিতে মারাত্মক রকম বুমিং দেখা যাচ্ছে। প্রচুর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চারদিকে, লোকজনের ছুটাছুটি বেড়ে গেছে বহুগুণে। অবাক হওয়র মত বিষয় হলো ধসে যাওয়া ব্যাংকিং সেক্টর উঠে দাঁড়ানোর তাল দিচ্ছে আর তাতে সবাই ফান্ড এদিক ওদিক করছে। মুক্ত বাজারে পণ্যও আছে আবার ক্রেতাও আছে প্রচুর যা সুস্থ বাজার ব্যবস্থা বা অর্থনীতির নির্দেশক। পণ্য সরবরাহ আর তার চাহিদা সব ঠিকঠাক ও চলমান আছে। এখন আর কেউ সিন্ডিকেশনের ধুয়া তুলে সরকারকে দোষারোপ করে না কিন্তু বাজার দরে যে আকাশ পাতাল পরিবর্তন হয়ে গেছে তাও তো দেখা যাচ্ছে না। দেশে কোন নির্বাচিত সরকার নাই তাই অর্থনীতি থেমে যাওয়ার কথা কিংবা অন্তত শ্লথ হতে পারতো, তার বদলে লোকজনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এত হট্টগোলের কোন অর্থ করতে পারছিলাম না কিছুদিন আগেও, ব্যাখ্য আসলো এক উবার ড্রাইভারের কাছ থেকে। আমার মনে হচ্ছিল বিগত সরকারের আমলের মেগা প্রোজেক্ট গুলো সফলভাবে সচল হওয়ার প্রেক্ষিতে একটা গতি জড়তা বা ইনারশিয়া অব মোশনে দেশের অর্থনীতিতে এই আপাত বুমিং পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে কিন্তু ড্রাইভারটি বললেন তার বিশ্লেষণ, তার মতে, একদল লোক তাদের পূর্বের বিনিয়োগ কৃত টাকা বাজার থেকে উঠায়ে নিচ্ছে তরি ঘড়ি করে, আরেক দল লোক যারা বিগত ১৫ বছর নীচে পড়ে ছিলো তারা নতুন উদ্যমে মাঠে নামছে, নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনার প্রত্যাশায়। ঘটনা প্রবাহ পরিদৃষ্টে পরিস্থিতির এই বর্ণনা আমার কাছে যুক্তিযুক্তই মনে হলো। হতে পারে দুটা ব্যাখ্যাই কাজ করছে ব্যাকগ্রাউন্ডে, তা না হলে এত অর্থনৈতিক হট্টগোলের পিছনে আর কি এমন কারণ থাকতে পারে। আরেকটি কারণ অনুমান করা যেতে পারে, যেহেতু বিগত ১৫ বছর একটা সরকার টানা ক্ষমতায় ছিল, তাদের যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা হঠাত করে নাই হয়ে যাওয়ায় এবং নতুন কোন শক্তিশালী সরকার ক্ষমতায় না এসে বরং তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে একটা ঢিলা ঢালা ভাব চলে এসেছে। এই সুযোগে সব লোক হুলুস্থুল করে তাদের দাবি আদায় করে নিচ্ছে। এই উদ্ভট পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি ব্যাংক দারুণ রকম অর্থ সংকট বা লিকুইডিটি ক্রাইসিস এখনও কাটায়ে উঠতে পারে নি, বরং আরো মারাত্মক রকম সমস্যায় পড়েছে। রুগ্ন ব্যাংক গুলোতে লোকবল ছাটাই চলছে, ওখানে সিনিয়র কিংবা জুনিয়র অফিসার গণহারে চাকুরী হারানর ভয়ে আতঙ্কিত। 

এর মধ্যে আমরা দেখছি দেশের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সুপার নিউমারারি পদোন্নতির হিড়িক। পদ না থাকলেও পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ৭২১৫ জনকে। এটা যে এক ধরনের সিস্টেম লস তা কিন্তু মুখ ফুটে কেউ বলার সাহসও পাচ্ছে না। তড়িঘড়ি করে এই পদোন্নতি প্রদান কতটা সময়োপযোগী ও সঠিক তা কিন্তু বুঝা যাচ্ছে না। আমি পদোন্নতির বিপক্ষে না কিন্তু তা হওয়া উচিত কিছু নিয়ম নিতির ভিত্তিতে। হঠকারী সিদ্ধান্ত কিংবা হুজুগে পড়ে এরকম করা হলে তা কোন ভালো ফল নিয়ে নাও আসতে পারে। বনিক বার্তা কর্তৃক নির্মিত ভিডিও সংবাদ চিত্রটির লিংক ও কিউআর কোড (Quick Response Code) নিচে দিয়ে রাখলাম। 

 https://youtu.be/0rnFGgHOOU4?si=B6ErwET2x83Hfi6A

বিগত যে কোন সময়ের চেয়ে সোনালী ব্যাংক পিএলসি এবার সর্বাধিক মুনাফার রেকর্ড অর্জন করেছে, যা একটি শুভ সংবাদ। এর পিছনের কারন গুলোও একটু বুঝে দেখা দরকার বলে আমি মনে করি। 


সোনালী ব্যাংক পিএলসি এ বছর তার পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙ্গে সর্বাধিক পরিচালন মুনাফা বা অপারেটিং প্রফিট অর্জন করেছে যা ৫,৬৩৪ কোটি টাকা। ব্যাংকিং অঙ্গনে কতক ব্যাংক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রত, সেই অবস্থায় সোনালী ব্যাংকের অধিক মুনাফা অর্জন করা এটাই ইঙ্গিত করে যে, জনগণ সরকারের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে সোনালী ব্যাংকে টাকা রাখতে আস্থা পাচ্ছে। ইত্যবসরে এই ব্যাংক দারুণভাবে তার ব্যাংকিং ব্যবসার বিস্তার ঘটাচ্ছে। স্বভাবতই সোনালী ব্যাংক এ দেশের আপামর জনসাধরনের ব্যাংকিং সুবিধার বিষয়ে খেয়াল রাখে। এমনকি কৃষকদের জন্য ১০ টাকা জমা দিয়ে ফর্মারস একাউন্ট খোলার ব্যবস্থাও আছে এই ব্যাংকে। দেশের জনগণ বিশেষ করে যারা উচ্চবিত্ত তারা সোনালী ব্যাংক ও এর লোকবলকে অন্যান্য চটকদার ব্যাংকের তুলনায় হেয় করে বিবেচনা করে থাকতো। আমার বাবার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে আমি এই ব্যাংকে জয়েন করি ২০০৪ সালে। তার পরবর্তী এক বছরে বাবার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু, আমার শ্রদ্ধেয় দুই আঙ্কেল (মজিদ ও খায়ের আঙ্কেল) এর সাথে দেখা হলে যখন বলি যে আমি সোনালী ব্যাংকে জয়েন করেছি, তারা পুরাই নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন, বিশ্বয়ে নির্বাক হওয়া নয় মোটেও, তারা বুঝতে পারছিলেন না যে, এটা একটা শুভ সংবাদ নাকি নিতান্তই একটা সাধারণ সংবাদ, এটাকে কি বলা যায় “যাক বাবা ভালো হয়েছে, একটা সরকারী ব্যাংকে চাকুরী পেয়েছো” না কি বলবে, “এই রকম সাধারণ একটা ব্যাংকে জয়েন করলা!!, কত ভালো ভালো প্রাইভেট ব্যাংক থাকতে?” তারা আসলে দুটা মনোভঙ্গির কোনটি বলবে বুঝে উঠতে পারে নাই মনে হয়।

দেশের ১২৩১টি শাখায় সোনালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোর সেবা ডিপ্লয় করে দিলো এই কয়েকদিন আগেই, যা সারা দেশের সকল মানুষের জন্য একটি শুভ সংবাদ। দেশের সর্ববৃহৎ রাষ্টায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংক এখন ইসলামী ব্যাংকিং সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। 


২০১০ সালে সোনালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং সেবা চালু করে ফকিরাপুল শাখার ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে, যা ২০১৫ সালে ৬২ দিলকুশা, ওয়েজ আর্নার্স কর্পোরেট শাখায় স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে এই ব্যাংকের ৫৮টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে দেশের সকল শাখায় এই সেবা প্রদানের সুযোগ করে দিয়েছে। আমি বিগত ২০১৭ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংকিং এ সিক্রয় ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমার সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তর ভিত্তিতে করা নিম্নের তথ্যচিত্র গুলো বিশ্লেষণ করলে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ইসলামী ব্যাংকিং অঙ্গনের কিছু বাস্তব অবস্থা বুঝা যেতে পারে।
 



বিগত নয় বছরের হিস্টোগ্রাম বিচার করলে দেখা যাবে যে, একটি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোর আমানত সংগ্রহ আর মুনাফা ধারাবাহিক ভাবে উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল কিন্তু ২০২৪ সালে আকস্মিক ভাবে বিনিয়োগের ফিগারে ঋণাত্মক টার্ন দেখা যাচ্ছে অথচ তা মুনাফার ট্রেন্ডে কোন প্রভাব ফেলেনি। আমানত ও মুনাফা প্রদত্ত টার্গেটের চেয়েও অধিক হারে বৃদ্ধি পেলেও বিনিয়োগ হ্রাস একটি বিস্ময়কর সংকেত দেয়, নিঃসন্দেহে এটি একটি অস্বাভাবিক অবস্থার ইংগিত প্রদান করে। সাধারণ বিচারে বুঝা যায় বিনিয়োগ কমলেও পূর্বের তুলনায় মুনাফা বৃদ্ধির মানে হলো অনেকেই হাইকস্ট ডিপোজিট গ্রহণ করছে কিংবা অধিক মুনাফার শর্তে ঋণ বা বিনিয়োগ গ্রহণ করছে। অর্থ বাজারে যখন লিকিউডিটি ক্রাইসিস চলে তখন তারল্য সংকট নিরসনে অন্যান্য ব্যাংক কিংবা গ্রাহক গণ অধিক মুনাফা প্রদানের শর্তে হাই-কস্ট বিনিয়োগ গ্রহণ করে থাকে। উপরোক্ত তথ্য চিত্র গলো তার একটি বাস্তব সিনপসিস প্রদান করছে। এর মানে হলো, কম বিনিয়োগ করেও অধিক মুনাফা অর্জন করা যাচ্ছে।


ইসলামী উইন্ডোটির বিগত ৬ মাসের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপাত্ত বিশ্লেষণ পরবর্তী তিনমাসে ফোর-কাস্টিং করা হলে দেখা যাচ্ছে মার্চ ২০২৫ নাগাদ ডিপোজিট বা আমানত আরো দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে পারে যার সাথে মুনাফার ট্রেন্ডও ঊর্ধ্বমুখী থাকার সম্ভাবনা আছে যদিও বিনিয়োগের পরিমাণ হয়তো সামনে আরো কমে যেতে পারে। যা থেকে বুঝা যায় যে, আগামী তিন কি ৬ মাসেওে এ দেশের ব্যাংকিং অঙ্গনে লিকুইডিটি ক্রাইসিস অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী বছর ২০২৬ এর মাঝামাঝি নাগাদ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তেমন কোন বড় পরিবর্তন আশা কারা যাচ্ছে না, আর দেশের এই ক্রান্তি কালে ভবিষ্যৎ পরিপ্রেক্ষিত প্রচন্ড রকম অনিশ্চিত ঝুঁকিপূর্ণ, এরকম অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়া ব্যাংক গুলো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রত, তারা তাই মুদ্রা বাজার থেকে হাই কস্ট ডিপোজিট টানছে। কিছু লোভী গ্রাহক হুজুগে পড়ে ফান্ড ট্র্যান্সফারও করছে সেই সব ব্যাংকে। এই সকল গ্রাহক একটা বিষয় বিবেচনায় আনছেন না যে, এই রিস্কি রাজনৈতিক অবস্থায়, দেশের এই নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতেতে বড় কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা ফান্ড ম্যানেজমেন্টে হঠকারিতা প্রদর্শন ভবিষ্যতে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। আমার মতে এই রকম রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ফান্ড ম্যানেজমেন্টে জনগণের আরো সাবধানী মনোভাব পোষণ করা উচিত।

সম্পাদনা ও উন্নয়ন ইতিহাসঃ (edit and update history) ৭জানু২০২৫> ১৬জানু২০২৫>





2 comments:

  1. Thanks for the informative writing!

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ ভাই, যা দেখি, যা বুঝি তাই লিখি, কোথাও ভুল হলে ধরায়ে দিবেন।

      Delete